‘অনাহার অতীত, আমলাশোলে হোম স্টে’ (৪-১২) শীর্ষক খবরে প্রতিবেদক দাবি করেছেন, “উন্নয়ন আর শান্তির ছোঁয়ায় এই দিনবদলে খুশি আমলাশোল।” নভেম্বরের গোড়ার দিকে বেলপাহাড়ি ঘুরতে গিয়ে আমলাশোলে এক বেলা কাটানোর অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রতিবেদকের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাচ্ছি না। ২০০৪ সালে পাঁচ শবরের অনাহারে মৃত্যুর ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটি একটু ফিরে দেখা যাক। সাতাত্তরের পর বামফ্রন্ট সরকার অন্য আদিবাসীদের মতো শবরদের মধ্যে কিছু জমি বিলি করেছিল। কিন্তু চাষাবাদ না জানার জন্য তাঁরা সে জমি কাজে লাগাতে পারেননি, তা পতিত হয়েই পড়ে ছিল। এক সময় জঙ্গলই ছিল তাঁদের খাবারের উৎস। ফলমূল, শাকসব্জি ছাড়াও এক ধরনের বিশাল আকারের বুনো আলু পাওয়া যেত। সেই আলু তুলে টুকরো টুকরো করে কেটে রোদে শুকিয়ে তাঁরা রেখে দিতেন ঘরের আড়ায়। বর্ষার সময় অন্য আনাজ দিয়ে রান্না করে খেতেন এই শুকনো আলু। খাবারের কষ্ট ছিল না তেমন ভাবে। উন্নয়নের দাপটে জঙ্গল নিধনের ফলে খাবারের সেই চিরায়ত জোগান থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন। শিকারও আর তেমন জুটত না। রোজগারের অন্য কোনও উপায় ছিল না। কেন্দুপাতা, বাবুই ঘাস কুড়িয়ে যৎসামান্য রোজগার হত। ফলে খিদে হয়ে ওঠে নিত্যসঙ্গী। পিঁপড়ের ডিম, লতাপাতা সেদ্ধ করে খেয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যান পাঁচ শবর।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর দু’টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ করার ফলে আদিবাসীদের বাড়িতে চালের অভাব নেই। তবে অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করার ক্ষমতা এখনও নেই। মেটে রাস্তায় পিচের প্রলেপ আর দু’চারটে পাকা বাড়ি ছাড়া উন্নয়নের আর কোনও নমুনা চোখে পড়ে না। একশো দিনের কাজ পেলে কয়েকটা টাকা ঘরে আসে। পশ্চিমবঙ্গের শবরদের ৫৯.১ শতাংশ খেতমজুর। আমলাশোলে খেতমজুরির কাজ পাওয়ার সুযোগ খুবই কম, বলছিলেন কাঁকড়াঝোড়ের ‘চারমূর্তি হোম স্টে’র কর্মচারী ঠাকুর মাহাতো। এই অঞ্চলে মাহাতোদেরই জমি বেশি, আর্থিক ক্ষমতাও বেশি। কিন্তু আদিবাসীদের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা। কাঁকড়াঝোড় থেকে কেতকি লেক হয়ে গড়রাসানি পাহাড়ে যাওয়ার পথের দু’ধারে চোখ পড়বে শীর্ণ, অপুষ্ট আদিবাসী মেয়েদের। তাঁদের সঙ্গের রুগ্ণ বাচ্চাদের দেখলে বোঝা যায়, উন্নয়নের রথ আমলাশোলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
এ কথা আরও বুঝতে পারা যায় কাঁকড়াঝোড়ের হাটে গেলে। আমলাশোলের আদিবাসীরা সারা সপ্তাহের কেনাকাটা এখান থেকেই সারেন। বাস স্ট্যান্ড-লাগোয়া এই হাটে বিক্রয়যোগ্য পণ্য বলতে আলু-পেঁয়াজ আর তেল, নুন, হলুদের মতো অতি প্রয়োজনীয় মুদির জিনিস। দোকানদারের কাছে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, আনাজ বা অন্যান্য উপকরণ কেনার খরিদ্দার এই হাটে পাওয়া যায় না। আদিবাসীদের হাতে পয়সা নেই। ফলে আমলাশোল আমূল পাল্টে গিয়েছে এবং আদিবাসীরা ভাল আছেন, এ কথা বোধ হয় সত্যের প্রতিফলন নয়।
কমল কুমার দাশ
কলকাতা-৭৮
দুঃস্বপ্ন
লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে অর্থপ্রাপক মহিলার প্রতিক্রিয়া শুনে অরবিন্দ ঘোষের (‘স্বপ্ন দেখব বলে দু’হাত পেতেছি’, ৮-১২) বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে, “সরকার লক্ষ্মীর প্রকল্পে টাকা নয়, ট্রান্সফার করেছে একগুচ্ছ স্বপ্ন।” এই স্বপ্নে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামাজিক সহযোগিতার আশ্বাস থাকতে পারে, কিন্তু শ্রমের উৎপাদনকেন্দ্রিক সততা ও নিষ্ঠার ভূমিকা দুর্বল। মানবসভ্যতার আদি থেকে শ্রমের মাধ্যমেই বীজ বপন করেছে, ক্রমে শিল্প, পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার হয়েছে। লেখক উল্লিখিত একান্ত অনুদান-নির্ভর ও শ্রমসম্পর্ক-বিযুক্ত প্রকল্পে সেই প্রগতির স্বপ্নের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রবন্ধে আছে “পৃথিবীর ১১৯টি দেশে এই ধরনের শর্তহীন টাকা হস্তান্তরের কোনও না কোনও প্রকল্প চালু আছে।” চালু থাকা মানেই প্রকল্পগুলি সার্থক ও সঙ্গত, এমন দাবি করা যায় না। সাধ ও সাধ্যের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে সার্থক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই ন্যায়নীতিগুলো তৃণমূল স্তর থেকে বিবেচনা করে রাষ্ট্রের আইনসভায় স্বীকৃত হয়। তখনই প্রকল্পগুলির কার্যকারিতার সম্ভাবনা বাড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে কোনও পরামর্শদাতা আর্থিক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সরকারকে এমন প্রকল্পগুলির পরামর্শ দিচ্ছে। অর্থাৎ প্রশ্ন ওঠে, এই সরকারি প্রকল্প গণতান্ত্রিক ভাবে কি নির্মিত হয়েছে?
তা ছাড়া পৃথিবীর ১১৯টি প্রকল্প একান্তই ‘শর্তহীন’ কি না, ভাবার দরকার। যে রাজ্যে মন্ত্রী দাবি করেন, সরকারি কর্মী, শিক্ষকদের ‘আমরা টাকা দিই’, সেখানে অঘোষিত ‘শর্ত’ প্রকাশ্যে এসে পড়ে। এই তথাকথিত শর্তহীন প্রকল্পগুলোর নেপথ্যে ভোট-সর্বস্ব পাইয়ে-দেওয়ার রাজনীতি ‘শর্ত’ হিসাবে স্পষ্ট। ২০১১ থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ব্যাপী রাজ্যে এত প্রকল্প সত্ত্বেও নোবেলপ্রাপ্ত বাঙালি অর্থনীতিবিদের গবেষণায় পশ্চিমবঙ্গে বৈষম্যের ছবি সাম্প্রতিক সংবাদে চোখে ভাসছে— “তিনি জানিয়েছেন, এ জন্য কাউকে দোষারোপ করা উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু গ্রামবাংলায় ঘুরে সাধারণ মানুষের গল্প-গাছা শোনার সময়ে তাঁদের স্বপ্ন চুরমার হওয়ার এবং বহু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে স্বপ্নের ছোট্ট গণ্ডিকে আরও ছোট করে আনার নির্মম বাস্তব ধরা পড়েছে তাঁর চোখে” (‘দেশের মানুষ চরম কষ্টে: অভিজিৎ’, ৬-১২)। অথচ, লেখক এক গাল হাসির মধ্যে ‘একগুচ্ছ স্বপ্ন’ দেখলেন! দুয়ারে সরকার থেকে ‘মৎস্যজীবী’ ও ‘শৈল্পিক ভাতা’ নামে আরও দু’টি প্রকল্পের কার্ড ঘোষণা করা হল (‘নতুন দুটি কার্ড চালু করার ঘোষণা’, ৮-১১)। অর্থাৎ, এ ভাবে অজস্র কার্ড হতে থাকবে। দৈহিক, বৌদ্ধিক শ্রমের সুযোগ ফেলে, অনুগত মানুষ ছুটবেন রাষ্ট্রের অনুদান পেতে। বিনাশ্রমে অগুনতি আর্থিক ভাতার জন্য সারা দিন লাইন দেবেন। পরাধীন মানুষ মন্ত্রীসান্ত্রিদের দোরে দোরে ছুটবেন। সরকার ব্যস্ত থাকবে এই অনুদান দিতে। ফের অপচয় বাড়বে। ভাগ্যবান ও অভাগার মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে। স্বপ্নে শুধু দেখা যাবে একপাল মানুষের ছোটা বিনাশ্রমে অর্থ পাওয়ার জন্য। তাঁদের সামনে স্বপ্ন— উঁচু থেকে কিছু লোক দু’হাত নিচু করে নগদ অর্থ দিচ্ছেন, আর সামনে কোটি কোটি মানুষ দু’হাত তুলে অপেক্ষা করছেন।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
টাই-বারমুডা
অতিমারি আসতে শুরু হল রুদ্ধদ্বার ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পর্ব। ভার্চুয়াল মিটিং-এ দেহের উপরের অংশে কোট-টাই পরে বসতে হয়। কিন্তু নীচের অংশে বারমুডা পরলেও চলে। এ রকম মিটিংয়ের ভান আমাদের এক অলীক ভার্চুয়াল জগতে নিয়ে যায়। কয়েক দিন আগে কাগজে দেখলাম, কোনও বিখ্যাত আইনজীবী নাকি ভার্চুয়াল শুনানির সময় শর্টস পরে ছিলেন, কোনও বিভ্রাটে সেটি ধরা পড়ে যাওয়ায় বিচারপতির কাছে তিরস্কৃত হন। আবার এক আ্যডভোকেট শুনানির ফাঁকে ধূমপান করেও ভর্ৎসিত হয়েছেন।
বাড়ির খুদেটিরও ভার্চুয়াল ক্লাস চলছে। সে স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে এখনও দিদিমণিকে চোখে দেখেনি। পড়াশোনা সবই মায়ের মোবাইলে। তার ইস্কুলের দিদিমণি কিন্তু খুব কড়া। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, চেয়ার টেবিলে বসে, স্কুল ড্রেস পরে তবে অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারবে। ওখানেও সেই এক দস্তুর, দেহের উপরের পোশাক ঠিক থাকলেই চলবে।
আগে মোবাইল ফোনের বিপ্লব ঘটার সময় এক বার দেখেছিলাম একটি ছেলে সল্ট লেক বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কানে ধরা মোবাইলে কাউকে বলে চলেছে, “আমি এখন পার্ক স্ট্রিটে একটি মিটিংয়ে আছি, এক ঘণ্টা পরে কল করুন।” ভয়ে ভয়ে রয়েছি, আমাদের ভান করার জগৎটি আরও বেড়ে গেল না তো? আমার বাড়ির খুদেটিও হয়তো পরম মুনশিয়ানায় শিখে নেবে তার কৌশল!
সুদীপ দাশ
কলকাতা-৭০