‘অন্ধকার ও আলো’ (৯-১) সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি দ্রোহপথের দিশারি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়োকে দু’শো বছর পেরিয়েও এই কালবেলায় প্রাসঙ্গিক করেছে। আশ্চর্য এই মানুষটি বিশুদ্ধ যুক্তি ও হিতৈষণা যোগে মানব মুক্তির চর্চা করেছিলেন ও তরুণ সমাজকে দেখাচ্ছিলেন সে পথ। যদিও তাঁর অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছাত্র যেমন— প্যারীচাঁদ মিত্র, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ যাঁরা ইয়ংবেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন, তা সম্যক অনুধাবন না করতে পেরে বিপরীত পথে অসংবেদী আচরণে লিপ্ত হয়েছিলেন। এক সময়ে এই ডিরোজ়িয়ানরা সমর্থন হারিয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের এবং নিজেরাও উচ্ছৃঙ্খল তরঙ্গে ভেসে গিয়েছেন বিপরীত পথে। কালগত সীমাবদ্ধতা ও স্ববিরোধে পরবর্তী জীবনে হয়ে পড়েন বিশুদ্ধ আপসপন্থী। স্বয়ং ডিরোজ়িয়ো কিন্তু নিজস্ব ভাবনায়, পথে ছিলেন অবিচল। তাই তাঁকে মূল্য দিতে হয়েছিল হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়ে। তখন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিত্তবান সমাজপতিরা আর্থিক সহযোগে (ন্যূনতম ৫০০০ টাকা ও তার বেশি) কলেজে বংশানুক্রমিক গভর্নর পদ পেয়েছিলেন। এঁরা ছিলেন বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র, পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর প্রমুখ। পরে পরিচালন সমিতিতে আসেন কলকাতার ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত বাঙালি— রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, শিবচন্দ্র সরকার, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, নবকৃষ্ণ সিংহেরা, যাঁরা ছিলেন তৎকালীন নানা হিন্দু ধর্মসভাভুক্ত। তাই, ১৮২১ সালের ২৩ এপ্রিলের সভায় এই ‘হিন্দু’ অধ্যক্ষেরা ডিরোজ়িয়োকে পদচ্যুত করেন। বিরোধী স্বর সে সভায় একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। এই ভাবেই কলকাতায় জাত, প্রয়াত ও সেই সমাজের জন্যই জাগ্রত বিবেককে থামিয়ে, দমিয়ে স্বস্তি পেতে চেয়েছিলেন সমাজপতিরা। সেই ছকে একই চেষ্টা আজও অব্যাহত। চরিত্র শুধু আলাদা।
মানস দেব
কলকাতা-৩৬
হৈমন্তীতে কবি
পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের ‘স্ট্রবেরি দিয়ে মুগের ডাল’ (রবিবাসরীয়, ২-১) প্রবন্ধে উল্লিখিত ‘হৈমন্তী’ বাড়িতে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথের অন্যতম দুই সঙ্গী অতুলপ্রসাদ সেন ও অ্যান্ড্রুজ়ের প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।
‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর’ গানটি ‘হৈমন্তী’তে থাকার সময় কবি রচনা করেছিলেন এ কথা ঠিক। তবে তার পরিবেশ এবং প্রেক্ষাপট সম্পর্কে রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’-র সঙ্গে রামগড়ে কবির সঙ্গে থাকা অতুলপ্রসাদের নিজস্ব বর্ণনার যথেষ্ট পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়। অতুলপ্রসাদ লিখেছেন, “সেবার রামগড়ে কবির গান রচনার একটি স্বর্গীয় দৃশ্য দেখিলাম। তিনি যে ঘরে শুইতেন, আমার শয্যা সেই ঘরেই ছিল। আমি লক্ষ্য করিতাম, তিনি প্রত্যহ ভোর না হইতেই জাগিতেন এবং সূর্য্যোদয়ের পূর্বেই তিনি বাটির বাহির হইয়া যাইতেন। একদিন আমার কৌতুহল হইল। আমিও তাঁহার অলক্ষিতে তাঁহার পিছু পিছু গেলাম। আমি একটি বৃহৎ প্রস্তরের অন্তরালে নিজেকে লুকাইয়া তাঁহাকে দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তিনি একটি সমতল শিলার উপর উপবেশন করিলেন। যেখানে বসিলেন তার দুদিকে প্রস্ফুটিত সুন্দর শৈলকুসুম। তাঁর সম্মুখে অনন্ত আকাশ এবং হিমালয়ের তুঙ্গ গিরিশ্রেণী। তুষারমালা বালরবি-কিরণে লোহিতাভ। কবি আকাশ ও হিমগিরির পানে অনিমেষ তাকাইয়া আছেন। তাঁর প্রশান্ত ও সুন্দর মুখমণ্ডল ঊষার মৃদু আভায় শান্তোজ্জ্বল। তিনি গুণ গুণ করিয়া তন্ময় চিত্তে গান রচনা করিতেছেন— ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর’।” (‘আমার কয়েকটি রবীন্দ্র স্মৃতি’, উত্তরা, বৈশাখ ১৩২৮, পৃ ৪৫৯)। এ ভাবে প্রায় প্রতি দিন ভোরবেলা অতুলপ্রসাদ কবির পিছু পিছু যেতেন এবং লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর গান রচনা শুনতেন। এক দিন ধরা পড়ে পালানোর চেষ্টা করলেন। অতুলপ্রসাদ লিখছেন, “তিনি ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘অতুল, এখানে এত ভোরে যে? কোথায় ছুটে যাচ্ছ?’ আমি দেখিলাম ধরা পড়িয়াছি, আর উপায় নাই। বলিলাম, ‘লুকিয়ে আপনার গান শুনছিলাম।’ তার দু’তিনদিন পরে তিনি যখন আমাদের শুনাইলেন— ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর’। আমি বলিলাম— ‘ওই গানটি আমি পূর্বেও শুনেছি’। তিনি বলিলেন, ‘পূর্বে কি করে শুনলে? আমি ত মাত্র দু’তিন দিন হ’ল ওই গানটি রচনা করেছি।’ আমি বলিলাম, ‘রচনা করবার সময়েই শুনেছিলাম।’ কবি বলিলেন,— ‘তুমি ত ভারি দুষ্টু, এই রকম করে রোজ শুনতে বুঝি?’ আমরা সকলেই খুব হাসিলাম।”
‘হৈমন্তী’তে থাকার সময় কবির শিশুসুলভ আচরণ অতুলপ্রসাদের বড় ভাল লাগত। এক দিন সবাই বাড়ির বাইরে বসে চায়ের সঙ্গে নানা রকম সুখাদ্য খেতে ব্যস্ত। অতুলও তাতে ভাগ বসিয়েছেন। হঠাৎ কবির আদেশ হল। “অতুল এস” বলে প্রায় টানতে টানতে হাত ধরে নিয়ে গেলেন। অতুলও আগ্রহের সঙ্গে গেলেন। অনতিদূরে গিয়ে কবি দেখালেন, পরম রমণীয় পত্র-পুষ্প শোভিত এক নির্জন স্থান। আর বললেন, “আমি রোজ এখানে আসি, এখানে বসি, গান গাই এবং গান রচনাও করি। তুমি শুনবে?” অতুল বলামাত্র পর পর কয়েকটি গান কবি শুনিয়ে দিলেন। তার পর দু’জনে ফিরে এলে কবি কন্যা বললেন, “বাবা, তোমার যে কাণ্ড, অতুল বাবুকে না খাইয়ে কোথায় এতক্ষণ ধরে রেখেছিলে?” কবির উত্তর, “অতুলকে জিজ্ঞাসা কর্।” অতুল বললেন, “আমি সেখানে খুব ভাল ভাল জিনিস খেয়ে এসেছি। আমার আর খিদে নেই।”
‘হৈমন্তী’তে থাকার সময় কবির আর এক সঙ্গী অ্যান্ড্রুজ় সম্পর্কেও বেশ মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন অতুলপ্রসাদ। এক দিন বিকেলে বর্ষা নামল প্রবল বেগে। চলল সারা রাত। কবি একের পর এক তাঁর বর্ষার গান গেয়ে চলেছেন, সঙ্গে কবিতা পাঠও। সে এক অপরূপ পরিবেশ। সে আসরে এ বার কবির আদেশ হল, “অতুল তোমাদের দেশের একটা হিন্দি গান গাওত হে।” অতুল গাইলেন, “মহারাজা কেওরিয়া খোলো, রসকি বুঁদ পড়ে।” সঙ্গে কবি ও সকলে এক সঙ্গে গেয়ে চললেন। সকলেই বর্ষার মোহে আচ্ছন্ন। সঙ্গীতে অজ্ঞ অ্যান্ড্রুজ়কেও ওই গানের ছোঁয়াচে ধরল। তিনি অদ্ভুত উচ্চারণ করে এবং বেসুরো কণ্ঠে সকলের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে গেয়ে চললেন ‘মহারাজ কেওড়িয়া খোলো’। তাঁর সঙ্গীতের আকস্মিক উচ্ছ্বাস রোধ করা দুই কবি-গায়কের কাছে সে দিন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
অমরনাথ করণ, কলকাতা-১৩৫
নোয়াকাহিনি
লোহার তৈরি বালা। কেউ বলেন ‘নোয়া’, কারও কাছে ‘লোহা’। হিন্দু মহিলাদের মাঙ্গলিক প্রতীক। বিবাহকালে মহিলাদের নানা দিনে নোয়া পরিয়ে দেওয়ার চল আছে। আইবুড়ো ভাতে এক রকম, শাঁখা পরার সময় আর এক, গায়ে-হলুদে এক রকম ও বৌভাতে আর এক।
কমপক্ষে ২৫-৩০ রকমের ডিজ়াইন করা নোয়া দেখা যায়। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘নোয়া’র নামও ভিন্ন হতে দেখা যায়— সাত পাকে বাঁধা, রাশি, স্বয়ংসিদ্ধা, কেয়া পাতার নৌকো, টাপুর টুপুর ইত্যাদি। লোহার তৈরি নোয়ার ব্যবহার ক্রমশ কমছে। এখন মহিলারা কেউ পরেন পিতল, কেউ রুপো, আবার কেউ সোনার নোয়া। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের গজা গ্ৰামের নোয়া শিল্পের ছিল খুব নামডাক। গজার নোয়া যেত অসম, বিহার, রাজস্থান, তৎকালীন ইলাহাবাদ ও ওড়িশার বিভিন্ন স্থানে। নোয়া শিল্পীরা আজ সঙ্কটে।
দীপংকর মান্না, আমতা, হাওড়া