AI and Privacy

পণ্য হল যা কিছু আজ...

‘প্রাইভেসি’ আর ‘গোপনীয়তা’র দ্যোতনায় অবশ্য অনস্বীকার্য ফারাক আছে। গোপন কথাটি গোপনে রাখাই কি প্রাইভেসি? না কি, নিজেকে গোপন রাখা?

Advertisement
অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৩

৯৮ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন প্রাক্তন বিচারপতি কে এস পুত্তস্বামী। ভারতীয় গণতন্ত্র অবশ্য তাঁকে প্রধানত মনে রাখবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদী হিসাবে। ইউপিএ সরকারের আধার প্রকল্প নাগরিকদের প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন বিচারপতি পুত্তস্বামী। ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতি জে এস খেহারের নেতৃত্বাধীন নয় সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই মামলার রায়ে জারি রাখে আধার প্রকল্পকে, কিন্তু ‘ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা’কে স্বীকৃতি দেয় এক মৌলিক অধিকার হিসাবে।

Advertisement

‘প্রাইভেসি’ আর ‘গোপনীয়তা’র দ্যোতনায় অবশ্য অনস্বীকার্য ফারাক আছে। গোপন কথাটি গোপনে রাখাই কি প্রাইভেসি? না কি, নিজেকে গোপন রাখা? কিন্তু, বহু জনের মাঝেও তো সম্ভব প্রাইভেসি বজায় থাকা। তাই প্রাইভেসি বোধ হয় শুধুমাত্র গোপনীয়তা নয়। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস যেমন বলেছিলেন যে, সব মানুষের রয়েছে তিনটি জীবন: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত এবং গোপন— ওই মাঝেরটাই কি তা হলে প্রাইভেসি? ‘ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা’— প্রাইভেসির বাংলা করতে গেলে সম্ভবত এই বাক্যবন্ধটিই ভরসা।

১৮৯০ সালে হার্ভার্ড ল রিভিউ-তে একটি প্রবন্ধ লেখেন স্যামুয়েল ওয়ারেন ও লুই ব্র্যান্ডেইস, শিরোনাম: ‘দ্য রাইট টু প্রাইভেসি’। তাঁদের ধারণায় প্রাইভেসির কাঠামো মূলত দাঁড়িয়ে আছে ‘একান্তে থাকার অধিকার’-এর উপরে। ১৯১৬-৩৯, এই সময়সীমায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের সহযোগী বিচারপতি ছিলেন ব্র্যান্ডেইস। ওলম্‌স্টিড বনাম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৮-এর এই বিখ্যাত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ‘একান্তে থাকার অধিকার’-কে ব্র্যান্ডেইস বর্ণনা করেছিলেন ‘সবচেয়ে ব্যাপক অধিকার, এবং সভ্য মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান অধিকার’ হিসাবে। তার সওয়াশো বছর পরে, ২০১৯ সালে, নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রযুক্তিবিষয়ক কলাম লেখক ব্রায়ান চেন নিরাপত্তা-বিষয়ক গবেষকদের কাছে জানতে চান, শুধুমাত্র তাঁর ফোন নম্বর থেকে কোন কোন তথ্য জানা সম্ভব তাঁর সম্পর্কে। দেখা গেল, একটা ফোন নম্বরই মন্থন করতে পারে অভাবনীয় তথ্যভান্ডার।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও থাবা বসিয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তায়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর নিবন্ধকার জোয়ানা স্টার্ন যেমন ২০২৩-এ এক লেখায় বর্ণনা করেছেন, কী ভাবে তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর এআই-প্রতিরূপ— রূপে এবং কণ্ঠস্বরে অবিকল তাঁরই মতো, যা ধোঁকা দেয় তাঁর ব্যাঙ্ককে, এমনকি তাঁর পরিবারকেও। ২০২০-র বই প্রাইভেসি ইজ় পাওয়ার-এ ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড-এর ক্যারিসা ভেলিজ় দেখিয়েছেন, প্রযুক্তি সংস্থাগুলি কী ভাবে আমাদের অবস্থান, পছন্দ, অভ্যাস, সম্পর্ক, উদ্বেগ, এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ করে চলেছে আমাদের অজ্ঞাতসারে, সম্মতি ছাড়াই। এবং সেই তথ্যের সঙ্গে তারা বিক্রি করছে আমাদের, আমাদের যোগাযোগের লোকজনের, এবং আমাদের সহ-নাগরিকদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও। ভেলিজ় বলছেন, প্রাইভেসি তাই আর শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তা সমষ্টিগত।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও প্রথাগত প্রাইভেসির ধ্যানধারণার চলেছে নিয়ত সংঘাত। আসলে আজকের দুনিয়ায় নাগরিকদের কল্যাণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সুনিশ্চিত করতে নাগরিকদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতেই হয় রাষ্ট্রকে। কিন্তু কোথায় যে লক্ষ্মণরেখা, ঠিক কোন সীমারেখা ছাড়িয়ে নাগরিকের গোপন বিজন ঘরে রাষ্ট্রের উঁকিঝুঁকি দেওয়া অনভিপ্রেত, তা অনেক ক্ষেত্রেই ভীষণ অস্পষ্ট, ধূসর। দেশভেদে, সমাজভেদে, কালভেদে, এবং অবশ্যই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্গে তা বদলে যায়। নিরন্তর তাই চলে বিতর্ক, পুনঃসংজ্ঞায়িত হতে থাকে প্রাইভেসি এবং রাষ্ট্রের অধিকারের সীমারেখা।

কিন্তু, আমরা কি আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি আর অর্থসংক্রান্ত বিষয়ের ‘নিরাপত্তা’কেই ‘প্রাইভেসি’ বলে ভুল করে চলি? এগুলি অবশ্যই এক নয়, আংশিক সমাপতন সত্ত্বেও। আসলে তথ্য সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা, আর তা প্রাইভেসির একটি অংশমাত্র। অথবা, আমরা মুখে যতটা বলি, সত্যিই কি ততটা মূল্য দিই আমাদের প্রাইভেসিকে? যদি দিতাম, তা হলে কী ভাবে আমাদের জীবনকে সোশ্যাল মিডিয়ার হাটে উন্মুক্ত করি প্রতি দিন? কী ভাবে সর্বত্র দিই আমাদের ফোন নম্বর? একেই বলে ‘প্রাইভেসি প্যারাডক্স’।

পিটার ওয়্যারের ১৯৯৮-এর চলচ্চিত্র দ্য ট্রুম্যান শো-তে ট্রুম্যান বারব্যাঙ্কের বাস সিহ্যাভেন নামে এক বানিয়ে-তোলা শহরে, ৫০০০ ক্যামেরার আওতায় জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই একটা রিয়ালিটি শো-র উপজীব্য— তার সম্পূর্ণ অজানতেই। সিহ্যাভেনের বাকি সকলেই কিন্তু অভিনেতা, এবং তারা সবাই জানে এই রিয়ালিটি শোয়ের কথা। ৩০ বছর বয়সে যে মুহূর্তে ট্রুম্যান জানতে পারল তার এই বন্দি জীবনের কথা, সে ফেটে পড়ে বিদ্রোহে। আর আমরাও চট করে উপলব্ধি করি যে, ‘প্রাইভেসি’ কোনও বানিয়ে তোলা ধারণা নয়, তা সত্যিই আমাদের অন্তস্তলে প্রোথিত এক আকাঙ্ক্ষা, যা সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে মানুষের মজ্জায়। আজন্ম। জাস্টিস ব্র্যান্ডেইস কিংবা জাস্টিস পুত্তস্বামীরা তার রূপ নির্মাণের চেষ্টা করে চলেন তাঁদের ভূগোলের চৌহদ্দিতে, তাঁদের সময়কালে।

আরও পড়ুন
Advertisement