রাজ্য-সিপিএম তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব, বিজেপি নিয়ে ততটা নয়
India Politics

শ্যাম রাখা, না কি কুল রাখা

আট বছর পরে সিপিএম ফের সেই উভয় সঙ্কটের মুখোমুখি। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের প্রধান শত্রু কে? রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস, না কি প্রধান বিরোধী দল বিজেপি?

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৯
উভয় সঙ্কটে: আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে সিপিএমের মিছিল, রায়গঞ্জ। কৌশিক সেন

উভয় সঙ্কটে: আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে সিপিএমের মিছিল, রায়গঞ্জ। কৌশিক সেন Sourced by the ABP

দিল্লির এ কে গোপালন ভবন বা কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হালচাল দেখলে মনে হয়, সিপিএম দফতরের ঘড়ির কাঁটা এখনও বেজিং বা মস্কোর সময়ের সঙ্গে মেলানো রয়েছে। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তাঁরা দেরিতে টের পান। দেরিতে মালুম হয় বলে তাঁদের রাজনৈতিক রণকৌশল ঠিক করতেও দেরি হয়। তার জন্য ঘটা করে পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করে পার্টি কংগ্রেস আয়োজন করতে হয়। সে অনেক হাঙ্গামা!

Advertisement

আট বছর আগে সিপিএমের শীর্ষনেতৃত্বে এক বিরাট বিতর্ক হয়েছিল। কে ‘প্রধান শত্রু’? বিজেপি না কংগ্রেস? বিজেপি কি এতটাই বড় শত্রু যে তার মোকাবিলায় কংগ্রেস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গে হাত মেলানো চলে? সিপিএমের নেতারা যখন এই চুলচেরা বিতর্কে ব্যস্ত, তত দিনে বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় চলে এসেছে। একের পর এক রাজ্য বিজেপি দখল করছে। তখনও সিপিএমের নেতারা দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁদের মনে প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি কি ‘ফ্যাসিবাদী’? না কি শুধুই ‘স্বৈরাচারী’? কোনও এক সিপিএম পার্টির দলিলে বিজেপি সম্পর্কে ফ্যাসিবাদী লেখা হল, না স্বৈরাচারী, তা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কিচ্ছুটি আসে যায়নি। তা-ও এ নিয়ে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্টরা দিনের পর দিন বাদানুবাদ করে সময় নষ্ট করেছিলেন।

আট বছর পরে সিপিএম ফের সেই উভয় সঙ্কটের মুখোমুখি। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের প্রধান শত্রু কে? রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস, না কি প্রধান বিরোধী দল বিজেপি?

সিপিএমের ঘোষিত অবস্থান হল, তাঁরা ইন্ডিয়া জোটে তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একই টেবিলে বসছেন ঠিকই, তবে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের লড়াই একই সঙ্গে তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে। মুশকিল হল, ঘোষিত অবস্থানের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক বিস্তর। কার্যক্ষেত্রে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যতখানি সরব, বিজেপির বিরুদ্ধে মোটেই ততখানি নয়।

সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম ঠিক এই ভুলই করেছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভায় শূন্য হাতে ফেরার পরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যালোচনায় লেখা হয়েছিল, ‘বিজেপি ও তৃণমূলকে হারানোর ডাক দিলেও বাস্তবে প্রচারের সময়, লোকসভা নির্বাচন সত্ত্বেও বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। নিচু স্তরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইতে।’ সিপিএম নেতৃত্ব স্বীকার করেছিলেন, ‘গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই এই সমস্যা চলে আসছে। দলের রাজনৈতিক লাইনে কোথায় জোর দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে পার্টির ক্যাডারদের শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন।’ সিপিএম নেতারা মনে করেন, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনেও তাঁরা বিজেপির বদলে শুধু তৃণমূলকে আক্রমণেই ব্যস্ত ছিলেন। রাজনৈতিক রণকৌশলের দলিলে বিজেপিকে আক্রমণে জোর দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও ক্যাডাররা তা বুঝতে পারেননি।

এখন পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সামনে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন। আর তার আগে দ্বিধাগ্রস্ত সিপিএম শীর্ষনেতৃত্ব মনে করছেন, ‘সমস্ত স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত মোকাবিলাতেই বেশি জোর দেওয়া উচিত।’ আগামী বছর এপ্রিলে মাদুরাইয়ে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস বসবে। তার রাজনৈতিক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা-পন্থী মানুষ তৃণমূলকেই বিজেপির বিরুদ্ধে কার্যকর শক্তি হিসাবে দেখছে। তাই বিজেপির মোকাবিলায় বেশি জোর দেওয়া উচিত। পার্টির দলিলে এ কথা লেখা হলেও মুখে কিন্তু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা বলছেন, তাঁরা আদৌ বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেননি। রাজ্যে শাসক দল তৃণমূল। তাদের বিরুদ্ধে বিজেপি লড়ছে, সিপিএমও। সিপিএম কী ভাবে আর একটি বিরোধী দলকে প্রধান প্রতিপক্ষ ঠাওরাতে পারে? আসলে সিপিএম নেতাদের ভয় হল, তাঁরা যদি বিধানসভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে ঘোষণা করেন, তা হলে সিপিএম তৃণমূল সম্পর্কে নরম সুর নিচ্ছে বলে মানুষ ভুল বুঝতে পারে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূলের অপশাসন নিয়ে বিক্ষুব্ধ ভোটাররা বিজেপির দিকে চলে যাবেন। আবার সিপিএম তৃণমূল-বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে নীরব থাকলে, মানুষের মনে সিপিএম নেতাদের সম্পর্কে ‘বাম থেকে রাম’-এর ধারণা সুদৃঢ় হবে। বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রচারে তাই দেখা যাচ্ছে, মহম্মদ সেলিমরা তৃণমূলের নিন্দা করার আগে খানিক বিজেপির বিরুদ্ধেও কথা সেরে রাখছেন।

এই ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ সিপিএম নেতারা আসলে মানতে চান না, তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ যতখানি না রাজনৈতিক, তার থেকেও বেশি ব্যক্তিগত। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই চৌত্রিশ বছরের বাম দুর্গের পতন ঘটিয়েছেন। তাই এক সময় তাঁরা মনে মনে তৃণমূলকে হারাতে বিজেপির জয়ও প্রার্থনা করেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে আগে কমিউনিস্টদের শিকড়বাকড়-সহ উপড়ে ফেলবে।

কমিউনিস্টদের এই উভয় সঙ্কটের ইতিহাস যথেষ্ট পুরনো। ১৯৩১ সালে জাপান যখন চিন আক্রমণ করে, তখন চিনের কমিউনিস্ট পার্টি এই উভয় সঙ্কটে পড়েছিল। কে বড় শত্রু? জাপান? না কি সে সময় চিনের শাসক চিয়াং কাই শেকের জাতীয়তাবাদী দল কুয়োমিনতাং? এ দেশে সিপিএম বরাবর কংগ্রেস না বিজেপি, কে বড় শত্রু, তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগেছে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির সঙ্গে হাতে হাত ধরে এক মঞ্চেও দাঁড়িয়েছেন সিপিএম নেতারা। পরে তাঁরা কংগ্রেস ও বিজেপিকে একই মুদ্রার দু’পিঠ বলে মনে করতে শুরু করেন। বিজেপি যে অনেক বড় বিপদ, তা মার্ক্সবাদীরা যখন টের পান, তত দিনে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়ে গিয়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার ১৩ দিনের জন্য হলেও কেন্দ্রে সরকার গড়ে ফেলেছে।

বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেসকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত সিপিএম নিয়েছিল বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ছ’বছর সরকার চলার পরে। আবার সমর্থন প্রত্যাহার করে ফের বিজেপি ও কংগ্রেস থেকে সমদূরত্বের নীতি নিয়েছিল সিপিএম। সেই অবস্থান থেকে সরে এসে ফের বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলের সঙ্গে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নিতে সিপিএমকে মোদী জমানার দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

তবু, এই উভয় সঙ্কটও সিপিএমের আসল সঙ্কট নয়। আগামী পার্টি কংগ্রেসের জন্য তৈরি সিপিএমের রাজনৈতিক পর্যালোচনাতেই বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে দলের আসল কাজ হল, গ্রামের গরিব ও শহরের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কাজ করা। কিন্তু বহু জায়গাতেই সিপিএমের সঙ্গে এই শ্রেণির মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গ্রামেও সিপিএমকে গরিব কৃষক, খেতমজুর ও দিনমজুরদের দিকে নজর দিতে হবে। অথচ দলের নেতারা ভোটের অঙ্ক কষতে গিয়ে গ্রামের গরিবদের বদলে গ্রামের বড় লোক, প্রভাবশালী অংশের স্বার্থরক্ষায় নজর দিচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে ভুলে যাচ্ছেন।

সিপিএম নেতারা যা মানতে চান না, তা হল, তাঁরা আসলে গ্রামের গরিবদের বদলে শহুরে মধ্যবিত্তকে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক বলে ধরে নিয়েছেন। আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলনে সিপিএমের যুব ও ছাত্র সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তা নিয়ে সিপিএম উৎফুল্ল। কিন্তু সিপিএমের কৃষক, খেতমজুর, শ্রমিক সংগঠন কোথায়? সিপিএমের তরুণ মুখদের টিভিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে, গিটার কাঁধে গান গাইতে দেখা যায়। সিপিএমের নতুন প্রজন্মের শ্রমিক নেতা, কৃষক নেতা, খেতমজুর নেতা হিসাবে কারও নাম শোনা যায় না কেন? আর জি কর আন্দোলনকে ঘিরে যে মধ্যবিত্ত মানুষের ভোট মিলবে ভেবে সিপিএম আশাবাদী, সেই মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এখন উচ্চশিক্ষা বা চাকরির সূত্রে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সেই মধ্যবিত্ত তৃণমূল সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হলেও তাঁদের লাল ঝান্ডার তলায় নিয়ে আসা কঠিন।

এ সব কথা সিপিএমের রাজনৈতিক পর্যালোচনাতেই লেখা রয়েছে। শুধু তা বুঝতে সিপিএম নেতাদের দেরি হয়ে গিয়েছে, এই যা!

আরও পড়ুন
Advertisement