গরিব মুসলমানদের ঘরে আগুন লাগানো থেকে তাদের নৌকা নদীতে ডোবানো অবধি সন্দীপের যাবতীয় নিষ্ঠুরতার কথা বলে যখন তাকে আব্রুহীন করে দিতে থাকে নিখিলেশ, ঠিক তখনই জানলার কাছে দাঁড়িয়ে নির্বাক বিমলা, পিছন ফিরে থাকায় তার মুখখানি দেখতে পায় না সন্দীপ বা নিখিলেশ, কেউই। একবার শুধু মুখটা ঈষৎ ফেরায় বিমলা, বোধ হয় অভাবিত কিছু শোনার প্রতিক্রিয়ায়। অথচ, একটু আগেই সে ও-ঘরে এসেছিল স্বর্ণমোহর সঙ্গে নিয়ে, ব্রিটিশ-শাসন থেকে দেশমুক্তির আন্দোলনে সন্দীপকে সাহায্য করতে।
নিখিলেশ যখন বলে ওঠে সন্দীপকে “তুমি বক্তৃতায় হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের কথা বলো, কিন্তু কাজের বেলায় গরিব মুসলমানদের উপর অত্যাচার করো..,” বা “দেশোদ্ধারের নামে দেশের ক্ষতি করো,” বাক্স্তব্ধ বিমলা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না।
সংলাপরহিত বিমলার এই অনুভূতিগুলি প্রায় সাবটেক্সটের মতো গোটা ঘরে-বাইরে (ছবিতে একটি দৃশ্য) চলচ্চিত্রে বুনে গিয়েছেন স্বাতীলেখা। অ্যান্ড্রু রবিনসনকে জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ, কেন তিনি নির্ভর করেছিলেন স্বাতীলেখার উপর। রবীন্দ্রনাথকে মেনেই স্ট্রিরিয়োটাইপ সুন্দরী চাননি তিনি, অভিনয়-ক্ষমতা ছাড়াও চেয়েছিলেন ‘ব্যক্তিত্ব’, যা বিমলা চরিত্রের চাবিকাঠি, এই দুই গুণ ছাড়াও স্বাতীলেখার মধ্যে পেয়েছিলেন তিনি “দি ইনটেলেক্ট টু আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট শি ওয়াজ় ডুয়িং।” (দি ইনার আই, ১৯৮৯)
স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের আকস্মিক প্রয়াণে সত্যজিতের ছবির উল্লিখিত দৃশ্যটি শুধু তাঁর শতবর্ষে আমাদের স্মৃতিতেই ফিরে এল না, তাঁর সেই অভিনয়ের সূত্র ধরে খেয়াল করিয়ে দিল যে সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদের জিগির জারি ছিল স্বদেশি আন্দোলনেও। সেই জন্যেই নিখিলেশকে হিন্দু সমাজের নেতৃস্থানীয়দের ডেকে সতর্ক করতে হয়েছিল মুসলমানদের প্রতি হিংসাকে প্রশ্রয় না দিতে, “মুসলমানদের নিজেদের ধর্মমতে চলতে দিতেই হবে... ভারতবর্ষে মুসলমান আছে, এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য, এ সত্য আমাদের মানতেই হবে, মুসলমানদের বাদ দিয়ে ভারতবর্ষ কল্পনা করা যায় না।” বলেছিল নিখিলেশ, ছবির একটি দৃশ্যে।
ভারতীয় রাজনীতিতে যেমন মুসলমানদের আমরা ‘অপর’ হিসেবে কোণঠাসা করে রেখেছি, ভারতীয় সমাজেও তেমনই ‘অপর’ করে রেখেছি মেয়েদের, এই দুই ‘অপর’কে নিয়েই কিন্তু নিজের ছবির ‘অরগ্যানিক ইউনিটি’ তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৮৫-র জানুয়ারিতে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি, এর চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই হিন্দুত্বের রাজনীতি প্রবল হয়ে ওঠে ভারতে।
মুক্তির পর সত্যজিতের ছবি নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে তাঁর অবলম্বন নিয়ে। তর্কের জেদাজেদিতে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় যে এক সেরা ঔপন্যাসিকের সঙ্গে এক সেরা চলচ্চিত্রকারের নান্দনিক মিথস্ক্রিয়ায় কী বৈভব তৈরি হতে পারে।
নিখিলেশ-সন্দীপ-বিমলা, এই তিন চরিত্রের ‘আত্মকথা’ রচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসের অবয়ব গড়ে নিয়েছিলেন, অন্য দিকে সত্যজিৎ কেবল বিমলার ব্যক্তিচেতনাকেই বিভিন্ন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় জড়িত করে বানিয়ে তুলেছিলেন নিজের শিল্পকাঠামো, তাঁর ছবির নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখই ছিল বিমলার ‘জার্নি’, তার ‘অন্দর’ থেকে ‘বাহির’ যাত্রা।
নিখিলেশ কিন্তু আলোকপ্রাপ্ত ‘অন্দর’ দিতে চেয়েছিল বিমলাকে, তার প্রাচ্যের বনেদি দৈনন্দিনে নিখিলেশ এনে ফেলেছিল পশ্চিমি অভিঘাত, শিক্ষা-সঙ্গীত-পোশাকের বাতাবরণে। পর্দাপ্রথা পেরিয়ে তাকে পৌঁছে দিয়েছিল স্বামী-ভিন্ন দ্বিতীয় পুরুষের কাছে। অন্তঃপুরবাসিনী বিমলার মন এতে সাড়া দিয়েছিল, তবু তার মনে হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে নিখিলেশের এই সাবেকিয়ানা ভাঙার চেষ্টা খানিকটা তার নিজেরই ‘শখ মেটাতে’।
আবার রঙিন শার্সি দেওয়া বারান্দার বন্ধ দরজা খুলে বিমলা যখন ‘বাহির’-কে পেল সন্দীপের মধ্যে, তখন তার মনে হল, “বাংলা ভাগ করে যদি ইংরেজ সরকার অন্যায় করে থাকে, তা হলে তার বিরুদ্ধে স্বদেশি করলে যদি তাদের টনক নড়ে, করাই উচিত।”
কিন্তু বিমলার সেই ‘বাহির’, সেই দেশাত্মবোধের উদ্দীপন খানখান হয়ে যায়, যখন সে টের পায় আদতে প্রতাপ-প্রভুত্বের রাজনীতি করে সন্দীপ, নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে পরধর্মে অসহিষ্ণু হতেও বাধে না তার।
আচমকা এই উপলব্ধিতে একবারে নিশ্চুপ হয়ে যায় বিমলা, উল্লিখিত দৃশ্যটিতে। ফের যখন দেখা হয় সন্দীপের সঙ্গে, সে বলতে থাকে, “সুর কেটে গেছে সন্দীপবাবু...,” এমন নিরাসক্ত অভিব্যক্তিতে ছেয়ে থাকে বিমলার মুখ যে তাতে ফুটে ওঠে কাঠিন্য। সন্দীপ ও তার কাজের প্রতি আর যে কোনও বিশ্বাস নেই, সেই কথা বোঝাতে বিমলা যখন সামান্য মাথা নেড়ে বলে “নাহ”, বিচ্ছেদের অমোঘ মুহূর্ত তৈরি হয়ে যায়।
বা, বলা যেতে পারে, তৈরি করে দেন স্বাতীলেখা। অন্দর, বাহির, আর শেষ পর্বের শূন্যতা পেরোনোর যে অমসৃণ চলন, অনুভূতির ক্ষয়— তা বিমলার চেহারাছবিতে লেপে দেন স্বাতীলেখা।
পুরনো সম্পর্কে চাইলেই যেমন ফেরা যায় না, তেমনই সত্যজিতের ছবিতে নিখিলেশের কাছেও ফিরতে পারেনি বিমলা, যদিও নিখিলেশের মৃত্যুর আগে তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিল সে। “কিন্তু এত কাছাকাছি আসার মানে যদি দর্শক ভাবেন, যে মেয়েরা বাইরে বেরোলে বিপর্যয় হবেই, আর তার সমাধান অন্দর আর ঘরকন্নাকে একমাত্র সত্যি বলে মেনে নেওয়ায়, সেটা কিন্তু খুব ভুল হবে।” সতর্ক করেন সত্যজিৎ, রুশতী সেন-কৃত এক সাক্ষাৎকারে (বারোমাস, মার্চ ১৯৮৫)।
পরাধীন দেশে বিমলা যেমন তার ঘর ফিরে পায় না, তেমন আবার বাইরেটাকেও তো তার চেনাই হল না প্রকৃত অর্থে। সমস্যাটা কি শুধু পরাধীন দেশের, স্বাধীন দেশেরও নয়? পুরুষশাসন, পুরুষের তৈরি সামাজিক কাঠামো কি এখনও একই ভাবে বহাল নয় সেই পরাধীন আমল থেকে এই স্বাধীন ভারতেও? না হলে কেনই বা গত শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত উপন্যাস নিয়ে প্রায় সত্তর বছর পর আশির দশকে এসে ছবি করতে উদ্যত হবেন সত্যজিৎ?
ওই সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বলেন: “নিখিলেশের মৃত্যুর পর বিমলার জন্য তো সেই পুরনো অন্দর ছাড়া আর কিছু রইল না। ইচ্ছে নিখিলেশের যাই থাক, তাকে কাজে পরিণত করতে সে ব্যর্থ।... এটা ব্যক্তিগত গুণাগুণের প্রশ্ন নয়, ব্যর্থতার কারণটা আরো অনেক জটিল একটা গোটা ব্যবস্থায়, তার থেকে কেউই বেরতে পারছে না।”
সত্যজিতের ছবি মুক্তির পরও তো আরও ছত্রিশ বছর কেটে গেল, ‘ব্যবস্থা’ কি আদৌ কিছু বদলাল?