‘না’ বলার স্বাধীনতা
Farmers Movement

প্রতিস্পর্ধার দুর্মর সম্ভাবনাকেই দেখিয়ে দিল এই বছরটি

১৯ নভেম্বর হুকুম নাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার কালে প্রধানমন্ত্রীর মুখমণ্ডলে ব্যর্থতার যে সুস্পষ্ট ছায়া পড়েছিল, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সে ছিল এক বড় শুভসঙ্কেত।

Advertisement
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:৫৫
সম্ভাবনা: উত্তরপ্রদেশের শামলিতে ‘কিসান মহাপঞ্চায়েত’-এ যোগদানকারী কৃষকরা। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, পিটিআই।

সম্ভাবনা: উত্তরপ্রদেশের শামলিতে ‘কিসান মহাপঞ্চায়েত’-এ যোগদানকারী কৃষকরা। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, পিটিআই।

একুশ শতকের একুশতম বছরটির কাছে আমরা কী পেলাম? এ-প্রশ্নের তেত্রিশ কোটি উত্তর হতে পারে। তাদের একটিও সকলের মনোমত হবে না। না-হওয়াই স্বাভাবিক। এবং কাম্য। সকলেই যদি একটা গোটা বছরের প্রাপ্তি হিসাবে কোনও একটা ব্যাপারকেই বেছে নেন, তবে তো বুঝতে হবে সভ্যতার পূর্ণগ্রাস সম্পন্ন হয়েছে। রাজনীতির নায়কনায়িকারা অনেকে হয়তো তেমনটাই চান, বিরোধী-শূন্য দেশে অথবা রাজ্যে সবাই এক ঈশ্বর বা ঈশ্বরীর বন্দনা করবেন এটাই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা তো ব্যাধি বই কিছু নয়। ক্ষমতার ব্যাধি। অতএব ভরসা থাকুক— যে যার নিজের মতো করেই বর্ষফল বেছে নেব, কোনও ক্ষমতার হুকুম তামিল করে নয়, প্রয়োজনে ক্ষমতার মুখের উপর ‘না’ বলে। ভেবে দেখলে, ২০২১ আমাদের এই ভরসাটাই দিয়েছে। বহুত্বের ভরসা। স্বক্ষমতার ভরসা। প্রতিবাদের ভরসা। সেটাই তার কাছে আমাদের বড় প্রাপ্তি।

ক্ষমতার একাধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী স্বক্ষমতার জয়ী হওয়ার যে দৃষ্টান্তটি এ-বছরের প্রবলতম ভরসার অভিজ্ঞান হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে সেটি, বলা বাহুল্য, কৃষক আন্দোলনের অটল প্রতিরোধের সামনে কেন্দ্রীয় সরকারের পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত। কৃষক আন্দোলনের দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা, তার চালকদের শ্রেণি-পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থান, সেই অবস্থানের সীমাবদ্ধতা, এ-সব নিয়ে নানা মত আছে, নানা তর্ক চলেছে এবং চলবে। চলা জরুরি। কিন্তু এ-কাহিনির মূল কথা একটাই। ভারতীয় রাষ্ট্রের পরাক্রমী নায়করা অতিকায় কর্পোরেট পুঁজির হাতে গোটা দেশটাকে সম্প্রদান করে দেওয়ার যে ঝটিকা অভিযান সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর, কৃষক আন্দোলন তার সামনে রুখে দাঁড়িয়ে বলেছে: হবে না। এবং হুকুম নড়েছে। ১৯ নভেম্বর হুকুম নাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার কালে প্রধানমন্ত্রীর মুখমণ্ডলে ব্যর্থতার যে সুস্পষ্ট ছায়া পড়েছিল, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সে ছিল এক বড় শুভসঙ্কেত। সঙ্কেতের বেশি কিছু নয় তা, কিন্তু সঙ্কেত মূল্যবান, কারণ তা সম্ভাবনাকে চিনিয়ে দেয়। রাজনীতির সম্ভাবনা।

Advertisement

এই সম্ভাবনার নির্মাণ সহজ হয়নি। প্রতিরোধ ভাঙতে শাসকরা একেবারে শুরু থেকে যে সব কাণ্ড করেছিলেন সেগুলো— গণতন্ত্র দূরস্থান— সুস্থ সভ্যতার প্রাথমিক শর্তকেও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে। তাতে অবশ্য আজ আর অবাক হওয়ার কিছুমাত্র কারণ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়ে তাঁরা নিজেরাই সম্ভবত অবাক হয়ে গিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর দুঃস্বপ্নে হয়তো-বা হানা দিয়েছে সেই বিপন্ন বিস্ময়: কী করে এই আন্দোলনজীবীরা তাঁকে হারিয়ে দিলেন? এমন শীতের দিনে শ্রীযুক্ত মোদীর দুঃস্বপ্ন নিয়ে সময় এবং শব্দের অপচয় করা সুবিবেচনার কাজ হতে পারে না। কিন্তু ২০২১ সালের তুলে দেওয়া ওই প্রশ্নটা খুব বড়, খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকদের আন্দোলন কেন সফল হল, কিসের জোরে তাঁরা এমন একটা অতিকায় নির্বিবেক প্রতাপ-অন্ধতাকে হার মানাতে পারলেন, তা নিশ্চয় আমাদের অনেককেই ভাবিয়েছে।

একটা স্তরে এ-প্রশ্নের উত্তর সহজ এবং বহুচর্চিত— প্রতিবাদীদের স্বার্থ জোরদার এবং সংগঠন শক্তিশালী ছিল, অতএব স্বার্থের তাগিদ ও সংগঠনের সামর্থ্য, দুইয়ের যৌথ অভিঘাত রাষ্ট্রযন্ত্র সামলাতে পারেনি। এই উত্তর ভুল নয়, কিন্তু অপূর্ণ, অসমাপ্ত এবং কিঞ্চিৎ অগভীর। এই আন্দোলন জয়ী হয়েছে, কারণ তা প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের স্তর ছাড়িয়ে সত্যকার প্রতিস্পর্ধা হয়ে উঠেছে, যা কেবল ক্ষমতার মুখের উপর ‘না’ বলে না, সেই ‘না’-কে একটা বিকল্প অবস্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, যে বিকল্পের একটা নিজস্ব ধারণা আছে, যুক্তি আছে, এবং তার ফলে আছে সমবেত ও সংহত প্রত্যয়। আলজিরীয়-ফরাসি লেখক ও চিন্তাজীবী আলবেয়র কামু তাঁর দ্য রেবেল গ্রন্থের সূচনায় লিখেছিলেন, ‘রেবেল’ কে? যে ‘না’ বলে, কিন্তু যার প্রত্যাখ্যানে প্রস্থান বা প্রত্যাহার নেই, আছে প্রতিস্পর্ধা, যে প্রতিস্পর্ধা ঘোষণা করে: ‘এই অন্যায় আর নয়; তোমরা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ, এ জিনিস আর চলতে পারে না’। অর্থাৎ, “তার এই ‘না’ একটা সীমারেখার কথা জানিয়ে দেয়।” ক্ষমতার অধীশ্বররা যে অন্যায় করতে চাইছেন এবং তার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যাকে আমরা ন্যায় বলে দাবি করছি, সেই দুইয়ের মধ্যবর্তী সীমারেখা। এ-কালের বাগ্‌ধারায়— রেবেল বা প্রতিস্পর্ধীরা ক্ষমতার অধীশ্বরদের সামনে একটা ‘রেড লাইন’ টেনে দেন। দিল্লীশ্বরেরা সেই রক্তরেখার সামনে ঠেকে গেছেন। অন্তত এ-যাত্রা। ২০২১ সালের মতো।

এই প্রতিস্পর্ধী প্রত্যয়ের সূত্র ধরেই আমরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে ভাবতে পারি আর এক আন্দোলনের কথাও, নাগরিকত্ব যাচাই ও নির্ধারণের নামে রাষ্ট্রযন্ত্রীদের ভয়ঙ্কর রাজনীতির বিরোধিতায় যে আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করেছিল, যার অ-সামান্য প্রতীক হয়ে উঠেছিল রাজধানী দিল্লির শাহিন বাগ। অতিমারির আবির্ভাব সেই সংগ্রামের গতিপথে অপ্রত্যাশিত বাধা সৃষ্টি করে, তাতে শাসকরা সম্ভবত পরম আহ্লাদিত হয়েছিলেন। নাগরিকত্ব যাচাই নিয়ে মোদী-শাহি তর্জনগর্জন আপাতত কিঞ্চিৎ প্রশমিত। সুযোগ বুঝে তাঁরা আবার ঝাঁপিয়ে পড়বেন এমন আশঙ্কা জোরদার, কিন্তু তাঁদের সাময়িক গতিভঙ্গই বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ নিষ্ফল হয়নি।

লক্ষণীয়, সেই আন্দোলনেরও কেন্দ্রে ছিল বিষাক্ত সংখ্যাগুরুবাদের বিপরীতে উদার গণতান্ত্রিক বহুত্বের একটি বিকল্প নৈতিক অবস্থান। প্রতিবাদীরা যে সে দিন ক্রমাগত ভারতীয় সংবিধানকে, বিশেষত তার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ লোকতন্ত্রের প্রস্তাবনাকে ধ্রুবপদের মতো উচ্চারণ করে গিয়েছেন, সেটা কোনও লোকদেখানো চমক ছিল না, এতদ্দ্বারা তাঁরা এক বিকল্প নৈতিকতাকে শাসকের সামনে এবং দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ধর্মাশ্রিত সঙ্কীর্ণ অতিজাতীয়তার বিপরীতে বহুবর্ণ বহুমাত্রিক জাতীয়তার প্রসারিত ধারণাই ছিল তাঁদের প্রতিপাদ্য। নাগরিক যাচাইয়ের রাষ্ট্রীয় প্রকল্পকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁদের প্রতিবাদ সেই অন্য জাতীয়তার দাবিকে জনসমাজের পরিসরে পেশ করেছিল। যথার্থ প্রতিস্পর্ধী ‘না’ এই ভাবেই নেতি-র গণ্ডি ভেঙে গভীর ভাবে সদর্থক হয়ে উঠতে পারে। ভারতে— নরেন্দ্র মোদীর ভারতেও— আমরা তা দেখেছি, দেখছি। এই অভিজ্ঞতা ভরসা দেয়।

ভরসা বা সম্ভাবনার মতো শব্দগুলো সহজেই আমাদের চেতনার চার পাশে একটি মোহ আবরণ তৈরি করে দেয়, আমরা ভাবি যে আলোর রেখা যখন দেখা গেছে তখন আর চিন্তা নেই, অন্ধকার আপনিই কেটে যাবে। এমন ভাবনা শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনক। অন্ধকারের সওদাগররা শুধু সক্রিয় নয়, অতিমাত্রায় তৎপর, হরিদ্বারের ‘ধর্ম সংসদ’ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাই নিরন্তর সতর্কতা, সংগঠন ও সংগ্রামের কোনও বিকল্প নেই। ক্ষমতা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও এ-সত্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ এখানে প্রতিস্পর্ধার ধারাটি ক্ষীণ, বহুলাংশে অন্তঃসলিলা। শুধু রাজনীতির মাঠে নয়, সামাজিক পরিসরেও ক্ষমতার সর্বগ্রাসী আধিপত্যকে আমরা বহু দূর অবধি যেন ‘স্বাভাবিক’ বলেই মেনে নিয়েছি, ক্ষমতাবানদের খুশি করাই যেন নাগরিক সমাজের, এমনকি সেই সমাজের কেষ্টবিষ্টুদেরও পবিত্র কর্তব্য। বিপজ্জনক বইকি।

এই বিপদ মাথায় নিয়েই নতুন বছরে যাওয়া। স্বাধীনতার ৭৫ বছর সেটি। রাষ্ট্র-পতিরা মহা ধুমধাম মহা হট্টগোলে ক্যালেন্ডার উদ্‌যাপন করবেন। কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকরা নয়, নানা রাজ্যের নানা কিসিমের শাসকরাই স্বাধীনতার আলোয় নিজেদের আলোকিত করতে তৎপর হয়ে উঠবেন। কিন্তু প্রতিস্পর্ধার স্বাধীনতা? শাসকের নীতি ও নির্দেশকে ন্যায্যতার মাপকাঠিতে যাচাই করার স্বাধীনতা? ভিন্নমত পোষণ করলে সেই মত জানানোর স্বাধীনতা? ‘না’ বলার স্বাধীনতা? শাসক সেই স্বাধীনতা দেবে না, তাকে আদায় করতে হবে। ইতিহাসবিদ রমিলা থাপর সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় বলেছেন, “একটি স্বাধীন দেশে বিবাদী স্বরের স্বীকৃতি নির্ভর করে জনমতের উপরে।” জনমত গড়ে তুলতে হয়। তার পথ কঠিন, বন্ধুর, দ্বন্দ্ববহুল, সংঘাতময়। কিন্তু সেটাই উত্তরণের একমাত্র পথ। একুশ শতকের একুশতম বছরটি তার সাক্ষী।

আরও পড়ুন
Advertisement