language

সম্পাদক সমীপেষু: বাংলা ও বাঙালি

এ রাজ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি সংস্থায় হিন্দি, ইংরেজি ভাষার দাপট বোঝা যায় এদের আধিকারিকদের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে কথা বললে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৩১

‘বঙ্গে চাকুরি করিতে হইলে বাংলা ভাষাটি শিখিয়া লইতে হইবে’ মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থানকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন সম্পাদক (‘স্বার্থরক্ষা’, ১৪-১২)। সমর্থন জানাই মাতৃভাষার এই অন্তর্ভুক্তিকে। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০২১, এত বছর কেন লাগল এই সরল সত্য বুঝতে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কাজ করতে গিয়ে টের পেয়েছি সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা, যেখানে অন্য রাজ্য থেকে আসা অবাঙালি আধিকারিকরা হিন্দি ভাষায় কথা বলে উপেক্ষা করে চলেছেন বাঙালি গ্রাহকদের। এঁদের বোঝানো হয়েছে, প্রতিবাদ করা হয়েছে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ পাত্তা দেননি। অন্যতম কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কার্যপ্রণালীতে আছে ‘রাষ্ট্রভাষা’কে উৎসাহ দেওয়ার নানা পদ্ধতি।

এ ভাবে এ রাজ্যে অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি সংস্থায় হিন্দি, ইংরেজি ভাষার দাপট বোঝা যায় এদের আধিকারিকদের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে কথা বললে। এখনও বোঝানো যাচ্ছে না, হিন্দি ও ইংরেজি জাতীয় স্তরে সরকারি ভাষা। আর হিন্দির মতোই ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলভুক্ত ২২টি ভাষার অন্তর্গত বাংলা। মর্যাদায় ভাষাগুলি প্রত্যেকটিই হিন্দির সমান। মুশকিল করেছে ৩৪৩ (১) ধারা, যেখানে ‘ল্যাঙ্গোয়েজ অব দ্য ইউনিয়ন’ বলে কেন্দ্রীয় সরকারি ভাষা হিন্দি লিপির প্রচলন ও প্রসারকে উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিষয় জানে না, এটা হতে পারে না। বিশেষ করে যেখানে ধারাবাহিক ভাবে বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রচলনের দাবি করা হচ্ছে। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, সর্বত্র সরকারি স্তরে বাংলা ভাষা সড়গড় করার ব্যবস্থা করা হোক।

Advertisement

সম্পাদক লিখেছেন, এই রাজ্যে শিল্প নেই, কাজ নেই। সম্পাদকের সঙ্গে সহমত হয়ে অনুরোধ, বাংলায় শিল্প পরিষেবা শুধু নয়, কৃষিক্ষেত্রেও লগ্নি হোক। সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা হোক। অনুদানভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে বাঙালিকে পরনির্ভর না করে শ্রমভিত্তিক আত্মনির্ভর করা হোক। বাংলার মুখ দেখাতে ভিনরাজ্যের কোনও তারকার বদলে বাঙালিকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হোক। ভিনরাজ্যের শিল্পপতিদের জায়গায় পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালি-অবাঙালি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়া ও সহযোগিতা করা হোক। সর্বত্র বাংলা ও বাঙালি সত্তার মর্যাদা তখন এমনিতেই বাড়বে।

শেষ অনুচ্ছেদে সম্পাদক লিখেছেন, যে রাজ্যেই কাজ করুক না কেন, বঙ্গসন্তানের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব বাংলার সরকারের। এই দাবি সমর্থন করে বলি, পশ্চিমবঙ্গকে এই জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। এটা যেমন শাসক সরকারের দায়িত্ব, তেমনই যাঁরা প্রবাসে, বিদেশে কাজ করছেন তাঁদেরও দায়িত্ব। তাঁরা নিশ্চয়ই সেখানকার ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন আপন বাঙালি সত্তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে। স্বার্থরক্ষার এই ব্যাপার আসলে কখনওই একতরফা নয়।

শুভ্রাংশু কুমার রায়

চন্দননগর, হুগলি

অগণতান্ত্রিক

‘স্বার্থরক্ষা’ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, “বঙ্গে চাকুরি করিতে হইলে বাংলা ভাষাটি শিখিয়া লইতে হইবে, মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থানকে অকুণ্ঠ ভাবে স্বাগত জানানো বিধেয়।” প্রশ্ন, কোন যুক্তিতে? যদি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় ভূমিপুত্রদের সংরক্ষণের বিষয়টির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ফরমানটির চরিত্রগত কোনও ফারাক থাকে, তা হলে ‘বাংলা জানিতে বা শিখিয়া লইতে হইবে’ এমন শর্ত কেন? এই শর্তটি কি অন্তর্ভুক্তির আড়ালে প্রত্যাখ্যানের পথকে প্রশস্ত করে না? বিজেপি-শাসিত রাজ্যে যা কিছু অন্যায়, তা তৃণমূল-শাসিত এই বাংলায় অনুসৃত হয় না বলেই বঙ্গবাসীর ধারণা। তা হলে ওই সব রাজ্যের প্রাদেশিকতা এই বঙ্গের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে অনুপ্রাণিত করার রসদ জোগায় কী ভাবে? ভারতে হিন্দি রাজভাষা হিসাবে সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত। অধিকাংশ রাজ্যে হয় হিন্দি নয় ইংরেজিতে সরকারি কাজকর্ম হয়ে থাকে। এই বাংলায়ও ইংরেজিতে সরকারি কাজকর্ম হয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও কোথাও দেখিনি বা শুনিনি যে, কোনও অবাঙালি কর্মীর বাংলা না জানার জন্য সরকারি কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। আমার দীর্ঘ চাকরিজীবনে বহু অবাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। ভাঙা বাংলায় তাঁরা যা বলতেন, তাতে কাজের কোনও অসুবিধা হয়নি। যে কোনও রাজ্যে চাকরি পাওয়া যে কোনও ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার। যোগ্যতাই চাকরির একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত। প্রাদেশিকতার আড়ালে যদি সেই যোগ্যতাকে বাতিল করা হয়, তবে তা শুধু অসাংবিধানিক নয়, অগণতান্ত্রিকও বটে।

মিহির কানুনগো

কলকাতা-৮১

সত্য বলিব

“মিথ্যার মোড়কে ঘৃণার প্রচারই বিপদ” (১১-১২) শীর্ষক প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। এই বছর তথ্য দিয়ে সত্য প্রচারের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন ফিলিপিন্স এবং রুশ সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ। তাঁরা দু’জনেই উল্লেখ করেছেন— বর্তমান বিশ্বে ভুল তথ্য দিয়ে অনেক সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। মারিয়া বলেন, “তথ্য বিনে সত্য জানা যাবে না। সত্য ছাড়া বিশ্বাস তৈরি হবে না। আর বিশ্বাস ছাড়া গণতন্ত্রের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না।” তাঁর এই মন্তব্য অতি মূল্যবান। সংবাদ, সংবাদের মতোই প্রচার হওয়া প্রয়োজন। সেখানে থাকবে না মিথ্যার বেসাতি, তিলকে তাল করা এবং অতিরঞ্জিত কোনও খবর। কিন্তু আমরা এই ইন্টারনেটের যুগে সমাজমাধ্যমে দেখতে পাই অধিকাংশ ভুয়ো বা ফেক নিউজ়। তাতে মানুষ নানা ভাবে হেনস্থা হচ্ছেন, বিপদে পড়ছেন। এই প্রসঙ্গে মারিয়া উল্লেখ করেছেন, “ক্ষমতা ও মুনাফার জন্য সমাজমাধ্যম এক মারণখেলা খেলছে।” এই ফেক নিউজ় বা ভুল তথ্যের জন্য মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। হিংসা ছড়িয়ে সমাজকে কলুষিত করার চেষ্টা চলছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটা মিথ্যা সংবাদ সমাজ বা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে। আবার তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ রাষ্ট্র, সমাজ এবং পৃথিবীকে শান্তি, বিশ্বাস ও সহমর্মিতায় ভরে দিতে পারে। তাই গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের প্রার্থনা— “যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না”। এটাই হোক সংবাদমাধ্যমের প্রচার।

স্বপন আদিত্য কুমার

অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

সম্রাট নন

‘বিধায়কের কাজ’ (২৭-১১) শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধটি বর্তমানে অতি বাস্তব। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিধানসভায় কী কর্তব্য, অতীতের বিধানসভার কার্যকলাপের দৃষ্টান্ত দিয়ে সঠিক ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। বিধানসভায় সরকার পক্ষ প্রস্তাব আনবে, বিরোধীরা তার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, প্রয়োজনে তা বদলাতে বাধ্য করবে, এটাই তো সাধারণ মানুষ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে আশা করেন। তাই এক সময় গণতন্ত্রে যেটা ছিল স্বাভাবিক, আজ সেই একই কাজ করলে আমাদের বিরল ঘটনা মনে হয়। আজকের দিনে রাজনৈতিক সহবত তলানিতে ঠেকেছে। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে দুই দলের নেতা, বিধায়ক, সাংসদের সহাবস্থান দুর্লভ। কেন্দ্র কি রাজ্য, কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। এটা কেমন সভ্যতা?

ভারত পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, সে সরকার পক্ষই হোক বা বিরোধী পক্ষ, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধ থাকা নৈতিক কর্তব্য। এক বার নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণ করার পর, নিজেকে ‘সম্রাট’ ভাবার কোনও কারণ নেই। নির্বাচিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী যেমন সকলের হয়ে কাজ করার শপথ নেন, তেমনই বিধায়করাও শুধু নিজের দলের নন, দলমত নির্বিশেষে সকলের— এ কথা ভুললে চলবে না। তা হলে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হবে।

জয়ন্ত কুমার দেবনাথ

রানাঘাট, নদিয়া

আরও পড়ুন
Advertisement