International Sex Workers day

যেখানে আজও সূর্য ওঠেনি

আওয়াজ তুলেছিলেন কাজের ভয়াবহ পরিবেশের পরিবর্তন, স্বীকৃতি চেয়ে। তাই ২ জুন ‘আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী দিবস’ হিসাবে পালিত হয়।

Advertisement
সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪ ০৮:৩৭
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

তাঁরা মাতা, কন্যা বা বধূ নন। কারণ, অধিকাংশই ঘর ফেলে এসেছেন বহু দূরে। অন্ধকারের আবরণে মুখ ঢেকে যে সমাজ তাঁদের কাছে সুখ কিনতে যায়, আলো ফুটলে সে-ই মুখ ফেরায় ঘৃণায়। তাঁদের জীবিকা আদিমতম পেশা হয়েও সম্মান, স্বীকৃতি পায় না। তাঁদের নিয়ে কাব্য-সাহিত্য-সিনেমা হয়েছে অনেক। রবি ঠাকুরের পুরনারী শ্রীমতীকে আমরা বৈশালীতে নগরবধূ আম্রপালি হতে দেখেছি। দেখেছি সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর হাতে পড়ে হীরামণ্ডি-তে তাঁরা গয়নায় মোড়া তবায়েফ হয়ে যান। তাঁরা নিন্দিত, আবার ঈর্ষণীয়, রহস্যময়ী, প্রেরণার উৎস। কেবল সংসারের চেনা বারান্দায় শীতলপাটি পেতে তাঁদের সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করতে বসা যায় না।

Advertisement

এই কাহিনিতে বাঁক আসে ১৯৭৫-এর ২ জুন। মে দিবসের হে মার্কেট বিশ্বকে যা শিখিয়েছিল, সেই সুস্থ ও সম্মানজনক কাজের পরিবেশের অধিকার ফ্রান্সের লিয়ঁ-তে দাবি করেছিলেন শরীর-শ্রমিকরাও, যাঁদের কাজকে ‘পেশা’ মানাই হত না। আওয়াজ তুলেছিলেন কাজের ভয়াবহ পরিবেশের পরিবর্তন, স্বীকৃতি চেয়ে। তাই ২ জুন ‘আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। ১০০ জনের সেই লড়াই ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে। আশির দশকে দেহোপজীবিনীরা লড়েন অপরাধ, হিংসার বিরুদ্ধে ও স্বাস্থ্যসচেতনতার দাবিতে। এডস ইত্যাদির মোকাবিলায় সক্রিয় হন। ২০২৪-এর আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী দিবসের থিম ‘সামনে তাকাও’। হয় তাঁদের সামনে আলো আছে বা আলো তাঁরা জ্বেলে নেবেন।

ইউএনএআইডিএস-এর হিসাবে, ভারতে ন’লক্ষের কাছাকাছি যৌনকর্মী। বাস্তবে সংখ্যা হয়তো অনেক বেশি! সস্তা প্রসাধনে নিজেকে সাজিয়ে পথে ক’জন ঘুরছেন, ক’জন নিজের ঘরখানাকেই দোকান বানিয়ে ফেলতে বাধ্য, আপনার-আমার সঙ্গে নিত্যযাত্রা করে কে অফিসের বদলে গেলেন দামি হোটেলের বেনামী ঘরে, কে হিসাব রাখছে? বিশ্বের ‘সেক্স টুরিজ়ম’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত অন্যতম ‘গ্লোবাল হাব’। এখানে মোগল আমলের তবায়েফের মুজরায় মিলেছে পর্তুগিজ় আনীত জাপানি ছোঁয়া। মহাবিদ্রোহেরও আগে ‘রেড লাইট এরিয়া’ নির্দিষ্ট করেছে কোম্পানি শাসন। ১৮৬৪-তে এসেছে ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট’। সেনাঘাঁটিতে ১৪-১৫ জন যৌনকর্মী লাইসেন্স পেয়েছেন ‘চাকলাস’ চালানোর।

দেশে দেহব্যবসার আইনি দিকটি জটিল। উরুগুয়ে, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, তুরস্ক, হাঙ্গেরি ইত্যাদি দেশে যৌনকর্ম বৈধ পেশা। ভারতে এই বৈধতা নিয়ে মামলা-মকদ্দমার ইতিহাসে ১৯৮৬-র ‘দি ইমমরাল ট্র‍্যাফিক প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ যেমন আছে, ‘বুদ্ধদেব কর্মকার বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার’-এর মামলাটিও আছে। সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে জীবন এবং জীবনধারণের অধিকার স্বীকৃত। স্বীকৃতি পেয়েছে দেহোপজীবিনীদের অধিকার, নিরাপত্তার দাবিও। যৌনকর্মীরা ভারতে আইনসম্মত ভাবেই কাজ করতে পারেন, শর্তসাপেক্ষে। দালালি, নাবালিকাকে এই কাজে নামানো, দেহব্যবসার কেন্দ্র চালানো ইত্যাদি এখানে বেআইনি। কিন্তু, লালসা, অভাব এবং খিদের ‘হানি ট্র‍্যাপ’-এ পড়ে আইন এবং বে-আইন প্রায়ই সীমারেখা বজায় রাখতে পারে না। ‘সোনাগাছি’ এক অনস্বীকার্য সত্য হয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকে ভারতের সর্বত্র। বিশেষত ১৬টি রাজ্যে। সেখানে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের পাশে রয়েছে দক্ষিণের অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, তেলঙ্গানা।

অভাব, পরিস্থিতির শিকার হওয়া নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনই দেহব্যবসায় বেশি। তাঁরা পেশাগত ও সামাজিক বহু অধিকারে বঞ্চিত। তাঁদের সন্তানরাও ‘জন্মদোষ’-এ বঞ্চনা, অসুস্থ শৈশবের শরিক। নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসচেতনতার নিরিখে আজও দেশের দেহোপজীবিনীরা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হন। বার্ধক্যে অনেকের অবস্থাই করুণতর। আমরা এঁদের অধিকারের প্রশ্নে আর চমকে না উঠলেও অধিকারের সংগ্রামে শরিকও হই না। অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়নের আলোচনা যখন আমাদের সাংস্কৃতিক বৈঠকখানা মাতিয়ে দেয়, সেই চত্বরেও যৌনকর্মী-প্রসঙ্গের প্রবেশাধিকার নেই। তাই তাঁদের সম্পর্কে আমাদের হৃদয়ে ঘৃণা, নির্বিকারত্ব যতখানি আছে; সহমর্মিতা, বাস্তব জ্ঞান প্রায় কিছুই নেই।

ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে রয়েছে যৌনকর্মীদের নিজস্ব ঐক্যমঞ্চ। সংগঠনটি তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে লড়ে, স্বাস্থ্য ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট। অনেক বেসরকারি সংগঠনও এঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। আমাদের রাজ্যে এমন সংস্থার আওতায় এসেছেন ৬০০০০-এর বেশি যৌনকর্মী। কিন্তু প্রশ্ন, সরকার যৌনকর্মীদের পাশে কী ভাবে দাঁড়াচ্ছে? দেশবাসী এই সহমানুষদের কতখানি সহমর্মিতা নিয়ে দেখছেন? উত্তর, কিছু ব্যতিক্রম ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি।

আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন মেদিনীপুরের দেহোপজীবিনী সত্যবতী দেবী। অকাল বৈধব্যের দারিদ্র তাঁকে এই পেশায় এনেছিল। রাতের অতিথিদের কাছ থেকে গোপন খবর সংগ্রহ করে বিপ্লবীদের দিতেন। পুলিশ তাঁকে চিনতে পেরে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যায় অনেকটা। প্রহারে দেহের কোথাও অক্ষত ছিল না। চিকিৎসকরাও মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলেন, এমনই অসহনীয় ছিল তাঁর যন্ত্রণা। মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সত্যবতীরা কোথায়? সমাজ তো দূর, সহযোদ্ধারাও কি তাঁদের যোগ্য মূল্যায়ন করেছেন? সে দিনের পরাধীন ভারত আজ স্বাধীনতার পতাকাকে বৃদ্ধ হতে দেখছে। কিন্তু, যৌনকর্মীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি বদলেছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement