স্বাতী ঘোষের লেখা ‘যে পথ যেত পশ্চিমে’ (১০-১) পড়ে হুড়মুড় করে অনেক কথাই মনে এল। যখন ছোট ছিলাম তখন এক বিশেষ পত্রিকা বাড়িতে আসতে দেখতাম। সেই সময় সেটি ছিল সাপ্তাহিক, এখন হয়ে গিয়েছে পাক্ষিক। সেই সাপ্তাহিক যুগের পত্রিকাটির এক প্রচ্ছদের কথা মনে পড়ল লেখাটি পড়ে— এক প্রৌঢ়ের হাঁটু পর্যন্ত উলের মোজা, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ, হাতে জলের চৌকো বোতল, সামনে কুলির মাথায় বেডিং-হোল্ড অল। সব নিয়ে তিনি চলেছেন হাওয়া বদল করতে পশ্চিমে। আর তখন পশ্চিম অর্থে উঁচু-নিচু জমি, টিলা, ফাঁকা বিস্তৃত মাঠ, শাল-মহুয়ার জঙ্গল, কুয়োর জল, আতা-পেয়ারা-আমের বাগান, ত্রিকূট পাহাড়, নদী-জলপ্রপাত— ঘাটশিলা থেকে শুরু করে যত দূর পশ্চিমে যাওয়া যায়। জমির তো অভাব ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘জাপানি বোমা কলকাতায় এই পড়ল বলে’— স্রেফ সেই ভয়ে সেকালের সম্পন্ন বাঙালি জলের দরে জমি কিনে ওখানে বাড়ি বানিয়ে রেখে দেন। সেই বাঙালিরা সেখানকার বাজারে কলকাতার তুলনায় অনেক সস্তায় আনাজ পেয়ে ‘ড্যামচিপ’ বলার সূত্রে ‘ড্যাঞ্চি বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, লীলা মজুমদার, সুবোধ ঘোষ, বিমল কর, বুদ্ধদেব গুহ প্রমুখের লেখায় পশ্চিমের স্মৃতি আজও অমর। এমনকি পশ্চিম থেকে রেলগাড়িতে চাপিয়ে কুয়োর জল পর্যন্ত কলকাতায় নিয়মিত আনা হত পেটরোগা বাঙালিদের জন্য।
পরে ধীরে ধীরে বাংলা সন্নিহিত রাজ্যগুলোয় শিক্ষার প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে মানুষের জীবনযাপনে প্রভূত পরিবর্তন ঘটে। নতুন পর্যটনের স্থান গড়ে ওঠার ফলে ভ্রমণপিপাসু বাঙালির কাছে ক্রমশ গুরুত্ব হারাতে থাকে পশ্চিমের এই জায়গাগুলি। আজ বাঙালির হাওয়া বদলের জায়গাগুলোও চেহারায় আর চরিত্রে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তবু মনের কোণে পুরনো পশ্চিমের স্মৃতিগুলি এখনও আঁকড়ে রেখেছেন কয়েক জন পুরনো মানুষ। তাঁদের কাছে সেগুলি আজও বড় দামি।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
অলসযাপন
স্বাতী ঘোষের প্রবন্ধ পড়ে মনে কত স্মৃতি ভেসে উঠল। সাঁওতাল পরগনা বা ছোটনাগপুর অঞ্চল এক সময় বাঙালিদের দ্বিতীয় আবাসভূমি বা স্থায়ী বেড়ানোর জায়গা ছিল। শিমুলতলা, মধুপুর, দেওঘর, রাজগির, গিরিডি— এই সব এলাকার বাঙালিদের পুরনো বাড়িগুলি আজও তার সাক্ষী। বাংলা সাহিত্যেও ‘পশ্চিম’-এ বেড়াতে যাওয়ার অজস্র কাহিনি আছে।
প্রায় সাড়ে চার দশক আগে, তখন কলেজে, পুজোয় গিয়েছিলাম দেওঘরে। পাঁচিলঘেরা যে একতলা বাড়িতে আমরা ছিলাম, তার চার পাশে ছিল আম-জাম-অর্জুনের ঘন ছায়া। বাড়ির পাশেই এক গভীর কুয়ো, যার মিষ্টি জল ছিল ক্ষুধা উদ্রেককারী। পরে, নব্বইয়ের দশকে অফিসে ছুটি ম্যানেজ করে ছিলাম অফিসের হলিডে হোমে। পাহাড়ের কোলে, ব্যানার্জি পাড়ায়, রাজগিরে। কাছেই হোটেলগুলো ছিল বাঙালি পর্যটক ভর্তি। আবার এমনও হয়েছে ছুটি বাঁচাতে শনিবার ভোরের ট্রেন ধরে ঘাটশিলা গিয়ে সুবর্ণরেখা নদী, বুরুডিহি ড্যাম, টাটানগরের ডিমনা লেক ছুঁয়ে রবিবার বিকেলের ট্রেনে বাড়ি ফিরেছি। ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে বহু স্থান ঘুরেছি বটে, কিন্তু ‘পশ্চিম’-এর ওই অলসযাপন আজও ভুলিনি।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
পশ্চিমের ছবি
স্বাতী ঘোষের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। পত্রলেখকের সেই অর্থে পশ্চিমে যাওয়া হয়নি, তবে এক সময় পিতৃদেব সপরিবারে দেওঘরে যেতেন। সে গল্প শুনে পশ্চিমের একটা ছবি মনে তৈরি হয়েছিল। পরে সত্যজিতের হাত ধরে প্রফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার পড়ার সময় গিরিডি ও উশ্রী নদীর সঙ্গে পরিচয় হয়। সে পরিচয় আরও গভীর হয় বুদ্ধদেব গুহর হাত ধরে। বাঙালির কাছে এই পশ্চিম কেন অতীত হয়ে গেল, সে বিষয়ে প্রবন্ধকার যে কারণগুলি দেখিয়েছেন তার প্রত্যেকটি যথাযথ। তবে মনে হয় একান্নবর্তী পরিবারগুলি ভেঙে একান্তবর্তী হয়ে যাওয়া প্রধান কারণ। আর একটি কারণ, এই জায়গাগুলির প্রতি ট্রাভেল এজেন্সিগুলির উদাসীনতা। তারা সারা বছর দেশ ও বিদেশের নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বিহার-ঝাড়খণ্ডের এই জায়গাগুলির কথা ভাবে না। ফলে এই সব জায়গা তাদের গুরুত্ব হারিয়েছে। একমাত্র রাঁচী ব্যতিক্রম নতুন রাজ্যের রাজধানী হওয়ার সুবাদে।
অঞ্জন মজুমদার, কলকাতা-৮৪
অপূর্ণ দাবি
‘পেনশনে দাবি’ (১১-১) শীর্ষক খবরে প্রকাশ, ইপিএস-৯৫ ন্যাশনাল অ্যাজিটেশন কমিটি (এনএসি) অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের কাছে বর্তমানের ন্যূনতম পেনশন ১০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০০ টাকা করার সঙ্গে মহার্ঘভাতা ও চিকিৎসা খরচের সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। ক’দিন আগেই প্রাক্-বাজেট আলোচনায় দেশের বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়ন একযোগে অর্থমন্ত্রীর কাছে ইপিএস-৯৫ পেনশন প্রাপকদের ন্যূনতম ১০০০ টাকা পেনশনের অঙ্ক বাড়িয়ে ন্যূনতম ৯০০০ টাকা করার দাবি জানায়। ইপিএস-৯৫ পেনশন স্কিমের আওতায় থাকা অবসরপ্রাপ্ত আনুমানিক সত্তর লক্ষ প্রবীণ নাগরিকের জন্য ২০১৬ সালে ন্যূনতম পেনশন ধার্য করা হয়েছিল ১০০০ টাকা। এই সামান্য অর্থে কী ভাবে এক জন প্রবীণ মানুষ এই ভয়ঙ্কর মূল্যস্ফীতির কালে সম্মানের সঙ্গে তাঁর পরিবার নিয়ে দৈনন্দিন খরচ তথা জরুরি চিকিৎসা-ব্যয় নির্বাহ করবে, তা কোনও দিনই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারকরা ভাবেননি।
গত কয়েক বছর ধরে প্রত্যেকটা সংসদ অধিবেশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক সাংসদ ন্যূনতম পেনশনের অঙ্ক বাড়ানোর দাবি নিয়মিত জানিয়ে আসা সত্ত্বেও সরকার, শ্রম মন্ত্রক, এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজ়েশন— সবাই নীরব নির্বিকার উদাসীন। কখনও কখনও দাবির চাপে কৌশল করে এক-আধটা কমিটি গঠিত হয়, এ বিষয়ে সব দিক খতিয়ে দেখে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করার জন্য। এ সব যে কালক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা এত দিনে পেনশন প্রাপকরা বুঝে ফেলেছেন। অতীতে এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন কমিটি তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করার পরেও ন্যূনতম পেনশন ২০০০-৩০০০ টাকা হয়নি। এনএসি গত বছরগুলিতে মহারাষ্ট্র-সহ দেশের সর্বত্র এই দাবিতে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সংগঠন প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে একাধিক বার সাক্ষাৎ করে তাঁর হাতে দাবিপত্র দিয়ে আসে। তবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস নিয়ে ফিরে আসার পরেও এখনও অবস্থার পরিবর্তন হল না। এ দিকে এই পেনশন প্রকল্পের অধীনে থাকা যাঁরা আইনি লড়াই করে পুরো বেতনের উপর বর্ধিত পেনশন দাবি করেছিলেন, এ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায়কে নানা ভাবে অপব্যাখ্যা করে এক বৃহৎ সংখ্যক যোগ্য প্রাপককে বঞ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে ইপিএফও-র বিরুদ্ধে।
ন্যায়বিচার চেয়ে ক’জন মানুষ পারেন এই ব্যয়বহুল সময়সাপেক্ষ আইনি লড়াই চালাতে? আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে ইপিএফও। যেখানে ক্ষমতা দখলের জন্য নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে দেশের করদাতাদের টাকায় শাসক বিরোধী নির্বিশেষে ঢালাও অনুদান ঘোষণা করে দেশের অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তোলেন, সেখানে দেশগঠনের কাজে একদা যোগ দেওয়া বর্তমানে অশক্ত মানুষগুলো যাতে শেষ জীবনে ভাল থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করতে আদৌ আগ্রহী কি সরকার? তবুও আগামী বাজেটে সরকারের পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আশায় দিন গুনছেন দেশের অসংখ্য ইপিএস-৯৫ পেনশনাররা।
দেবকী রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, উত্তরপাড়া, হুগলি