ধর্ম যেখানে শিক্ষার বাহন
Education

শিক্ষায় অসাম্যের শিকড় লুকিয়ে ভারতের ইতিহাসে

সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে এই প্রশ্নটারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন আমেরিকার এক দল সমাজবিজ্ঞানী।

Advertisement
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৫৮
আলো: বিশ শতকের গোড়ার দিকে বালকদের জন্য একটি মিশনারি স্কুল।

আলো: বিশ শতকের গোড়ার দিকে বালকদের জন্য একটি মিশনারি স্কুল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আজকের উন্নত দেশগুলির অনেকেরই অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ সেই দেশগুলিতে ঘটা দ্রুত সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষার প্রভূত অগ্রগতি। তাই প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের সরকারই শিক্ষা বিস্তারকে তাদের কর্মসূচির একবারে কেন্দ্রে স্থান দেয়। আমাদের দেশের সরকারও সেই দলেই পড়ে। বস্তুত, গত কয়েক দশকে যে দলই কেন্দ্রে সরকার গড়েছে, তারা প্রচুর সংখ্যক প্রকল্প গ্রহণ করেছে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য।

এই সমস্ত প্রকল্পের দরুন আমাদের দেশের শিক্ষার মানচিত্রের কিছুটা উন্নতি হয়েছে ঠিকই (১৯৯১-তে সাক্ষরতার হার ছিল ৫২%, যা ২০১১’য় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩%), কিন্তু জনশুমারির তথ্য ভাল করে ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, এই উন্নতির ভাগীদার দেশের সমস্ত মানুষ সমান ভাবে হননি। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার নিরিখে উল্লেখযোগ্য অসাম্য বজায় রয়েছে। শিক্ষায় অসাম্য রয়ে গিয়েছে নারী-পুরুষের মধ্যে, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে, এমনকি একই রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মধ্যেও। যে হেতু শিক্ষায় অসাম্য অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অসাম্যকে চালিত করে, সে হেতু এই অসাম্য কী ভাবে আবির্ভূত হল এবং এর শিকড়টাই বা কোথায়, সেটা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

সমাজবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সূচকের উপর (যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক বিশ্বাস, জন-পণ্য সরবরাহ, ভোগ এবং লিঙ্গ সমতা)। এই ধরনের গবেষণার পথিকৃৎ আমেরিকার এমআইটি-র অর্থনীতির অধ্যাপক ড্যারন অ্যাসেমোগ্লুর মতে, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রভাবিত করে— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র ইত্যাদির উপর প্রভূত ছাপ ফেলতে পারে। অতএব মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, ভারতে আজ যে শিক্ষার অসাম্য দেখতে পাওয়া যায়, তার শিকড়ও কি ইতিহাসের গভীরে লুকিয়ে আছে?

সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে এই প্রশ্নটারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন আমেরিকার এক দল সমাজবিজ্ঞানী। শিক্ষার ক্ষেত্রে আজকের ভারতে যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়, ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ঔপনিবেশিক ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের বিস্তার এবং কার্যকলাপ তার ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করতে পারে কি না।

ভারতে মিশনারি কার্যকলাপের প্রথম উল্লেখযোগ্য তরঙ্গ অনুভূত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ব্রিটিশ আধিপত্য শুরু হওয়ার ঠিক পরেই। প্রথম দিকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসা মিশনারিদের সমস্ত কাজের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করেছিল, কারণ তারা একেবারেই চায়নি যে, মিশনারিদের কার্যকলাপের দ্বারা স্থানীয় ধর্মীয় ভাবাবেগ কোনও ভাবে আহত হোক। কিন্তু ১৮১৩-র পর এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে, যখন ইংল্যান্ডে জনরোষের প্রতিক্রিয়ায় কোম্পানি তাদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলিতে মিশনারিদের ধর্মান্তরিত করার অবাধ স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। এর ফলেই বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মিশনারিরা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী চরিত্র হয়ে উঠতে শুরু করেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আরও একটি ঘটনা ঘটে, যা তৎকালীন ভারতে মিশনারিদের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে ওঠে। ১৮৫৮ সালে, সিপাহি বিদ্রোহের পর, ভারতের সার্বভৌমত্ব কোম্পানি থেকে ইংল্যান্ডের রানির হাতে চলে যায়। সেই সময় মহারানি ভিক্টোরিয়া ধর্মীয় নিরপেক্ষতার একটি সরকারি নীতি প্রণয়ন করেন, যাতে বলা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের কার্যকলাপের পক্ষে যেমন কোনও পদক্ষেপ করবে না, তেমনই তাঁদের কার্যকলাপের বিরোধিতাও করবে না। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’-র এই নীতির মাধ্যমে ভারতে মিশনারিদের কার্যকলাপের প্রতি ইংল্যান্ডেশ্বরী পরোক্ষ সমর্থনই জানিয়েছিলেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের উপস্থিতি ভারতে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্বের অন্যতম স্তম্ভ ‘সোলা স্ক্রিপটুরা’-র (অর্থাৎ, ‘কেবল বাইবেল-এর মাধ্যমে’) নীতি অনুসারে, মানুষ কেবল বাইবেল পড়ার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের কথা বুঝতে পারে, তাঁর সঙ্গে যোগ স্থাপন করতে পারে। তাই মানুষকে প্রথমে সাক্ষর হতে হবে, যাতে তারা বাইবেল এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারে। ফলস্বরূপ, শুরু থেকেই ভারতে প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিরা সর্বজনীন সাক্ষরতার প্রচারে ধারাবাহিক ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

উপরন্তু, ইউরোপীয় দেশগুলিতে উপযোগবাদ ভাবধারার (যে ভাবধারা অনুযায়ী একটি কর্ম ঠিক বলে বিবেচনা করা উচিত যদি সেটি সুখ বা আনন্দের জন্ম দিতে পারে, এবং ভুল বলে বিবেচনা করা উচিত যদি সেটি দুঃখ সৃষ্টি করতে পারে) উত্থান শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মান্তরণের একটি নতুন পদ্ধতির সূচনা করে। শিক্ষার ধর্মান্তরিত করার শক্তি আছে— এই বিশ্বাসের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিশন-চালিত স্কুলগুলির বিপুল প্রসার ঘটে ভারতে।

উল্লেখ্য, প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিরা নারী শিক্ষায় বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে নারীদের শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশ-ভারত সরকার বিশেষ মাথা ঘামায়নি, এটা ঐতিহাসিক সত্য। নারী-শিক্ষার প্রতি মিশনারিদের আগ্রহ তাই ব্রিটিশ-ভারত সরকারের অবস্থানের বিপরীতে ছিল। যে সমাজ মহিলাদের শিক্ষার প্রতি চূড়ান্ত উদাসীন ছিল,
সেই সমাজে প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিরাই মেয়েদের শিক্ষার পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন। মেয়েদের স্কুলও প্রায় একচেটিয়া ভাবে পরিচালিত হতে শুরু করে তাঁদের দ্বারা।

ভারতে শিক্ষার মানচিত্রে প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্পষ্ট। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের ক্রিয়াকর্মের ভিত্তিতে কি আজকের ভারতের শিক্ষায় অসাম্যের ছবিটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এক শতাব্দীরও বেশি আগে প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের সংস্পর্শে আসা জেলাগুলিতে, অন্যান্য জেলার তুলনায়, আজ সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি। গবেষণায় আরও দেখা যাচ্ছে, প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের সংস্পর্শে না-আসা একটি জেলায় বসবাস করা মানুষের চেয়ে ঐতিহাসিক ভাবে প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের সংস্পর্শে আসা একটি জেলায় বসবাস করা মানুষের সাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৪.২ শতাংশ (মেয়েদের ক্ষেত্রে ৫.৫ শতাংশ), এবং স্কুলে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৩.৯ শতাংশ (মেয়েদের ক্ষেত্রে ৫.১ শতাংশ) বেশি। শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রোটেস্ট্যান্টদের সংস্পর্শে আসা জেলাগুলিতে বসবাস করা শিশুরা পড়তে পারার পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভাবে ভাল ফলাফল করে (কিন্তু গণিত বা লেখার পরীক্ষায় নয়) অন্য শিশুদের তুলনায়। অনুমান করা চলে যে, এটি সোলা স্ক্রিপটুরার নীতি অনুযায়ী মিশনারিদের মানুষের পড়ার ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গবেষণায় আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য জিনিস উঠে এসেছে। এক, প্রোটেস্ট্যান্টদের বসতি স্থাপন করা জেলাগুলিতে প্রাথমিক স্কুলগুলির বয়স গড়ে প্রায় দুই বছর বেশি অন্যান্য জেলার প্রাথমিক স্কুলগুলির তুলনায়। দুই, প্রোটেস্ট্যান্টদের বসতি স্থাপন করা জেলাগুলি উন্নয়নের নিরিখে অন্য জেলাগুলির থেকে আজ এগিয়ে। এবং তিন, প্রোটেস্ট্যান্টদের সংস্পর্শে আসা জেলাগুলিতে সামাজিক রীতিনীতি, বিশেষ করে লিঙ্গ-সংক্রান্ত রীতিনীতি, অন্য জেলাগুলির তুলনায় অনেকটাই ভাল। এই তিনটি জিনিসই, গবেষকদের মতে, ঘটেছে প্রোটেস্ট্যান্টদের কার্যকলাপের ফলে,
যা পরোক্ষ ভাবে দায়ী প্রোটেস্ট্যান্টদের সংস্পর্শে আসা জেলাগুলির আজকের শিক্ষার মানচিত্রের সঙ্গে অন্য জেলাগুলির শিক্ষার মানচিত্রের পার্থক্যের জন্য।

এই গবেষণা থেকে এটা পরিষ্কার যে, আজকের ভারতের শিক্ষা মানচিত্র নির্ধারণে ইতিহাসের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা এক দিকে যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধূসর হয়ে যাওয়া ইতিহাসের ভূমিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তেমনই অন্য দিকে নীতি-নির্ধারকদের স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, আজকের শিক্ষানীতি কেবল আজকের প্রজন্মের উপরেই ছাপ ফেলবে না, সেই নীতি হয়তো শতাব্দী পেরিয়ে নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ, ভারতের ভবিষ্যৎ। তাই শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা-সংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্তে যাতে কোনও ভাবেই কোনও গলদ না থাকে, সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতেই হবে।

অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement