রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরে-বাইরে (প্রকাশ ১৯১৬) উপন্যাসে প্রধান চরিত্র নিখিলেশ তার আত্মকথনে বলছে, “আমি যে এই ঘরের কর্তা এটা বানানো জিনিস, সত্য এই যে, আমি জীবনপথের পথিক। ঘরের কর্তার তাই বারে বারে ঘা লাগবে, তার পরে শেষ আঘাত আছে মৃত্যু। তোমার সঙ্গে আমার যে মিলন সে মিলন চলার সুখে; যতদূর পর্যন্ত এক পথে চলা গেল তত দিন পর্যন্তই ভাল, তার চেয়ে বেশি টানাটানি করতে গেলেই মিলন হবে বাঁধন।” পৌরুষের এক বিশেষ দিক নিখিলেশ। সন্দীপের দাম্ভিকতার সামনে নিখিলেশকে যেন কিছু সময় ম্রিয়মাণ মনে হয়। নিখিলেশের স্ত্রী বিমলা এক সময় সন্দীপের প্রেমে পড়ে। কিন্তু বিমলার যে আত্মোপলব্ধি হয় তাতে যেন নিখিলেশের প্রতি তার সম্মান অনেক গুণ বাড়ে। আদর্শ পুরুষ বলে যদি কিছু থাকে, কোনও সংজ্ঞা— তা আর যা-ই হোক একরৈখিক কখনও হতে পারে না।
আজ চার দিকে পুরুষাধিকারের যে আলোচনা শুরু হয়েছে সে ক্ষেত্রে এই মূল কথাটা ভুলে গেলে চলবে না। রাষ্ট্রপুঞ্জ এখনও অবধি স্বীকৃতি না দিলেও ১৯ নভেম্বর দিনটিতে বিশ্ব জুড়ে ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস’ বলে উদ্যাপিত হচ্ছে দু’দশক ধরে। অধ্যাপক টমাস ওয়েস্টার (মিজ়ৌরি সেন্টার ফর মেন’স স্টাডিজ়-এর ডিরেক্টর) ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ প্রথম পুরুষ দিবস চালু করেন। ১৯৯৯ সালে ত্রিনিদাদ-টোবাগোর ইতিহাসের অধ্যাপক জেরোম তিলক সিংহ নতুন করে এই দিবস চালু করেন।
প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস (৮ মার্চ) পালনের ধুয়ো তুলেই কি পুরুষ দিবস পালনের উদ্যোগ? বেশির ভাগ দেশ আজও পুরুষতান্ত্রিক। সমাজের সব ক্ষেত্রে পুরুষের সুযোগ বেশি তো বটেই, ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠত্ব’ তত্ত্বও বাহিত হচ্ছে নানা ধরনের সংস্কৃতিতে। পুরুষ দিবস কি পুরুষের প্রাধান্যকেই উদ্যাপন করবে না? পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের আবার কিসের লড়াই?
ভারতে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলনে পুরুষের ভূমিকা ছিল অগ্রণীর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে অন্তঃপুর থেকে বার করে নিজের কর্মস্থল বোম্বাইতে নিয়ে গিয়েছিলেন, দুর্গামোহন দাস মেয়েকে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন মাদ্রাজে, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বামী দ্বারকানাথ শুধু যে স্ত্রীর পড়াশোনাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন তা নয়, তাঁর অবলাবান্ধব পত্রিকাকে মনে করা হয় বিশ্বের প্রথম পত্রিকা যা কেবল নারী-স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। এ-দেশে বহু পুরুষ সমাজে নারীর সমানাধিকার আদায়ের আন্দোলনে আগ্রহী। সাম্প্রতিক আর জি কর কাণ্ডে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে রাত দখল অভিযানে মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষরাও সমান তালে রাস্তায় থেকেছেন।
তা সত্ত্বেও পুরুষের অস্তিত্বের সঙ্গে শিশ্ন-প্রাধান্যকে অবলীলায় জুড়ে দেওয়া হচ্ছে আজও। টেস্টোস্টেরন-ঋদ্ধ, শিশ্ন-পরাক্রমী যুবকই যে শ্রেষ্ঠ মানব, তা ইতিহাসে, সাহিত্যে, সিনেমায় বার বার দেখানো হচ্ছে। আগে রাজা-জমিদার আর এখন রাজনীতিবিদ-অভিনেতা-খেলোয়াড়রা আদর্শ পুরুষের ‘রোল মডেল’-এ পরিণত। পুরুষ দিবস পৌরুষের এক বিকল্প তৈরির কথা বলে। যেখানে সব শ্রেণির, সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব অর্থনৈতিক অবস্থার পুরুষকেই পুরুষ দিবসের উদ্যাপনে যুক্ত করা যায়। এবং বালক-কিশোরদের জন্য এক সদর্থক আদর্শ তৈরি হয়। পুরুষ হতে গেলে ‘টক্সিক’ (বিষাক্ত) বা ‘অ্যাগ্রেসিভ’ (আক্রমণাত্মক) হতে হবে, সব নারী এবং অধিকাংশ পুরুষকে দমন করতে হবে, এই ধারণাটাকে চ্যালেঞ্জ করে পুরুষ দিবস। এই দিবসের বার্তা এই যে, পৌরুষের সংজ্ঞা একরৈখিক নয় বরং নানা প্রকারের। সংলাপের মাধ্যমে তা উপলব্ধি করবে এই সমাজ।
এই উদ্যাপনের আর একটি লক্ষ্য, সমকামী-রূপান্তরকামী পুরুষদের যোগদানকে সহজ করা। পুরুষ-অধিকার আন্দোলন কেবলমাত্র স্ট্রেট (বি-সমকামী) পুরুষদের জমিদারি নয়। দেখা যায় সমকামী-রূপান্তরকামী পুরুষদের ‘পুরুষ’ বলে গণ্যই করা হচ্ছে না, আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করা তো দূর অস্ত্। সমকামী-রূপান্তরকামী বহু পুরুষের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা শুরু হয় ছেলেবেলা থেকে, যখন অন্য পুরুষেরা তাদের উপর হেনস্থা, হিংসা, অত্যাচার, টিটকিরি চালায়। সমকামী-রূপান্তরকামী পুরুষকে যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণে অধিকাংশ সময়ে অন্য পুরুষেরাই জড়িত থাকে। পুরুষ-অধিকার চর্চায় এই দিকগুলি যোগ করা কর্তব্য।
ভারতে পুরুষ-অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রায়ই এক কিংবা একাধিক নারীকেও দেখা যায়। অথচ নারী-অধিকার আন্দোলনের হয়ে কোনও পুরুষ কথা বললে তাকে গালমন্দ করে অন্য পুরুষেরা। এগুলি ছাড়াও পুরুষদের নানা ধরনের মানসিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার পরিসর সে ভাবে তৈরি হয়নি।
সমস্যা এই যে, অনেকে পুরুষ দিবসকে ‘নারীবিরোধী দিবস’ করে তুলতে চান। সহবাসের পরে ধর্ষণের অভিযোগ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, স্ত্রী-সন্তানদের খোরপোশ প্রদান ইত্যাদি নিয়ে মামলায় জেরবার বহু পুরুষ। অনেকের ক্ষোভ অকারণ নয়। কিন্তু যে কোনও দিবসের পালনই আসলে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের উদ্দেশ্যে। পৌরুষের উদ্যাপনের দিনটি নারীবিরোধী দিবস করে তোলা চলে না। তা হোক সব পুরুষের, সব লিঙ্গপরিচয়ের মানুষের সমান মর্যাদা দাবি করার দিন।