যে ভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্র হল, তার দৃষ্টান্ত বিরল
RG Kar Medical College and Hospital Incident

আন্দোলনের চাওয়া-পাওয়া

প্রশ্ন উঠছে, এত বড় আন্দোলন থেকে এখনও পর্যন্ত কী পাওয়া গেল? আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দাবি ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বা ‘আমরা বিচার চাই’। আন্দোলন গড়ে না উঠলে আদৌ কোনও বিচার পাওয়া যেত কি না সন্দেহ।

Advertisement
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:০৬
গণপ্রবাহ: রাজধানীর রাস্তা জুড়ে মশাল মিছিল, ২০ সেপ্টেম্বর।

গণপ্রবাহ: রাজধানীর রাস্তা জুড়ে মশাল মিছিল, ২০ সেপ্টেম্বর। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এখনও চলছে। এত বড় আকারে, এত দিন ধরে, এত ব্যাপক ও গভীর আলোড়ন পশ্চিমবঙ্গ শেষ কবে দেখেছে? দেশের অন্য কোন প্রান্তেই বা কবে বিপুল সংখ্যক মানুষের পবিত্র ক্রোধ ও গভীর আবেগকে এ ভাবে যুক্তিনির্ভর, শান্ত ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদের ভাষায় মূর্ত হয়ে উঠতে দেখা গেছে? নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে শাহিন বাগ আন্দোলন, বা কৃষি আইনের নামে কর্পোরেট আরাধনার বিরুদ্ধে দিল্লি সীমান্তে বৎসরব্যাপী কৃষক প্রতিরোধের কথা অবশ্যই মনে আসবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আর জি কর আন্দোলন যে ভাবে সমাজের বিরাট অংশের মানুষকে আলোড়িত করে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে, তেমন উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে দেখা গেছে বলে মনে হয় না।

Advertisement

ধর্ষণ এবং হত্যা এ দেশে প্রতি দিনের খবর। সরকারি পরিসংখ্যানে দেশে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি ধর্ষণের অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়। বিলকিস বানোর পরিবারের গণধর্ষণ ও গণহত্যার মামলায় শাস্তিপ্রাপ্তদের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন জানিয়ে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। রাম রহিমের মতো অপরাধীকে নিয়ম করে প্রতিটি নির্বাচনের আগে দীর্ঘ সময়ের জন্য জেল থেকে ছুটির ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের মতো দাপুটে বিজেপি সাংসদ পুলিশের চার্জশিট সত্ত্বেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও মণিপুরের আগুন নেবানোর কোনও চেষ্টা নেই, নারী-নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনার বিচার তো বহু দূর।

এই পরিস্থিতিতে আর জি করের ঘটনা নিয়ে এত বড় সামাজিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম কী ভাবে হল সেটা বাংলার বাইরে অনেকের চোখেই হয়তো যথেষ্ট বিস্ময়কর। আসলে আমরা ভুলে যাই, ২০১২-১৩ সালে নির্ভয়া আন্দোলনের পর এ দেশে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আগের থেকে সমাজে অনেক বেশি সচেতনতা গড়ে উঠেছে। নারী-নির্যাতন ও ধর্ষণ সংস্কৃতিকে প্রশ্রয়দান বা পুরস্কৃত করার প্রতিটি ঘটনাতেই গণমানসে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ক্ষেত্রে সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বিস্ফোরণ ঘটেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডাক্তারদের নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং সাধারণ ভাবে মেডিক্যাল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এবং নির্দিষ্ট ভাবে আর জি কর কলেজে দুর্নীতির ঘুঘুর বাসাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অসন্তোষ। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্য সরকারের একের পর এক ভুল পদক্ষেপ এবং মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের শাসক দলের বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর অসংবেদনশীল ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য ঘৃতাহুতি দিয়েছে এই আগুনে।

প্রশ্ন উঠছে, এত বড় আন্দোলন থেকে এখনও পর্যন্ত কী পাওয়া গেল? আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দাবি ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বা ‘আমরা বিচার চাই’। আন্দোলন গড়ে না উঠলে আদৌ কোনও বিচার পাওয়া যেত কি না সন্দেহ। বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে ক্রন্দনরত অবস্থাতেই দেখতে আমরা বেশি অভ্যস্ত। তাই বিচারপ্রক্রিয়া এখনও পর্যন্ত যত দূর এগিয়েছে, সেটা আন্দোলনেরই জয়। সিবিআই তদন্তে সম্পূর্ণ সত্য উদ্ঘাটিত হবে কি না এবং সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে বিচারপ্রক্রিয়া প্রকৃত দোষীদের উচিত শাস্তি দিতে পারবে কি না— এ প্রশ্ন অবশ্যই এখনও উত্তরহীন। কিন্তু আন্দোলনের চাপে কিছু কাজ যে অবশ্যই হচ্ছে তা বোধ হয় কেউই অস্বীকার করবেন না। গণ-আলোড়নের অভূতপূর্ব মাত্রাকে মাথায় রেখেই সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। গণতন্ত্রে গণবিক্ষোভ প্রশমন বা নিয়ন্ত্রণের এ এক প্রচলিত পদ্ধতি। কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবে আন্দোলন কত বড় রূপ নেবে, এর যেমন কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, তেমনই রাষ্ট্র (মনে রাখতে হবে আদালত রাষ্ট্রব্যবস্থারই অন্যতম অঙ্গ) কী ভাবে গণবিক্ষোভে হস্তক্ষেপ করবে তার ব্যাকরণও কোনও ধরাবাঁধা ছকে চলে না। কিন্তু আর জি কর আন্দোলনের মেজাজ এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বিচারের প্রশ্নকে মাঝপথে হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে না।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্নটিকে মূলত ডাক্তারদের নিরাপত্তার প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করছে। কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তার এখনও পর্যন্ত উপেক্ষিত বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাতেও কেন্দ্রীয় গুরুত্ব পায়নি। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত নারী-সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাবে রাতের কাজ থেকে মহিলাদের যথাসম্ভব বাইরে রাখার রক্ষণশীল দিশা অবশ্য সুপ্রিম কোর্টে সমালোচিত হয়েছে। একই ভাবে অপরাজিতা বিলে ধর্ষণ নিবারণ ও ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনাতেই বিচার সুনিশ্চিত করার পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড-সহ দ্রুত কঠোর শাস্তির উপর জোর দিয়ে দোষ সাব্যস্ত হওয়ার ও সুবিচারের সম্ভাবনাকেই প্রকৃতপক্ষে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। নির্ভয়া আন্দোলনের এক দশক পেরিয়ে আর জি কর আন্দোলন থেকে নারীর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার যে প্রশ্ন জোরালো ভাবে উঠে এসেছে, তা যেন আইন-আদালতের বেড়াজালে আটকে না যায় তা দেখার দায়িত্ব প্রত্যেক আন্দোলনকারী শক্তি ও ব্যক্তির।

সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও প্রত্যয়দৃপ্ত আন্দোলনের জোরে জুনিয়র ডাক্তাররা রাজ্য সরকারকে কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য করতে পেরেছেন। তাঁদের বেশ কিছু দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু যে ভিমরুলের চাকে ঘা পড়েছে তাতে ডাক্তাররা তাঁদের ভবিষ্যৎ-নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। তাই তাঁদের সিদ্ধান্ত, নিরাপত্তার দাবিতে অন্য রূপে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ডাক্তারদের নিরাপত্তার মতোই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা-পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং জনগণের জন্য সুলভ চিকিৎসার নিশ্চয়তা। সরকারি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে জনগণের হাতে স্বাস্থ্যবিমার কার্ড ধরিয়ে দেশ জুড়ে যে রমরমা স্বাস্থ্য ব্যবসার ফাঁদ পাতা হয়েছে, দুর্নীতির ঘুঘুর বাসার সঙ্গে সেই ফাঁদকেও বন্ধ করা দরকার। চলমান জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন এমন এক বৃহত্তর গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের পথ যদি প্রশস্ত করতে পারে, তা হলে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের সাধারণ মানুষ দু’হাত তুলে বাংলার ডাক্তার-আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাবেন।

আর জি কর আন্দোলনের মূল চরিত্র নাগরিক। নাগরিক বলতে শুধু মহানগর বা শহরতলির উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সমাজ নয়, বরং সংবিধান-স্বীকৃত অর্থে ‘উই দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’— শহর-গ্রাম, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত, সুবিধাভোগী-বঞ্চিত সমস্ত বিভাজন পেরিয়ে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারসম্পন্ন সচেতন জনগণ। এ আন্দোলন গ্রামের সাধারণ মহিলাদেরও পথে নামিয়েছে, পথে নামিয়েছে রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন প্রজন্মের বিভিন্ন পেশার মানুষকে। এই নাগরিক আন্দোলন কোনও দলকে সামনে আসতে দেয়নি, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বার বার জবরদখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। দলনিরপেক্ষ হলেও এই নাগরিক আন্দোলন কিন্তু নির্গুণ নিরাকার নয়। আধুনিক সমাজ ও গণতন্ত্রের উপযুক্ত নতুন চেতনা এবং রাজনীতির ভাষা গড়ার অনেক উপাদান ও সম্ভাবনা এই আন্দোলন তুলে ধরেছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ‘ফাঁসি চাই’ বলে রাস্তায় নেমেছেন, বিরোধী দল ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আন্দোলন সুবিচারের দাবিতে অনড় থেকেছে।

পশ্চিমবঙ্গের বিগত দু’টি নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলার মানুষ রাজ্য সরকার সম্পর্কে রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ হলেও, রাজ্যে প্রধান বিরোধী অবস্থানে থাকা কেন্দ্রের শাসক দলটি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং তাকে রাজ্যে শাসনক্ষমতায় বসাতে উৎসাহী নয়। এর ফলে একুশের বিধানসভা এবং চব্বিশের লোকসভা দুই নির্বাচনেই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ও আসন বেড়েছে। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে রাজ্য সরকারের এবং শাসক দলের বড় বড় ভুলভ্রান্তিগুলো, দুর্নীতি ও অপশাসনের জলজ্যান্ত উদাহরণগুলো মানুষ ক্ষমা করে দেবেন। নাগরিক সমাজের চলমান আন্দোলনের এটাই প্রধান বার্তা। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-তৃণমূল মেরুকরণ ভেঙে বামপন্থী-উদারবাদী ঘরানার তৃতীয় শিবিরের উঠে আসারও এটাই প্রধান ভিত্তি। লিঙ্গ-ন্যায়ের প্রশ্নে অসংবেদনশীল ক্ষমতা-দম্ভের রাজনীতির জবাবে পাল্টা গণমুখী রাজনীতির এটাই জীবন্ত জাগ্রত ভাষা। উৎসবের আগমনী বেজে উঠলেও আন্দোলনের উৎসাহে কোনও ভাটা নেই। সলিল-সুকান্ত-হেমন্ত আবার জীবন্ত হয়ে উঠছেন বাংলার আকাশে বাতাসে। রাত দখল, দিন বদল আর অধিকার অর্জনের আন্দোলন চলছে, চলবে।

আরও পড়ুন
Advertisement