Doctors

ছবিতে যে ডাক্তারদের দেখেছি

ডাক্তার জীবাণু চেনেন, তাকে পরাস্ত করার নিদান জানেন। সামাজিক সংস্কার ও দুর্নীতি দূর করতে তাই গণশত্রুকে চিনিয়ে তিনিই হতে পারেন সিনেম্যাটিক উপস্থাপনার অন্যতম চরিত্র।

Advertisement
গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৫২

ডাক্তারকেই ক্ষতে হাত দিতে হয়, নাড়ির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হয়, প্রয়োজনে মূল ধারার সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। সপ্তপদী ছবির শেষে রিনা ব্রাউন যেমন জানতে পারে, তার হারিয়ে-যাওয়া প্রেমিক কৃষ্ণেন্দুই নিজে সব দায়িত্ব নিয়ে তার অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছে। নার্স এসে রিনাকে জানায়, ডাক্তার মুখার্জি বলেছেন, আমার স্ত্রীর সব দায়িত্ব আমার। সিনেমা জানিয়েছে, দু’জনের মধ্যে প্রথাগত বিয়ে তখনও সম্পন্ন হয়নি। সামাজিক প্রথার গণ্ডি ভেঙে সমানুভূতি নিয়ে চিকিৎসা, এখানেই বাংলা ছবির ডাক্তারের মেরুদণ্ড!

Advertisement

স্বাধীনতা, মায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঢের আগে, ১৯৪০ সালে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে মুক্তি পেয়েছিল ফণী মজুমদারের ছবি ডাক্তার। ডাক্তার নায়ক কী ভাবে গ্রামে এসে বিভাজন ও সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে জমিদার বাবার ঘর ছাড়ে, খ্রিস্টান প্রেমিকাকে বিয়ে করে তা নিয়েই ছবি। সাড়ে আট দশক আগের সেই ছবি না দেখে থাকলেও ক্ষতি নেই, জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭ সালে শক্তি সামন্ত সেই ছবি উত্তম, শর্মিলাকে নিয়ে পুর্ননির্মাণ করেছিলেন আনন্দ আশ্রম! স্বাধীনতা আন্দোলন বা জরুরি অবস্থার পরে দেশগঠন, সামাজিক কুপ্রথা ও জাতপাত এবং ধর্মীয় বিভাজনের সংস্কারের বিরুদ্ধে বাংলা ছবি সব সময় ডাক্তার চরিত্রকেই আশ্রয় করেছে। অতএব, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির বাইরে ডাক্তারেরা যখন আজ লালবাজার বা স্বাস্থ্যভবনের সামনে বিচার চেয়ে প্রতিবাদী অবস্থানে, জনসমাজ নিজে থেকেই ত্রিপল, জলের বোতল, খাবার নিয়ে এগিয়ে আসে, এতে আর আশ্চর্য কী!

চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠানের বাইরে রাজপথে গণ-অবস্থানটা মূল্যবান। কয়েক বছর আগেও ভুল চিকিৎসা ও নানা অভিযোগে জুনিয়র ডাক্তারেরা মাঝে-মাঝেই গণধোলাইয়ের শিকার হতেন। বাম আমলে, ১৯৯৯ সালে অঞ্জন চৌধুরীর সাড়াজাগানো ছবি ছিল জীবন নিয়ে খেলা। রঞ্জিত মল্লিক গ্রামের এক সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু স্থানীয় নেতার অনুপ্রেরণায় তাঁর উপরওয়ালা একটি নার্সিং হোম চালান। রোগীদের সরকারি হাসপাতাল থেকে ভুলিয়েভালিয়ে সেই দামি নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া, মৃতকে ভেন্টিলেটরে রেখে জীবন্ত দাবি করে আরও উপার্জনই তাঁদের লক্ষ্য। রঞ্জিত এ সবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, ছবির শেষে প্রশাসন তাঁকে বদলি করে দেয়, কিন্তু গ্রামবাসীদের বিশাল মিছিল এগিয়ে আসতে থাকে। ডাক্তারবাবুকে তাঁরা যেতে দেবেন না।

ডাক্তার জীবাণু চেনেন, তাকে পরাস্ত করার নিদান জানেন। সামাজিক সংস্কার ও দুর্নীতি দূর করতে তাই গণশত্রুকে চিনিয়ে তিনিই হতে পারেন সিনেম্যাটিক উপস্থাপনার অন্যতম চরিত্র। পেশাদারি সংগঠন ও দক্ষ চিকিৎসকের মধ্যে কত যে ফারাক! ডাক্তার জনসমাজে আদৃত, অস্ত্রোপচারে রোগিণীকে বাঁচিয়ে দেন, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ না করার জন্য সংগঠনের হর্তাকর্তাদের কাছে কী ভাবে তাঁকে তিরস্কৃত হতে হয়, দেখা গিয়েছিল ১৯৬২ সালেই যাত্রিকের কাঁচের স্বর্গ ছবিতে। চিকিৎসা বা সেবা মনোভাবের বদলে যেন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ও সরকারি নিবন্ধকরণই মুখ্য। ওই রন্ধ্রপথেই যে আজ লাখ লাখ টাকার হাতবদল, অন্যথায় নিবদ্ধীকরণ না করতে দেওয়ার ধমকানো চমকানোর অভিযোগ ঢুকবে, সে আর আশ্চর্য কী! সংবাদ সত্য, কিন্তু সাহিত্য ও সিনেমা আরও গূঢ়তর সত্য।

খারাপ এবং অসৎ ডাক্তার অবশ্য যুগে যুগেই। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর গল্প অবলম্বনে সন্ন্যাসী রাজা ছবিতে ডাক্তার রোগীকে শুধু ভুল ওষুধ দেন না, শেষে রিভলভারের গুলিতে রানিকে নিকাশ করেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস কাল তুমি আলেয়া ছবিতে সুপ্রিয়া এক ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার ডাক্তার। সেই সংস্থার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বহুবিধ দুর্নীতিতে ডাক্তারকে এক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়। আশুতোষবাবুর আর এক উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি আমি সে ও সখা ছবিতে উত্তমকুমার সৎ ডাক্তার, তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু অনিল চট্টোপাধ্যায় আবার অসৎ। সৎ বনাম অসৎ ডাক্তারের এই গল্প বাংলা ছবির প্রান্তর ছাপিয়ে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও এত প্রভাব ফেলেছিল যে ওই গল্প অবলম্বনে অমিতাভ, রাখী ও বিনোদ মেহরাকে নিয়ে তৈরি হয় হিন্দি ছবি বেমিশাল। নীহাররঞ্জন গুপ্ত নিজে ডাক্তার ছিলেন, তাঁর বিখ্যাত কিরীটি কাহিনি কালো ভ্রমর-এর খলনায়ক এক ডাক্তার। প্রতিষ্ঠান কবেই বা ডাক্তারি ছাত্রদের মত মেনে নিয়েছে? প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে যে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিল, সেই সিদ্ধার্থ আদতে ডাক্তারির ছাত্র, বাবার মৃত্যুর পর খরচের ভয়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। খরচ যে কতটা, তা বোঝা যায় প্রতিদ্বন্দ্বীর কয়েক দশক পর ঋতুপর্ণ ঘোষের উনিশে এপ্রিল ছবির এক দৃশ্যে। ডাক্তারি পাশ করা, প্রবাসী কন্যা দেবশ্রীকে অপর্ণা সেন এক জায়গায় বলেন, ‘তোমার বাবার মৃত্যুর পর তোমাকে অনেক খরচ করে ডাক্তারি পড়াতে হয়েছে।’

বাংলা সিনেমার আর এক ডাক্তার সব্যসাচী ছবির নায়ক, জেলখাটা বিপ্লবী সব্যসাচী-র চরিত্রে উত্তমকুমার। শরৎচন্দ্রের পথের দাবী উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবিতে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা এই বিপ্লবী ডাক্তার বুঝিয়েছিলেন, কর্মচারীরা রাজার ভৃত্য, মাইনে পায়, হুকুম তামিল করে।

প্রতিবাদী ডাক্তার শুধু বাঙালি জীবন নয়, তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম চরিত্র। এই বঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাঁর মৃত্যু নিয়ে অপরাধবোধের কথা কবিতায় লিখে গিয়েছেন, সেই চে গেভারাও ছিলেন ডাক্তার। তরুণ বয়সে এক বন্ধুর সঙ্গে মোটর সাইকেলে দেশসফরে বেরিয়েই তাঁর চোখে কিউবার তৎকালীন অনাচার, অত্যাচারের জীবাণু ধরা পড়ে।

আর আজকের বাংলা? অগ্নীশ্বর সিনেমার শেষ দৃশ্যে মৃত্যুপথযাত্রী উত্তমকুমারের হাত থেকে শরতের শিউলি ফুল পড়ে যায়, কলকাতা থেকে আসা পুলিশের ডিআইজি দিলীপ রায়কে তাঁর শেষ সংলাপ, “চিফ মিনিস্টারকে বোলো, এই গরিব মানুষগুলিকে একটু দেখতে।”

আরও পড়ুন
Advertisement