মৌলবাদীরা যেন প্রতিবাদের দখল না নিতে পারে
RG Kar Medical College and Hospital Incident

ঘুরে দাঁড়ানোর দিন

যে ছবিটি প্রকট হয়ে উঠল, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে এবং দেশের আরও বহু প্রান্তে দুর্নীতি ও অপরাধের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন মেয়েদের প্রতি হিংস্রতা ও দুর্ব্যবহারের কথা।

Advertisement
কৌশিক বসু
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:১৩
দাবি: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর, কলকাতা।

দাবি: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

৯ অগস্ট তারিখটি পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতের ইতিহাসে এক অনপনেয় লজ্জার দিন হিসাবে থেকে যাবে। ক্যালেন্ডারের পাতায় এই দিনটি মনে করিয়ে দেবে, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কী ভাবে এক তরুণী চিকিৎসক ভয়ঙ্কর ভাবে ধর্ষিতা হয়েছিলেন, কতখানি নিষ্ঠুর ভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং, সেই নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে এসেছিল রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতির অবিচ্ছেদ্য সংযোগের বহুবিধ কঙ্কাল। আমি কলকাতা থেকে অনেক দূরে আছি, কিন্তু এই একটা শহরের প্রতি টান কখনও যাওয়ার নয়— সম্ভবত সে কারণেই এই শহরে যে ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে একই সঙ্গে প্রবল রাগ হচ্ছে, লজ্জিতও লাগছে।

Advertisement

তবে, এই সুতীব্র অন্ধকারকে ভেদ করে আশার আলো খুঁজতে হবে— এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলকাতা যে ভাবে জেগে উঠল, তাতে। প্রবীণ ও নবীন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী’সহ শহরের বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী, এবং সাধারণ মানুষ— এই ঘটনায় যাঁদের কোনও ব্যক্তিগত ক্ষতি ছিল না, যাঁদের কোনও দায় ছিল না, যাঁদের কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি প্রকট আনুগত্য নেই, তাঁরা যে ভাবে শহরের রাস্তা দখল করলেন, প্রতিবাদে মুখরিত করলেন শহরকে, তাতে আশাবাদী না হওয়া অন্যায়। নিহত চিকিৎসকের পরিবার ও বন্ধুদের কাছে এ ক্ষতি অপূরণীয়। তাঁদের শুধু এটুকুই বলার যে, মেয়েটিকে ‘আক্রান্ত’ না ভেবে শহিদ ভাবছি আমরা— এমন এক শহিদ, যিনি চরম আত্মবলিদান করে সমাজের সর্বাঙ্গে যে ঘুণ ধরেছে তাকে গোটা দুনিয়ার চোখের সামনে নিয়ে এলেন।

যে ছবিটি প্রকট হয়ে উঠল, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে এবং দেশের আরও বহু প্রান্তে দুর্নীতি ও অপরাধের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন মেয়েদের প্রতি হিংস্রতা ও দুর্ব্যবহারের কথা। এবং, এগুলো ব্যক্তিবিশেষের কাজ নয়— রাজনৈতিক ছত্রছায়া ব্যতীত এই ঘটনাগুলি যে ঘটতে পারে না, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশমাত্র নেই। এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমাদেরও ভাবা প্রয়োজন, এ বার কোন পথে হাঁটব। যে ছাত্ররা প্রতিবাদী মিছিলে পা মেলাচ্ছেন, যে সাংবাদিকরা প্রতি দিনের ঘটনাক্রম প্রত্যক্ষ করছেন এবং দর্শক-পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, যাঁরা খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছেন শহরজোড়া প্রতিবাদের ঢেউ, তাঁদের প্রত্যেকেরই কিছু শেখার, ভাবার আছে। রাজনৈতিক নেতাদের তো আছেই।

যাঁরা প্রতিবাদে শামিল, তাঁদের মনে রাখতেই হবে যে, উদ্দেশ্য যতই মহৎ হোক, যতই সদিচ্ছা থাকুক, ‘পাল্টে দেওয়া’-র আন্দোলনের পথে বিপদ অনেক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, বিপুল সদিচ্ছা নিয়ে শুরু হয়েছিল, এমন বহু প্রতিবাদ বা বিপ্লব মাঝপথে দখল হয়ে গিয়েছে, এবং তাকে ব্যবহার করা হয়েছে বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয় সৃষ্টি করতে। ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত দুটো বিদ্রোহের উদাহরণ দেওয়া যায়— ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, এবং ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছিল সে দেশের চরম অসাম্য এবং শ্রমিকদের বিপুল শোষণের প্রতিক্রিয়ায়। অথচ, কয়েক দশক পরে দেখা গেল, কোনও কমিউনিস্ট স্বর্গ রচিত হয়নি সে দেশে, বরং সাঙাততন্ত্রের চরমতম রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সোভিয়েট ইউনিয়নে।

শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসকে যদি অনেক দূরের ঘটনা বলে মনে হয়, তা হলে গত দশকে পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় ঘটে যাওয়া আরব বসন্তের মতো বিপ্লবগুলির কথাও ভাবা যেতে পারে। সেই বিপ্লবগুলির সূচনা হয়েছিল একটি প্রগতিশীল আন্দোলন হিসাবেই। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তার দখল নিলেন একনায়করা, ধর্মীয় মৌলবাদীরা। যে দেশগুলি প্রগতির পথে হাঁটতে চেয়েছিল, সেগুলি নিক্ষিপ্ত হল গভীরতর অন্ধকারে। কাজেই, দুনিয়ার যে প্রান্তে যিনি কোনও প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন, তাঁকে মনে রাখতেই হবে যে, এই আন্দোলন এক উন্নততর দুনিয়া তৈরি করার উদ্দেশ্যে; তাকে কোনও ভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদের ফাঁদে পড়তে দেওয়া যাবে না। ভারতেও কোনও আন্দোলন যদি ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের হাতে অপব্যবহৃত হয়, তা দেশকে পিছিয়ে দেবে অনেকখানি।

দুনিয়ার উদাহরণ থেকে রাজনৈতিক নেতাদেরও শেখার আছে অনেক কিছুই। তাঁদের প্রথমে শিখতে হবে, কী ভাবে থমকে দাঁড়াতে হয়, কী ভাবে নিজের আচরণ নিয়ে ভাবার মতো বিনয় ও মানসিক উদারতা অর্জন করতে হয়। শিখতে চাইলে, দুনিয়ার ইতিহাস তাঁদের শেখাতে পারে, ক্ষমতা কী ভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিপথে চালিত করতে পারে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা যখন প্রথম ক্ষমতায় এলেন, তিনি পরিবর্তনের সম্ভাবনা, উন্নতির আশা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি আন্তরিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন তো বটেই, বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থার জন্যও অনেক কিছু করেছিলেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ যখন মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতকে টপকে গেল, তখন গোটা দুনিয়া বিস্মিত হয়েছিল। মাত্র এক দশক আগেও এমন ঘটনা একেবারে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি সমালোচনার প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে শুরু করলেন, ক্রমে একনায়কতন্ত্রী হয়ে উঠলেন। তার পরিণতি সুখকর হয়নি। নিকারাগুয়াতে অত্যাচারী একনায়ক সোমোজ়াকে সরিয়ে ড্যানিয়েল ওর্তেগা যখন ক্ষমতা দখল করলেন, তখন তিনিও তাঁর দেশবাসীর কাছে, সমগ্র দুনিয়ার কাছে ছিলেন এক সম্মাননীয় নেতা, আশার প্রতীক। তিনি নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সদর্থক পরিবর্তনের আশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টে গেলেন, হয়ে উঠলেন স্বৈরাচারী একনায়ক— যে কোনও বিরোধিতাকেই যিনি নির্মম ভাবে গুঁড়িয়ে দিতে চান।

ইতিহাসের ছত্রে-ছত্রে এমন নেতার উদাহরণ রয়েছে— যাঁরা ভাল থেকে ক্রমে খারাপ শাসকে পরিণত হয়েছেন। তবে, সৌভাগ্যক্রমে এমন কিছু উদাহরণও রয়েছে, যেখানে কোনও অত্যাচারী শাসক শেষ অবধি সুশাসকে পরিণত হয়েছেন। অস্বীকার করা যায় না যে, এমন উদাহরণ সংখ্যায় কম। তবুও, উদাহরণ আছে। জ়াম্বিয়ার কেনেথ কাউন্ডার কথাই বলি। তিনি ছিলেন ঘোর একনায়ক। কিন্তু ক্রমে পাল্টে গেলেন তিনি, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দল তৈরি হতে দিলেন, সেগুলির জন্য রাজনৈতিক পরিসর খুলে দিলেন। ভারতও তো এমন ঘটনা দেখেছে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী স্বৈরশাসনের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু, নিজের সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচন আয়োজন করেন। কোনও বাধা ছাড়াই নির্বাচনটি হতে দেন। সে নির্বাচনে ইন্দিরা পরাভূত হয়েছিলেন, ক্ষমতা হারিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ভারতের আত্মাটিকে রক্ষা করেছিলেন। আমরা কি আশা করতে পারি না যে, ভারতের এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের বর্তমান নেতারাও নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো বিনয় তাঁদের থাকবে, এবং নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে তাঁরা প্রকৃত সদিচ্ছার পরিচয় দেবেন, দেশকে নিয়ে যাবেন প্রকৃত উন্নতির পথে?

কাকে বলে প্রকৃত উন্নতি, সে কথাটিও ভেবে দেখা জরুরি। একটি উন্নত সমাজ, উন্নত অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করা, আয় বাড়িয়ে চলা, আরও বেশি সমৃদ্ধি অর্জন করাই যথেষ্ট নয়। প্রকৃত উন্নতির জন্য প্রয়োজন মৌলিক মূল্যবোধগুলির প্রতি অবিচলিত আস্থা। ধর্ম বা পূজা-প্রার্থনা নয়, মৌলিক মূল্যবোধ মানে সততা, সহানুভূতি, অন্য মানুষের প্রতি ভালবাসা।

আশা করতে ইচ্ছা করে যে, ৯ অগস্ট তারিখটি ইতিহাসে শুধু লজ্জার এক অন্ধকার দিন হিসাবেই থেকে যাবে না, এই তারিখটিকে মনে রেখেই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোও শুরু হবে। আশা ও আলোর দিনের সূচনা হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement