Street hawkers

সম্পাদক সমীপেষু: হকারের শহর

হকারদের সংগঠিত করতে ‘কলিকাতা ও বেঙ্গল হকার সংগ্ৰাম কমিটি’ কাজ করেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:৪২

কলকাতা শহরে পুরসভার ভোট এলেই অবধারিত ভাবে হকার প্রসঙ্গ ওঠে। শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই হকারের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজারের কাছাকাছি, যাঁদের মিলিত ব্যবসার পরিমাণ ২০০ কোটি আমেরিকান ডলারের সমান। হকার উচ্ছেদ নিয়ে সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে ধারাবাহিক সংঘাত চলছে। ষাটের দশকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল শহরের ৮০ শতাংশ ফুটপাত উদ্ধারে তৎপর হলে বিরোধী সিপিএম হকারদের প্রতিবাদে শামিল হয়। পরে বামফ্রন্ট সরকারের প্রশ্রয়ে হকাররাজ বেড়ে চললেও, জনমতের চাপে অবশেষে ১৯৯৬ সালে ‘অপারেশন সানশাইন’ নাম দিয়ে হাজারেরও বেশি হকার উচ্ছেদ করে পুরসভা। তদানীন্তন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবাদে হকার উচ্ছেদ বেশি দূর এগোতে পারেনি। ২০০০-২০০৫ সালে কলকাতা পুরসভায় তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হকারদের বাড়বাড়ন্ত পুনরায় শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন জনস্বার্থ মামলায় তিতিবিরক্ত কলকাতা হাই কোর্ট নানা সময়ে হকারদের বেআইনি ফুটপাত দখলের ব্যাপারে রাজ্য সরকার ও পুরসভার কাছে তথ্য জানতে চাইলেও, তা অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে।

হকারদের সংগঠিত করতে ‘কলিকাতা ও বেঙ্গল হকার সংগ্ৰাম কমিটি’ কাজ করেছে। তার সদস্যদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের নেতৃত্ব, রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও পারিষদবর্গ কর্তৃক হকাররা বার বার শোষিত হয়েছেন। একটি পরিসংখ্যানে তাঁদের দাবি, হকাররা প্রায় ২৬৬ কোটি টাকা ঘুষ বাবদ দিয়েছেন, যা তাঁদের ব্যবসার প্রায় ৩ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ। উৎকোচ আদায়ে নির্দিষ্ট প্রতিনিধি সময়মতো নির্দিষ্ট অঞ্চলে যাতায়াত করে অর্থ তোলেন, যা সুচারু ভাবে পৌঁছে যায় প্রতিটি পকেটে পকেটে। শহরের সর্বত্র এই প্রাপ্ত অর্থের আনুপাতিক হার ভিন্ন ভিন্ন। ভোটের কথা ভেবেই হয়তো কলকাতা পুরসভার সদ্যপ্রাক্তন মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম হকারদের দায় হাস্যকর ভাবে পুলিশ-প্রশাসনের উপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। ভোটপর্ব মিটলে এই হকাররাই আবার মিছিল মিটিং-এর মধ্য দিয়ে শাসক দলের পরম সম্পদ হয়ে উঠবেন।

Advertisement

ইন্দ্রনীল বড়ুয়া, কলকাতা-১৫

অনলাইনের ঝুঁকি

অতি সম্প্রতি রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগ রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছে বর্তমান সিমেস্টার শেষের পরীক্ষা যেন ‘অনলাইন’-এ নেওয়া হয়। যুক্তি হল, যে হেতু বর্তমান সিমেস্টারের অধিকাংশ ক্লাস অনলাইনে নেওয়া হয়েছে, অতএব পরীক্ষাও যেন অনলাইনে নেওয়া হয়। এই যুক্তি অত্যন্ত অসার। প্রথমত, ২০২০ সালে অতিমারির কারণে আচমকা লকডাউন হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া হয়েছিল। শ্রেণিকক্ষে অফলাইনে পাঠ নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা তখন অনলাইনে পরীক্ষা দিয়েছিল। পরীক্ষকরাও সে ভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন। যদিও, ইমেল-এর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র পাঠানোকে আদৌ অনলাইন পরীক্ষা বলা যায় কি না সন্দেহ আছে? সে দিন কিন্তু তাতে কিছু আটকায়নি। তা হলে, আজ কেন অনলাইনে পড়ে অফলাইনে পরীক্ষা দেওয়া যাবে না, সে কথা বোঝা দায়।

আরও লক্ষ করার মতো বিষয়, অতিমারির আশঙ্কাকে আদৌ কোনও কারণ হিসাবে এখানে দেখানো হয়নি। এই ঘোষণার দ্বারা সরকার প্রকারান্তরে স্বীকার করেই নিল যে, তথাকথিত অনলাইন পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের আদৌ কোনও উন্নতি ঘটাতে পারেনি। তারা এতই দুর্বল থেকে গিয়েছে যে, পরীক্ষাকেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দেওয়ার সামান্য জোরটুকুও তাদের জন্মায়নি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, শতকরা ৩০ ভাগ ছাত্রছাত্রী বড়জোর অনলাইন ক্লাস করেছে। পড়াছুটের সংখ্যা কত, তার কোনও হিসাব আছে কি?

দ্বিতীয়ত, সারা দেশ জুড়ে দশম ও দ্বাদশের কেন্দ্রীয় বোর্ডের যে পরীক্ষা চলেছে, তাতে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী দু’-বছর অনলাইনে ক্লাস করার পর এখন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা প্রায় সবাই আঠারোর কমবয়সি হওয়ায় কোভিডের প্রতিষেধক পায়নি। কিন্তু তা নিয়ে সরকার, প্রতিষ্ঠান, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকসমাজ, অভিভাবকবৃন্দের কোনও আপত্তি এখনও লক্ষ করা যায়নি। তা হলে, রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেই পথ অনুসৃত হল না কেন? ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপককুলের অনেকেই তো ইতিমধ্যে প্রতিষেধকের একটি বা দু’টি ডোজ় নিয়ে নিয়েছেন।
তৃতীয়ত, যদি সকলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, উৎসবে-অনুষ্ঠানে গা ভাসাতে পারেন, দোকান-বাজার করতে পারেন, তবে শুধু পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতেই বা আটকাচ্ছে কোথায়?

প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে উচ্চশিক্ষাকে আবার সজীব করে তোলার যে সাধু উদ্যোগ করা হয়েছিল, তার মূলে কুঠারাঘাত করল এই আদেশনামা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বলছি, পরীক্ষা নিয়ামকের দফতরগুলোর অকর্মণ্যতা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাকে (ব্যতিক্রম থাকতেই পারে) মদত জোগাবে এই নীতি। একে উপেক্ষা করে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবেন উপাচার্যরা, তা নিতান্তই দুরাশা। ‘অনলাইন’ পরীক্ষার নামে যে প্রহসন বিগত দেড় বছর ধরে চলছে, তাতে কার্যত ইন্ধন জুগিয়ে, আদ্যন্ত সুবিধাবাদ ও টিউশন-সর্বস্ব গণটোকাটুকিকে প্রশ্রয় দিয়ে, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সর্বনাশ করে কি আদৌ আমরা এগোতে পারব?

সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

স্বেচ্ছা নাগরিক

আমেরিকার বড় বড় ‘টেক কোম্পানি’-র শীর্ষকর্তারা ভারতীয়, কিন্তু তাঁরা ভারতে নেই বলে অনেকে বিচলিত। তাতে নাকি ‘ব্রেন ড্রেন’ হচ্ছে। সুধা ভরদ্বাজ কিন্তু আমেরিকান নাগরিকত্ব ছেড়ে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। সম্প্রতি বম্বে হাই কোর্ট তাঁকে জামিন দিলে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে (‘মুক্তি সুধার, থাকতে হবে মুম্বইয়ে’, ১০-১২)।

এগারো বছর বয়সে সুধা মায়ের সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। ১৮ বছরের সুধা যখন দিল্লির আমেরিকান দূতাবাসে গিয়ে জানান, তিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব ছেড়ে দিতে চান, কর্তব্যরত কর্মীরা অবাক হয়ে যান। এমন ঘটনা এতটাই বিরল যে, ওখানে আমেরিকান নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার ফর্মও ছিল না। তাঁকে কিছু দিন পরে আবার আসতে বলা হয়।

সুধা আইআইটি কানপুরের শীর্ষ ছাত্রী ছিলেন। চাইলেই আরামের জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি যে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন; সেই দেশের মানুষদের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন। বিখ্যাত শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহনিয়োগীর সংস্পর্শে আসেন কলেজে পড়াকালীন। তার পর ছত্তীসগঢ় মুক্তি মোর্চার সঙ্গে সেখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, প্রান্তিক মানুষদের পক্ষে আইনি লড়াই করা কতটা কঠিন। চল্লিশ বছর বয়সে ওকালতি পাশ করেন। তৎপরবর্তীতে ক্রমাগত সমাজের প্রান্তিক মানুষদের হয়ে আইনি লড়াই লড়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা নিজেকে ‘সাদা চামড়ার মানুষের আদালতে এক জন কালো চামড়ার মানুষ’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। সেই উপমার প্রসঙ্গ টেনে সুধা ভরদ্বাজ বলেছিলেন, “কখনও তুমি সাদা চামড়ার মানুষের আদালতে এক জন কালো চামড়ার মানুষ হতে পারো, কখনও তুমি পুরুষের আদালতে এক জন মহিলা হতে পারো, কখনও শিল্পপতির আদালতে তুমি এক জন খেটে খাওয়া মানুষ হতে পারো, আবার কখনও রাষ্ট্রের আদালতে তুমি গণআন্দোলন হতে পারো। সব কিছু তোমার বিরুদ্ধে থাকবে, কিন্তু তুমি হাল ছেড়ে দিতে পারো না, তুমি বিনা লড়াইয়ে হার মেনে নিতে পারো না।”

সুধা বিনা লড়াইয়ে হার মেনে নেননি। টানা তিন দশক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে লড়ে গিয়েছেন; আদালতে এবং রাস্তায়। মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমরা যেন ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস বিস্মৃত না হই।

সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়, ইমেল মারফত

আরও পড়ুন
Advertisement