কিন্তু এখানে থেমো না
Farmer's movement

রাষ্ট্র এক পা পিছোল, গণতন্ত্রকে অনেক পথ যেতে হবে

প্রতিবাদী কৃষকদের অকুণ্ঠ অভিবাদন। এক বছর ধরে যে আত্মশক্তির প্রমাণ দিয়েছেন তাঁরা, তার মূল্য দিতে যেন আমরা কার্পণ্য না করি।

Advertisement
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৫৩
আদায়: কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে কৃষক আন্দোলনের কর্মীরা। সিঙ্ঘু সীমান্ত, ১৯ নভেম্বর।

আদায়: কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে কৃষক আন্দোলনের কর্মীরা। সিঙ্ঘু সীমান্ত, ১৯ নভেম্বর। পিটিআই।

ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, আনন্দের কারণ ঘটলে মন খুলে আনন্দ করতে হয়। শুক্রবার সকালে কৃষি আইন বাতিলের সমাচারে যে আনন্দের স্বাদ পাওয়া গেল, তাকে বিরল বললে কম বলা হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘বোঝাতে পারিনি’, ‘ফিরিয়ে নিচ্ছি’, ‘ভালই তো চেয়েছিলাম’ গোছের বাণী শুনে ও সুসজ্জিত মুখমণ্ডলে ব্যর্থতার আহত ছায়া দেখে চিত্তপটে যে পুলক জেগেছে তার পুরোটা নির্মল আনন্দ বলে দাবি করা কঠিন, তবে তাতে লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ দেখি না— অনমনীয় দাপটের প্রতিমা চাপে পড়ে ঢোঁক গিলতে বাধ্য হলে মনটা যদি ‘বেশ হয়েছে’ বলে ওঠে, সেই তৃপ্তিতে তো গণতন্ত্রেরই উদ্যাপন, কোন প্রাণে তাকে বাধা দেব?

সংসদে পাশ হওয়ার— পাশ করিয়ে নেওয়ার— চোদ্দো মাস পরে মোদী সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করছে, এই ঘটনার অন্য সব অর্থের আগে যে সত্যটি উদ্ভাসিত, তা হল ঔদ্ধত্যের— শঙ্খ ঘোষের ভাষায় ‘প্রতাপ-অন্ধতা’র— নতিস্বীকার। যত অঙ্ক কষেই, যত কৌশল করেই শাসকরা এই হিসাবি পশ্চাদপসরণ করে থাকুন না কেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বাধ্য না হলে এই পরাজয় তাঁরা মেনে নিতেন না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্মল বিবেকের দোহাই দিয়ে বলেছেন যে, কৃষকদের ‘একাংশকে’ তিন আইনের গুণ বোঝাতে পারেননি বলেই শেষ অবধি এই সিদ্ধান্ত নিলেন! তিনি এবং তাঁর সহ-যন্ত্রীরা নির্বোধ নন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে, দেশের লোকে মোদ্দা কথাটা বুঝে নিয়েছে: রাষ্ট্র যত দাপটই দেখাক, শেষ অবধি সে শক্তের ভক্ত।

Advertisement

আর তাই প্রতিবাদী কৃষকদের অকুণ্ঠ অভিবাদন। এক বছর ধরে যে আত্মশক্তির প্রমাণ দিয়েছেন তাঁরা, তার মূল্য দিতে যেন আমরা কার্পণ্য না করি। দিল্লির সীমান্তে কৃষক সমাবেশের সূচনা থেকে ছলে বলে কৌশলে আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার যে চেষ্টা চলেছে, সচেতন নাগরিক সে-কাহিনি বিলক্ষণ জানেন। অগণন মানুষ মাসের পর মাস বহু প্রতিকূলতার মধ্যে, প্রচণ্ড শীত ও তীব্র গ্রীষ্ম সহ্য করে অবস্থান চালিয়েছেন, এই এক বছরে প্রায় সাতশো প্রাণ চলে গিয়েছে, রাষ্ট্রশক্তি ও তার অনুগামী বা অনুরাগী রকমারি বাহিনীর ক্রোধ বারংবার নেমে এসেছে প্রতিবাদীদের উপরে, বান ডেকেছে অপবাদ ও কুৎসার। কিন্তু আন্দোলন ভাঙেনি, বরং তার পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে, প্রতিজ্ঞা আরও জোরদার। কখনও কখনও যদি বা মনে হয়েছে এ-বার বুঝি পা টলল, অচিরেই সেই আশঙ্কা কেটে গিয়ে উদিত হয়েছে নতুন সংহতি। তার একটা বড় কারণ— আন্দোলনের নেতারা ক্রমাগত সংগঠনের এবং বৃহত্তর কৃষক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে শুনেছেন, তাঁদের পরামর্শ ও অনুমোদন নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করেছেন।

এই পদ্ধতি নিখুঁত ছিল বলে দাবি করার প্রশ্ন নেই, প্রয়োজন নেই আন্দোলনের লক্ষ্য ও পথের সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করার; বিশেষত মনে রাখা দরকার যে, আন্দোলন চালিয়েছেন দেশের কয়েকটি অঞ্চলের সম্পন্ন কৃষকরা, সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি এবং খেতমজুররা তার বাইরে, বড়জোর সহযাত্রীর ভূমিকায়, তাঁদের স্বার্থ অনেকাংশেই সম্পন্ন কৃষকের স্বার্থের বিপরীত। আন্দোলনের পরিসরে এই সব বিপরীত স্বার্থের মধ্যে কিছু সংযোগ তৈরি হলেও তার মাত্রা এখনও সীমিত। কিন্তু তাতে আন্দোলনের গুরুত্ব কমে না। আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধা এই ভাবেই এগোয়, রাজনীতি এই ভাবেই নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। যতটা হতে পেরেছে, তার মূল্য অনেক। তাই মন খুলে আনন্দ করাটা আমাদের কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী যেমন করে তাঁর অবোধ দেশবাসীদের বলতে শিখিয়েছেন: কর্তব্য, কর্তব্য, ঔর কর্তব্য।

তবে আনন্দ করলেই কর্তব্য ফুরোয় না। কর্তব্য অনন্ত। যে নাছোড় সংগ্রাম এই সাফল্য এনে দিল, তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই, বিকল্প নেই বিভিন্ন প্রশ্নে, বিভিন্ন বিষয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার। প্রতিস্পর্ধী কৃষকরা আইন বাতিলের ঘোষণাকে স্বাগত জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে তাঁদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক দাবি এখনও মেটেনি, সুতরাং আন্দোলন এখনই শেষ হবে না। অনুমান, তাঁদের উপর আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য নতুন করে প্রবল চাপ আসবে। নিজেদের অবস্থানে তাঁরা অবিচল থাকতে পারবেন কি না, ভবিষ্যৎই বলবে।

কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন হল, এই অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয় গণতন্ত্র নতুন দিশা এবং নতুন প্রত্যয় সংগ্রহ করবে কি না। কৃষক আন্দোলন দেখিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সংগঠিত এবং অহিংস প্রতিবাদ জারি রাখার সামর্থ্য অতি বড় আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রকেও ক্ষেত্রবিশেষে পিছু হটাতে পারে। এই সামর্থ্যই দেশের বিপন্ন গণতন্ত্রকে রক্ষার, এবং পুনরুদ্ধারের, এক নম্বর হাতিয়ার। তেমন সামর্থ্যের কিছু কিছু প্রমাণ আমরা পেয়েছি। জেএনইউ কিংবা জামিয়ার অঙ্গনে, শাহিন বাগের চত্বরে, পার্ক সার্কাসের জনপরিসরে শুনেছি বহুস্বরের নির্ঘোষ: হম দেখেঙ্গে। ক্ষমতার আস্ফালন নয়, প্রতিশোধের হুমকি নয়, সে আসলে ক্ষমতার অন্যায়কে প্রতিরোধের অঙ্গীকার, ন্যায্য দাবি আদায়ের অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকারকে সত্য এবং সার্থক করে তোলাই এখন গণতান্ত্রিক ভারতের দায়িত্ব ও দায়। আত্মরক্ষার দায়।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগণিত উপলক্ষ আমাদের সামনে। নাগরিক বাছাইয়ের নামে (এবং অন্য বহু ভাবে) সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, শ্রম আইন বদলে শ্রমিকের অধিকার আরও খর্ব করার ব্যবস্থা, উন্নয়নের নামে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জনজীবন ধ্বংসের বেপরোয়া অভিযান, বিরোধী রাজনীতি ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ দমনের উদ্দেশ্যে আইন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অভূতপূর্ব অপব্যবহার— প্রতিটি বিপদ বেড়ে চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা ও অনিশ্চয়তা— দারিদ্র, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য, অ-শিক্ষা, বেকারত্ব, মজুরি ছাঁটাই আর লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির তথ্য-পরিসংখ্যানে উন্মোচিত যে ভয়ঙ্কর ছবি অতি বড় আইটি সেল দিয়েও ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক এবং অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার জমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তার প্রয়োজনও বিপুল। শব্দ-স্রষ্টা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিভাকে কুর্নিশ করে গণতান্ত্রিক ভারত আন্দোলনজীবী হয়ে উঠতে পারবে কি না, তাঁর হার মেনে নেওয়ার ঘোষণা সেই প্রশ্নটাকে খুব বড় আকারে সামনে এনে দিয়েছে।

প্রশ্নটা কঠিনও। মনে করার কোনও কারণ নেই যে, এই পশ্চাদপসরণ শাসকদের আধিপত্যের তাগিদকে প্রতিহত করবে, তাঁরা আত্মসংশোধন করবেন। পঞ্জাবে ও উত্তরপ্রদেশে আসন্ন নির্বাচনের স্বার্থ মাথায় রেখেই যে তাঁরা এক পা পিছিয়ে গেলেন, সেটা নেহাতই সুস্পষ্ট। বেছে বেছে গুরু নানকের জন্মদিনে এই ঘোষণা করার মধ্যে আর যা-ই হোক কোনও ঘোমটার আড়াল নেই। এর ফসল তুলতে চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। ইতিমধ্যেই ক্যাপ্টেন ও বহিনজির মুখে মধুরগম্ভীর প্রশস্তিবচন ধ্বনিত হয়েছে, তা হয়তো ক্রমে জোরদার হবে, নানা প্রতিধ্বনিও ভেসে বেড়াবে। নির্বাচনী ময়দানে কৃষক আন্দোলন তাঁদের বেসামাল করবে কি না, শাসক শিবিরে তা নিয়ে প্রভূত উদ্বেগ জমছিল। মোদীজির ঘোষণায় মেঘ কেটে যাবে, ভোটের প্রশ্নমালাকে আবার মনের মতো সাজিয়ে নিতে পারবেন, এই আশা নিশ্চয়ই তাঁদের মনে প্রবল। সেই অঙ্ক যদি মিলে যায়, বুঝতে হবে কৌশলের জয় হল। এবং তখন, নিজেদের সামলে নেওয়া, গুছিয়ে নেওয়া শাসকরা দ্বিগুণ বিক্রমে সমস্ত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দমনে নেমে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অন্যান্য প্রশ্নে তো বটেই, কৃষি আইনের প্রশ্নেও সেই অভিযান দেখা যেতে পারে নতুন উদ্যমে, হয়তো নতুন চেহারায়। ভুললে চলবে না, যে অতিকায় কর্পোরেট উদ্যোগের স্বার্থে নয়া কৃষি আইন চালু করার এমন প্রাণপণ চেষ্টা, দু’পা এগোনোর লক্ষ্যেই তারা আপাতত রাষ্ট্রকে এক পা পিছোতে দিয়েছে।

কৃষক আন্দোলনের এই জয় কেবল আনন্দের নয়, ভরসার। ভরসা দেশের, ভরসা সাধারণ মানুষের, ভরসা গণতন্ত্রের। কিন্তু ভরসা আর সাফল্য এক নয়। গণতন্ত্রের সাফল্য দাবি করতে হলে এখনও অনেক পথ বাকি। সলিল চৌধুরী জন্মদিনের সকালে সুখবরটা শুনে বলতেন: এখানে থেমো না।

আরও পড়ুন
Advertisement