‘বিয়ে আর ১৮-য় নয়’ (১৭-১২) শীর্ষক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দু’চারটি কথা বলতে চাই। পাণ্ডুয়ায় অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীর দুরবস্থা দেখে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখ জল কিংবা ১৩ বছরে সন্তানের জন্ম দেওয়া ছাত্রী ও নবজাতকের ক্যানিং হাসপাতালে জীবন-মরণ লড়াই অথবা হিঙ্গলগঞ্জে নাবালিকা বিয়ে আটকানোর কারণে প্রধান শিক্ষককে হুমকি— এই জাতীয় খবর এই ডিসেম্বরেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। কিন্তু ১৮ বছরটাকে ২১ বছর করা হলে আরও বাড়তি তিন বছর মেয়েদের ‘বসিয়ে বসিয়ে’ খাওয়াবেন তো অভিভাবকরা? ১৮ বছর বয়সের আগে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের ‘ইনসেনটিভ’-এর তোয়াক্কা না করেই যে অভিভাবকরা মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে পারেন এবং ধরা পড়লে আইন জানা ছিল না বলে অজুহাত খাড়া করেন, তাঁরা আর যা-ই হোক মেয়েদের আরও তিনটি বছর সহজেই টেনে নিয়ে যাবেন— এমন ধারণা বাতুলতা মাত্র। কল্যাণমুখী সরকারি প্রকল্প যতই চালু করা হোক না কেন, সামগ্রিক ভাবে সমাজের মানসিকতা বদলানো সবচেয়ে জরুরি। আমাদের সমাজে তথাকথিত শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের মেয়েরাও এখনও সন্তান হিসাবে নয়, মেয়ে হয়েই বেঁচে আছেন। তাই তো আমার এক সহকর্মী তাঁর মেয়েকে শত আবদার সত্ত্বেও কিছুতেই গান শেখার সুযোগ করে দেননি। কারণ, সে তো ‘পরের ঘরে’ গিয়ে গান শোনাবে। অন্য দিকে, নিজের ছেলেটিকে ব্যয়বহুল স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন ও অনেক ক্ষেত্রে সাধ্যের বাইরে গিয়েও ছেলের দাবি মিটিয়েছেন। আজ তিনি সেই সুপ্রতিষ্ঠিত প্রবাসী পুত্রের ফোন পর্যন্ত পান না। অথচ, স্কুলশিক্ষিকা মেয়ের সেবাযত্নে বৃদ্ধ বয়সে আরও ভাল ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন।
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নির্বিশেষে ছেলেদের বংশ রক্ষাকারী ও মেয়েদের শুধুমাত্র ‘মেয়ে’ হিসাবে ভাবা যত দিন না বন্ধ হবে, তত দিন কোনও আইন বা সরকারি প্রকল্পের আর্থিক সাহায্য নাবালিকা বিয়ে পুরোপুরি আটকাতে সফল হবে না। তাই বিভিন্ন ভাবে ঘটে যাওয়া নাবালিকা বিয়ে ঠেকাতে কল্যাণমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে এই সব বিয়ের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার।
তন্ময় মণ্ডল
গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
সচেতনতা চাই
‘বিয়ে আর ১৮-য় নয়’ সংবাদটি খুবই আশাব্যঞ্জক। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করতে শীঘ্রই সংসদে বিল পাশ করানো হবে। বর্তমানে মেয়েদের বিয়ের বয়স আইনত ১৮ বছর থাকলেও, সেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই রাজ্য-সহ সারা দেশে লুকিয়ে দেদার ১৮-অনুত্তীর্ণদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর জন্য অশিক্ষা অনেকাংশে দায়ী। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ২০২০ পর্যন্ত ভারতে নাবালিকা বিয়ে হয়েছে ১৪ কোটি, যা বিশ্বের নাবালিকা বিয়ের ৪০ শতাংশ বলে দাবি করেছে সমীক্ষাটি। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে ভারতের গ্রামে ৪৭ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ১৮ বছর পূর্ণ করার আগেই। অর্থাৎ, শুধু আইন দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নাবালিকা বিয়ে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই নতুন আইন মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে আটকাতে একটা রক্ষাকবচ হলেও, তা যথেষ্ট নয়। আইনের পাশাপাশি কম বয়সে বিয়ের কুফলগুলো সম্পর্কে সমাজকে সচেতনতার পাঠ দিতে হবে।
সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। বাল্যবিবাহের জন্য অশিক্ষা, কুসংস্কার যেমন দায়ী, তেমনই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও সমান দায়ী। কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা গরিব পরিবারগুলোতে বেশি দেখা যায়। এই অবস্থা দূর করতে সরকারের উচিত গরিব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করা, বিনা খরচে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। না হলে আইন শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকবে।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল
কোন্নগর, হুগলি
মেয়েদের সুযোগ
মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ২১ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বিল আনছে— এই খবরটি পড়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলাম। মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার এই অধিকার আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে ভোটের মাধ্যমে দিইনি। বিয়ে ও সংসার যাত্রায় স্বামীর বয়স স্ত্রী’র তুলনায় কিছুটা বেশি হলেই ভাল হয়। শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রাক্তন সমতা পার্টির নেত্রী জয়া জেটলির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে ব্যাপারটি নিয়ে অনুসন্ধান করে তাঁর পরামর্শমতো এই বিল আনতে চলেছে। কথা হচ্ছে, কমিটিতে যে ক’জন ছিলেন, তাঁরা কি দেশের জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারেন? গণমত নেওয়ার কী প্রক্রিয়া এই কমিটি নিয়েছিল? যদি কিছু নিয়ে থাকে, তা কি গণ পরিসরে আছে? আদালতের উচিত ‘সুয়ো মোটু কগনিজ্যান্স’ নিয়ে সরকারকে অবিলম্বে বিলটি প্রত্যাহার করতে বলা এবং সমস্ত তথ্য কোর্ট ও গণ পরিসরে রেখে জনগণের মতামতের জন্য আলোচনার পথ খোলা।
বহু শতাব্দী ধরে ১৬ বছরকে মেয়েদের ঠিক বয়স বলে মানা হত। বর্তমানে এটি ১৮ বছর করার প্রধান কারণ, জনসংখ্যা হ্রাসের চেষ্টা করা। এ ছাড়াও কিশোরীদের শারীরিক গঠনের পূর্ণতাপ্রাপ্তির বিষয়টিও রয়েছে। না হলে মেডিক্যাল দিক থেকে বয়স ১৮ থেকে ২১ করার কোন সুযুক্তি নেই। মেয়েরা ভোট দেবেন আঠারোয়, আর সংসার করতে পারবেন না, এটা ভাবা বাড়াবাড়ি। উল্টো দিক থেকে চিন্তা করলে, বিয়ের বয়স পড়াশোনা ও কর্মপ্রাপ্তির সঙ্গে জুড়ে যাওয়ায় এখন কেরিয়ারিস্ট মেয়েদের ৩০-৩২ বছরে বিয়ে হচ্ছে। এঁদের অনেকেরই সন্তানধারণের সমস্যা হচ্ছে। স্বাভাবিক প্রসব প্রায় নেই। সব সি-সেকশন। সন্তানগুলিও দুর্বল হচ্ছে, এমন মতামত অনেকের।
মেয়েদের কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে আলাদা ভাবে বিচার করা উচিত। জীবনে তাঁদের পছন্দমতো প্রজননকাল অন্তত সাত-আট বছরের রেখে তাঁদের পুরুষদের সমান কাজের মেয়াদের সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ, মেয়েদের এই প্রজননকাল ছাড়াও পড়াশোনা বাদে ৩৫ বছর কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কেউ ১৮ বছরে বিয়ে করে সাত বছর প্রজননকাল কাটিয়ে আরও দশ বছর পড়াশোনা করে চাকরি করতে চাইলে, তাঁকে ৩২ বছরের কর্মজীবন দিতে হবে। তিনি ৬৭ বছরে অবসর গ্রহণ করবেন। এই সব ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনা দরকার। ‘বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর’কে রাজনৈতিক সমাধান দিয়ে চাপা দেওয়া উচিত নয়।
তুষারকান্তি চৌধুরী
উত্তরপাড়া, হুগলি
বোঝা নয়
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ২১ বছর করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত। ১৮ বছর বয়সে মেয়েরা সবে স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করে। ২১ বছরে বিবাহযোগ্য হলে তারা উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাবে। শিক্ষা এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মানসিক দৃঢ়তা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তবে শুধুমাত্র আইন করে বিয়ের বয়স বাড়ালেই যে মেয়েরা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে, তা মনে হয় না। এখনও অধিকাংশ মেয়ের অভিভাবকদের কাছে মেয়েদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গুরুত্বহীন। আর ১৮ বছরেই মেয়েদের বিবাহযোগ্য হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছেন ক’জন অভিভাবক? বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। লকডাউনের সময় স্কুল বন্ধ থাকায় তা ক্রমবর্ধমান। তাই নাবালিকা বিয়ে রুখতে পরিবারকে সচেতন করতে হবে, জোর দিতে হবে মেয়েদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার উপর, যাতে কেউ তাদের বোঝা মনে না করেন।
ডলি আচার্য
শান্তিপুর, নদিয়া