সে দিন রাত সাড়ে ন’টায় একটি টিভি চ্যানেলে দেখা ছোট একটা দৃশ্য যুগপৎ মনকে ছুঁয়ে ও আশঙ্কিত করে গেল। প্রতিবেদক এক প্রাইমারি শিক্ষকের অসাধ্য সাধনের কথা বিবৃত করছিলেন ফুটেজের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের কোনও একটি আদিবাসীপ্রধান গ্রামের ভিডিয়ো ফুটেজ— গ্রামের একটি পাড়ার রাস্তা, যার দু’দিকেই সারি সারি কাঁচা বাড়ির দেওয়াল। সে সব দেওয়াল জুড়ে সহজ পাঠ বইয়ের পাতাগুলি জীবন্ত! মাটির দেওয়ালের গায়ে কালো রং ব্যবহার করে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ এবং সম্ভবত আচার্য নন্দলাল বসু সৃষ্ট সেই অনুপম ছবিগুলিও আঁকা হয়েছে। কচিকাঁচা এক পাল ছেলেমেয়ে সেই দু’ধারে বাড়ির মধ্যিখানের রাস্তাখানা সাময়িক জবরদখল করে একটি ইস্কুল পেতেছে। এক ব্যক্তি তাদের পড়াচ্ছেন। এক ঝলক দেখা। তার চেয়েও কম শোনা। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার যে অস্তিত্ব-সঙ্কট, এক লহমায় যেন তার তৃতীয় বিকল্পটির ধরতাই দিয়ে গেল এ ফুটেজ। এ ভাবেই তো হতে পারে!
অস্তিত্বের সঙ্কট। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদেরও। এক জন শিক্ষক হিসাবে শিশুদের কী দিচ্ছি, সে প্রশ্ন যদি কেউ মুলতুবিও রাখেন, বেতনভুক এক জন সরকারি কর্মী হিসাবে আমাদের ভূমিকাটা ঠিক কী? দেখতে দেখতে অসহায় অক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবসাদের নিষ্কর্মা ছুটিতে শিক্ষক থেকে ক্রমশ শ্রেণিশত্রুতে বদলে গেলাম। এ দিকে রাষ্ট্রের ও সমাজের উদাসীনতায় দেশের আগামী দিনের কান্ডারিরা ধূলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে!
বেহাল শিক্ষাব্যবস্থার হাল ফেরাতে যে কোনও মূল্যে রাষ্ট্রকে তৃতীয় বিকল্প খোঁজার উদ্যোগ সুনিশ্চিত করতে হবে। দিতে হবে অগ্রাধিকার। দৃষ্টান্ত হিসাবে এ রাজ্যে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত সওদাগরি আপিসের কেরানি প্রস্তুতকারী শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে খোদ রবি ঠাকুরের জলজ্যান্ত প্রতিষ্ঠানটাই কি যথেষ্ট নয়? বিশ্বভারতীর উদাহরণ থাকতে ওই ছোট ছোট গৃহবন্দি শিশুদের অনলাইনে মোবাইল ফোনে মুখ গুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেখাপড়ার নামে আদতে কী গেলানো হচ্ছে? ইস্কুল বিল্ডিংয়ের চার দেওয়ালের ক্লাসরুম ভেঙে খোলামেলা পরিবেশে, প্রকৃতির কোলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শে প্রতিটি স্কুলের চৌহদ্দিতে আমরা সমস্ত শিক্ষকরা সপ্তাহের ছ’টা দিন ছ’টি ক্লাসের পড়ুয়াদের আসার ব্যবস্থা করতে পারতাম; মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার ও দূরত্ববিধি কাঁটায় কাঁটায় মেনে সব শিক্ষক ভাগ ভাগ করে নাহয় সহজ একটা বিশেষ পাঠ্যক্রম ঠিক করে নিয়ে সেটাই পড়াতাম! পারতাম না?
দাঁতে দাঁত চেপে বিকল্প খোঁজার দায়বদ্ধতা ছিল কারও কারও। ওই যে সেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, উনিই ঠিক পথটি বার করে তাতে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন। এখনও যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকেই পারি কাজটা করতে— সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের। আমাদের এলাকায় কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উদ্যোগে এমন আর একটি প্রচেষ্টা জোরকদমে চলেছে। নাম তার ‘চলমান পাঠশালা’। সেখানে আশেপাশের নানান বয়সি, নানান স্কুলের শিশুরা এসে জড়ো হচ্ছে আর তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে নিয়ে মূলত পড়া দেখিয়ে দিচ্ছে অপেক্ষাকৃত বড় আর এক দল শিক্ষার্থী, যারা নিজেরা কলেজে উঠেছে এই লকডাউনেই।
এই বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টাগুলিকেই জেলাগুলির চক্র অনুযায়ী যথাযথ পরিচালনা করে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্রেমে বাঁধা যায় না? শিক্ষার্থী যদি স্কুলে না আসতে পারে, তা হলে আমরা পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছতে পারি। তাদের নিয়ে গান, নাটক, নানান হাতের কাজ, গল্প শোনা-বলা, ছোট ছোট স্বরচিত গদ্য লেখা হতে পারে না! কত যে ছোট ছোট ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেল, কত ছাত্র স্কুলছুট হয়ে চলে গেল ভিনদেশে রুজির খোঁজে। এরা চলে যাওয়ার আগে এক বার যদি সাক্ষাতের সুযোগ থাকত, আটকানোর একটা চেষ্টা করা যেত!
সপ্তাহ দুয়েক হল রাজ্যে স্কুল খুলেছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে ষোলো বছর শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতায় জানতাম যে, ছেলেমেয়েদের উপস্থিতির হার কমই থাকবে। কারণ, অঘ্রানের নতুন ধানে চারিদিকের মাঠ এখন সোনায় মোড়া। ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই মাঠে ধান কাটছে। ধান কাটা চুকলেই ওরা হাজির হবে, কিন্তু পেটে খিদে নিয়ে বিকেল পর্যন্ত তারা কি থাকতে পারবে স্কুলে? মিড-ডে মিলের রাঁধা ভাত যে ওদের বেছে নেওয়ার ব্যাপার নয়, মৌলিক চাহিদা! সকলেই অবগত— অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই খাবার ধার্য হলেও মানবিকতার খাতিরে বহু স্কুলে বড় ছেলেমেয়েদের বাড়ি থেকে আনা মুড়িটুকু খাওয়ার জন্য অল্প করে তরকারি বরাদ্দ থাকে।
এখনও ব্রাত্য থেকে গেল প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, যাদের স্কুলে আসার প্রয়োজনটা সবচেয়ে বেশি। রাজ্যের শিক্ষা দফতরের পরিকল্পনা আছে বুঝে বুঝে পা ফেলা। ক্রমে বাকি ক্লাসের পড়ুয়াদেরও স্কুলে আনা হবে। কিন্তু যে অনিশ্চিত একঘেয়েমি তাদের শৈশব-কৈশোরকে বন্দি করল, তা থেকে তাদের মুক্তির পথ খুঁজতে হবে না? ভাবলেই একটা পূর্ণাঙ্গ বিকল্প পাওয়া যাবেই, এমন নাও হতে পারে। কিন্তু না ভাবলে তো খণ্ডিত বিকল্পও পাওয়া যাবে না। বস্তুত, গঠনমূলক ভাবনার ফল হিসাবেই কিছু কিছু সংবেদনশীল বিকল্প উঠে আসছে— দু’বছরে যে ক্ষতিগুলো হয়েছে সেগুলো অন্তত আংশিক পূরণ করার। সামাজিক এই ভাবনাগুলিকে সরকারি পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করাটাও বিকল্প বইকি। তৃতীয় বিকল্প একটা মাত্র নয়, অনেকগুলি আয়োজনের সমাহার।