বইবার শক্তি না থাকলে, পতাকা যতই বড় হোক, লাভ নেই। কুমিল্লার ঘটনায় বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিবাদ হল, বেশ বড় মাপের প্রতিবাদ, পথে নামল ছাত্র ও সংখ্যালঘুরা, কিন্তু এমন এক ফাঁক থেকে গেল, যা রীতিমতো দগদগে হয়ে রইল। দুর্গাপুজোর পরে ঢাকা-সহ নানা নগরের পথে-প্রান্তরে যে প্রতিবাদ হয়েছে, তাতে নাগরিক সমাজের কম উপস্থিতি জনতাকে উদ্বিগ্ন করেছে। তাঁরা বলেছেন, সামরিক স্বৈরশাসনের সময়েও এই সমাজ সরকারের সমালোচনা করত, সে কালের গতিপ্রকৃতির অনুঘটক তারাই। এখন কী ঘটছে, কেন ঘটেছে, তার চেয়েও জরুরি এই সমাজের অতীত চেহারা খুঁজে দেখা। বাঙালি রাষ্ট্রের জন্ম ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোয় যে ঐতিহ্যের ভূমিকা সুবিপুল, অর্ধশতবর্ষ উদ্যাপনে তাকে চেনার চেষ্টা করলে হয়তো ক্ষয়টুকুও বুঝে নেওয়া যাবে। দুশ্চিন্তা কিছু লাঘব হবে।
দেশভাগের পর উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপে পূর্ব পাকিস্তান ‘অশিক্ষিত’ ও ‘অযোগ্য’ হবে, নির্দ্বিধায় বলেছিলেন আবুল মনসুর আহমদের মতো বুদ্ধিজীবীরা। ’৪৭-এর ডিসেম্বরেই গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, নেতৃত্বে অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়া। বাংলাকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার— বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা— দাবি তোলে পরিষদ। এই দাবির অনুরণন ক্রমশ জনদরবারকেও আন্দোলিত করে, সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রেও অধিকার আদায়ে পিছপা হন না আইনসভার সদস্য শামসুল হক, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর পর ঘটনাপ্রবাহ রাজনীতির খাতেই চালিত, তবু ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ কলেজছাত্রদের সাধারণ ধর্মঘটের গুরুত্ব বিস্মৃত হওয়া যায় না, ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি তো ইতিহাস।
সুতরাং, বাহান্ন-র ভাষা আন্দোলন নাগরিক সমাজেই সূচিত— বাংলার অধিকারের দাবিতে সলতে পাকানো পর্বটির জন্ম সামাজিক পরিসরে। দেশভাগের পর থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিবাদই ক্রমশ রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, বুদ্ধিজীবীদের জোরেই তা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণাও জনতার হৃদয়ে গেঁথে দিতে কার্যকর হয় এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। জাতিরাষ্ট্রের গোড়ার দিকে বিশ্বমানসে বাঙালি পরিচিতি নির্মাণেও তাই এই সমাজের ভূমিকা বিরাট। মুক্তিযুদ্ধের কালে পাকিস্তানের রাইফেলের সামনে পড়েছেন শিক্ষক, উকিল, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মী— বিদ্বজ্জন সমাজ। ১৪ ডিসেম্বর যে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়, ১৯৭১-এ সেই এক রাতে খুন হয়েছিলেন দু’শো জনেরও বেশি বুদ্ধিজীবী। সাহিত্যিক আনোয়ার পাশা বা মুনীর চৌধুরী থেকে শিক্ষাবিদ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বা মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন— তালিকায় ছিলেন অসংখ্য বিশিষ্ট। যুদ্ধ শুরুর সময়, ২৫ মার্চেও খুন হয়েছিলেন বহু, বছরভরের হিসাবটি সহস্রাধিক। পাকিস্তানি সেনা বুঝেছিল, যুদ্ধ তারা হেরে গিয়েছে, অতএব যে রাষ্ট্র জন্মের অপেক্ষায়, তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে যথাসম্ভব মুছে দেওয়ার চেষ্টা। সঙ্গে জুটেছিল শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বাদর, আল-শামস’এর মতো পূর্বের পাকিস্তানপন্থীরাও।
১৯৭০ এবং তৎপরবর্তী তিন দশকে দেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে নাগরিক সমাজ। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতি অগণতন্ত্রের কানাগলিতে ঢুকে যেতেই aপারত, এক দশকের স্বৈরাচারে তা খানিক দূর প্রোথিতও হয়েছিল, কিন্তু ১৯৮৭-র মার্চে ৩১ জন বুদ্ধিজীবীর যৌথ বিবৃতিতে উদারমনস্ক মানুষ এক জায়গায় হতে পেরেছিলেন। ১৯৯০-এ সাংবিধানিক পথে নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে তিন জোটের যে যৌথ ঘোষণা হয়, তাতেও নাগরিক সমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের কথা বলতেই হয়। ১৯৮০’র দশক জুড়েই সংস্কৃতিকর্মী, সমাজকর্মী ও ছাত্রদল রাজপথে যে আন্দোলন করেছিল, যেখানে ‘ঢাকা অবরোধ’-এর স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল, সেখানেই বোনা হয়ে গিয়েছিল ১৯৯১ পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের ভিত, যা একুশ শতকের আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের পূর্বসূত্র।
এর পর দেড় দশক ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এবং, বরাবরই জনস্বার্থে— বিশেষ করে দুর্নীতি ঠেকাতে— কথা বলে গিয়েছে নাগরিক সমাজ। তার চেহারায় এসেছে বিবর্তন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এক বিশেষ অভিজ্ঞান অজস্র স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, উন্নয়নে তো বটেই, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে চলাতেও যাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। নানা সমাজ সংস্কারের শরিক সংগঠনগুলি, দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগে এবং রাজপথের আন্দোলনে। চলতি শতকের কুড়ির দশকে এই স্তম্ভকে আরও শক্তি জুগিয়েছেন ‘অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট’রা। মুক্তমনে স্বর তুলে অভিজিৎ রায়ের খুনের ঘটনা তো বিশ্ব-দরবারকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০০৬-০৮ রাজনৈতিক সঙ্কট অথবা ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময়ে তাঁরাই সামনের সারি থেকে দাবি সাজিয়েছিলেন— রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন রুখতে, মুক্তিচেতনা জাগিয়ে রাখতে।
এই মুহূর্তে বহু বুদ্ধিজীবীর বর্তমান সরকারের পক্ষাবলম্বনই নাগরিক আন্দোলনের দুর্বলতার কারণ। তাঁদের জনপ্রিয় যুক্তি, বর্তমান সরকার স্বৈরাচারী হলেও বিরোধী পক্ষ সাম্প্রদায়িক, যে কোনও মূল্যেই এদের টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু যদি সবই খোয়াতে হয়, এমনকি সমাজ সংস্কারের আস্ত পরিসরটিও, তবে দিনের শেষে হুমায়ুন আজাদের শঙ্কাবাক্যই স্মরণে আসে: ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’?