আর কী কী আছে এখানে দেখার মতো?” লঞ্চে করে সুন্দরবনের খাঁড়ি দেখা শেষ করে হোটেলে ফিরে চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম বছর পঁয়ত্রিশের মিনতি সর্দারকে। সুন্দরবনের এই টুরিস্ট লজের ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা, জল তোলা, বাথরুম পরিষ্কার করা, টুরিস্টদের ফাইফরমাশ খাটা, এবং আরও যত নাম না-জানা, দাম না-দেওয়া কাজ— সবেরই দায়িত্বে আছে সে।
“কাইল ইকটা দারুণ জিনিস দিখবান নাকি ছ্যার? লি যাব।”— তুরন্ত জবাব আসে। মিনতিদের কাছে শহুরে মানুষ মানেই ‘ছ্যার’। পয়সা খরচা করে সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া, হোটেলে থাকা, যথেচ্ছ টাটকা ইলিশ-চিংড়ি-কাঁকড়ার হুকুম দিতে পারা তো সাধারণ মানুষের কম্ম নয়। এ সব ‘অসাধারণ’ শহুরে স্যরদের সাজে।
স্ত্রী-লিঙ্গ অসাধারণ হয় না। হলে, ওঁদের মতো উপকূলবর্তী প্রান্তিক মহিলাদের ঘর বন্যায় ভেসে যাওয়া এত সাধারণ ঘটনা হত না। এত সহজে ওঁদের স্বামীরা ভিটেমাটি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়তেন না, কাজের সন্ধানে শহরে গিয়ে আর না-ফিরে সেখানে আর এক নতুন সংসার বাঁধতেন না।
গত কয়েক দশকে জলবায়ুর পরিবর্তনের পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার ঘনঘটা নাগাড়ে বেড়ে চলেছে। কারণ, উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা বেড়েছে। এ রাজ্যের মতো ভারতের পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলির আরও বেশি সমস্যা হল, ষাট শতাংশ ক্ষেত্রেই আরব সাগরের বুকে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলিও অভিমুখ পরিবর্তন করে আছড়ে পড়ছে পূর্ব উপকূলেই। তাই ‘ল্যান্ডফল’-এর ঘটনা এ দেশের পশ্চিম উপকূলের তুলনায় পূর্ব উপকূলে ঘটছে অনেক বেশি। ভেসে যাচ্ছে সে অঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা, খেত, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, সবই। পড়ে থাকা জমি হয়ে পড়ছে লবণাক্ত, চাষের অযোগ্য। কাজের সন্ধানে পুরুষদের শহরে পাড়ি দিতে হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা আর ফেরেন না। সন্তান ও বয়স্কদের নিয়ে গোটা সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে মিনতিদের মতো মহিলাদের ঘাড়ে।
অথচ সে সংসারের জায়গাটুকুও প্রতিনিয়ত অপ্রতুল হয়ে উঠছে। গত কয়েক দশকের ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের জমির আটাশ শতাংশ (প্রায় বারোশো বর্গ কিলোমিটার), আর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সাড়ে চব্বিশ শতাংশ হারিয়ে গিয়েছে। ফলে অবশিষ্ট জমিটুকু নিয়ে এখন বাঘে-মানুষে টানাটানি। খাবারের সন্ধানে মাঝেমাঝেই বাঘ ঢুকছে লোকালয়ে। প্রাণ বাঁচাতে মিনতিদের সংসার তাই নিরন্তর স্থানান্তরিত হয়ে চলেছে। এ দিকে, ঘরকন্নার কাজের শিক্ষাটুকু ছাড়া এ দেশের বেশির ভাগ মেয়ে এখনও বাইরের পৃথিবী বা পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করার প্রায় কোনও শিক্ষাই পান না। যেমন, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই সাঁতার জানা মহিলাদের হার, সাঁতার জানা পুরুষের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ! এর ফল হয় মারাত্মক। ২০০৪ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে সুনামি হলে, আক্রান্ত অঞ্চলের প্রতি তিন জন পুরুষপিছু বাঁচেন মাত্র এক জন মহিলা।
সাঁতার না জানা, পরিবারের সন্তান-বয়স্ক-অসুস্থ সদস্যদের দায়িত্ব আঁকড়ে থাকা মহিলারা এমনই আরও বহু কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় ব্যর্থ হন, প্রাণ হারান। কারণ, বহির্বিশ্বের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার উল্টো পিঠেই থাকে সে লড়াইতে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্প। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দেখাচ্ছেন যে, বিশ্ব জুড়েই পরিবেশের সঙ্গে লড়াইতে মহিলারা হারছেন পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি। জলবায়ুর পরিবর্তন পুরুষ ও নারীর উপর অসম আঘাত হানছে। কারণ বোঝা কঠিন নয়। প্রাকৃতিক হোক বা সামাজিক, যে কোনও সমস্যাই সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উপর অনেক বেশি আঘাত হানে। আর মহিলারা, বিশেষ করে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের মহিলারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই পুরুষদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন যত মানুষকে গৃহহারা করেছে, তার আশি শতাংশই মহিলা!
তার চেয়েও বড় কথা হল, গৃহহারা পুরুষের তুলনায় গৃহহারা মহিলাদের সমস্যা ভোগ করতে হয় অনেক বেশি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে উদ্বাস্তু মানুষ অস্থায়ী আস্তানায় তেঁতুলপাতায় উনিশ জন থাকতে বাধ্য হন। ফলে মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। স্নান, শৌচকর্ম, জামাকাপড় পরিবর্তনের মতো বিষয়ও তাঁদের পক্ষে নিদারুণ সমস্যাজনক হয়ে পড়ে। অহরহ এর প্রমাণ পাই পত্রপত্রিকায়, যখন দেখি বাসস্থান থেকে দূরে যৌথ শৌচালয় ব্যবহার করতে গিয়ে গণধর্ষিত হয়েছেন কোনও মহিলা।
গৃহহারা হননি যে মহিলারা, উষ্ণায়ন আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিনে তাঁদের অবস্থা কী রকম? দেখা যাচ্ছে জল তোলা, পারিবারিক চাষের কাজ করা বা রান্নার সামগ্রী বা জ্বালানি সংগ্রহের মতো বিনা মজুরির কাজগুলি যে হেতু মহিলাদের উপরেই বর্তায়, তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কুফলগুলিও তাঁদেরই সহ্য করতে হয় বেশি। একটা উদাহরণ দিই। উষ্ণায়নের ফলে গত মাত্র পঞ্চাশ বছরে মধ্য আফ্রিকার চাদ নামক হ্রদটির নব্বই শতাংশই বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে, সে অঞ্চলের মহিলাদের পানীয়, চাষের কিংবা অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের জল সংগ্রহের জন্য প্রতি দিন ছয় থেকে সাত কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়। সংসারের আর পাঁচটা কাজ সামলে এই দূরত্ব বারে বারে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাই এক-এক বারে দুই হাতে ও মাথায় করে তাঁরা বয়ে আনেন কুড়ি লিটার জল। তাঁদের অপুষ্ট, গড়পড়তা চুয়াল্লিশ কেজি ওজনের শরীরের অর্ধেক মাত্র!
গোড়ার কথায় ফিরি। মিনতির ‘দারুণ’ দেখার জিনিসটি কী, জানতে চাইলাম। মিনতি জানাল যে, বছর কয়েক আগে তাদেরই গ্রামের এক জন কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়েন। জঙ্গল ছোট হয়ে আসায় বাঘ যে কখন কোথায় হানা দেয়, বোঝা মুশকিল। তবে লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় আওয়াজ পেয়ে গ্রামবাসীরা ছুটে যান। প্রাণে বাঁচলেও তাঁর এক দিকের মুখ, কান, কাঁধ ও মাথার একটি অংশ বাঘে উপড়ে নেয়। সেই ক্ষতবিক্ষত, চিরকালের জন্য শয্যাশায়ী মানুষটিই নাকি এখন দর্শনীয়— শহুরে স্যররা তা দেখে ‘দারুণ’ দর্শনতৃপ্তি লাভ করেন, পরিতৃপ্তির উপঢৌকনস্বরূপ বকশিশও দেন। তাতে বন্যায় চাষ জমি হারানো, এক
অথর্ব সদস্য-সহ পরিবারটির অন্নসংস্থানে খানিক সুবিধাও হয়।
মিনতিকে জিজ্ঞাসা করি, সেই আহত মানুষটি মহিলা, না কি পুরুষ? প্রশ্ন শুনে সে ভারী অবাক হয়। বলে, “কী যে বলেন ছ্যার, মেয়েমানষির মুখ অমন খাবলি গেলি ছে কি লোকের সামনি আসতি পারত? কবে তারে বাড়ি থিকাই দূর করি দিত…।”
আর কী কী আছে এখানে দেখার মতো?” লঞ্চে করে সুন্দরবনের খাঁড়ি দেখা শেষ করে হোটেলে ফিরে চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম বছর পঁয়ত্রিশের মিনতি সর্দারকে। সুন্দরবনের এই টুরিস্ট লজের ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা, জল তোলা, বাথরুম পরিষ্কার করা, টুরিস্টদের ফাইফরমাশ খাটা, এবং আরও যত নাম না-জানা, দাম না-দেওয়া কাজ— সবেরই দায়িত্বে আছে সে।
“কাইল ইকটা দারুণ জিনিস দিখবান নাকি ছ্যার? লি যাব।”— তুরন্ত জবাব আসে। মিনতিদের কাছে শহুরে মানুষ মানেই ‘ছ্যার’। পয়সা খরচা করে সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া, হোটেলে থাকা, যথেচ্ছ টাটকা ইলিশ-চিংড়ি-কাঁকড়ার হুকুম দিতে পারা তো সাধারণ মানুষের কম্ম নয়। এ সব ‘অসাধারণ’ শহুরে স্যরদের সাজে।
স্ত্রী-লিঙ্গ অসাধারণ হয় না। হলে, ওঁদের মতো উপকূলবর্তী প্রান্তিক মহিলাদের ঘর বন্যায় ভেসে যাওয়া এত সাধারণ ঘটনা হত না। এত সহজে ওঁদের স্বামীরা ভিটেমাটি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়তেন না, কাজের সন্ধানে শহরে গিয়ে আর না-ফিরে সেখানে আর এক নতুন সংসার বাঁধতেন না।
গত কয়েক দশকে জলবায়ুর পরিবর্তনের পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার ঘনঘটা নাগাড়ে বেড়ে চলেছে। কারণ, উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা বেড়েছে। এ রাজ্যের মতো ভারতের পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলির আরও বেশি সমস্যা হল, ষাট শতাংশ ক্ষেত্রেই আরব সাগরের বুকে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলিও অভিমুখ পরিবর্তন করে আছড়ে পড়ছে পূর্ব উপকূলেই। তাই ‘ল্যান্ডফল’-এর ঘটনা এ দেশের পশ্চিম উপকূলের তুলনায় পূর্ব উপকূলে ঘটছে অনেক বেশি। ভেসে যাচ্ছে সে অঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা, খেত, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, সবই। পড়ে থাকা জমি হয়ে পড়ছে লবণাক্ত, চাষের অযোগ্য। কাজের সন্ধানে পুরুষদের শহরে পাড়ি দিতে হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা আর ফেরেন না। সন্তান ও বয়স্কদের নিয়ে গোটা সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে মিনতিদের মতো মহিলাদের ঘাড়ে।
অথচ সে সংসারের জায়গাটুকুও প্রতিনিয়ত অপ্রতুল হয়ে উঠছে। গত কয়েক দশকের ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের জমির আটাশ শতাংশ (প্রায় বারোশো বর্গ কিলোমিটার), আর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সাড়ে চব্বিশ শতাংশ হারিয়ে গিয়েছে। ফলে অবশিষ্ট জমিটুকু নিয়ে এখন বাঘে-মানুষে টানাটানি। খাবারের সন্ধানে মাঝেমাঝেই বাঘ ঢুকছে লোকালয়ে। প্রাণ বাঁচাতে মিনতিদের সংসার তাই নিরন্তর স্থানান্তরিত হয়ে চলেছে। এ দিকে, ঘরকন্নার কাজের শিক্ষাটুকু ছাড়া এ দেশের বেশির ভাগ মেয়ে এখনও বাইরের পৃথিবী বা পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করার প্রায় কোনও শিক্ষাই পান না। যেমন, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই সাঁতার জানা মহিলাদের হার, সাঁতার জানা পুরুষের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ! এর ফল হয় মারাত্মক। ২০০৪ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে সুনামি হলে, আক্রান্ত অঞ্চলের প্রতি তিন জন পুরুষপিছু বাঁচেন মাত্র এক জন মহিলা।
সাঁতার না জানা, পরিবারের সন্তান-বয়স্ক-অসুস্থ সদস্যদের দায়িত্ব আঁকড়ে থাকা মহিলারা এমনই আরও বহু কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় ব্যর্থ হন, প্রাণ হারান। কারণ, বহির্বিশ্বের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার উল্টো পিঠেই থাকে সে লড়াইতে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্প। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দেখাচ্ছেন যে, বিশ্ব জুড়েই পরিবেশের সঙ্গে লড়াইতে মহিলারা হারছেন পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি। জলবায়ুর পরিবর্তন পুরুষ ও নারীর উপর অসম আঘাত হানছে। কারণ বোঝা কঠিন নয়। প্রাকৃতিক হোক বা সামাজিক, যে কোনও সমস্যাই সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উপর অনেক বেশি আঘাত হানে। আর মহিলারা, বিশেষ করে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের মহিলারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই পুরুষদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন যত মানুষকে গৃহহারা করেছে, তার আশি শতাংশই মহিলা!
তার চেয়েও বড় কথা হল, গৃহহারা পুরুষের তুলনায় গৃহহারা মহিলাদের সমস্যা ভোগ করতে হয় অনেক বেশি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে উদ্বাস্তু মানুষ অস্থায়ী আস্তানায় তেঁতুলপাতায় উনিশ জন থাকতে বাধ্য হন। ফলে মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। স্নান, শৌচকর্ম, জামাকাপড় পরিবর্তনের মতো বিষয়ও তাঁদের পক্ষে নিদারুণ সমস্যাজনক হয়ে পড়ে। অহরহ এর প্রমাণ পাই পত্রপত্রিকায়, যখন দেখি বাসস্থান থেকে দূরে যৌথ শৌচালয় ব্যবহার করতে গিয়ে গণধর্ষিত হয়েছেন কোনও মহিলা।
গৃহহারা হননি যে মহিলারা, উষ্ণায়ন আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিনে তাঁদের অবস্থা কী রকম? দেখা যাচ্ছে জল তোলা, পারিবারিক চাষের কাজ করা বা রান্নার সামগ্রী বা জ্বালানি সংগ্রহের মতো বিনা মজুরির কাজগুলি যে হেতু মহিলাদের উপরেই বর্তায়, তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কুফলগুলিও তাঁদেরই সহ্য করতে হয় বেশি। একটা উদাহরণ দিই। উষ্ণায়নের ফলে গত মাত্র পঞ্চাশ বছরে মধ্য আফ্রিকার চাদ নামক হ্রদটির নব্বই শতাংশই বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে, সে অঞ্চলের মহিলাদের পানীয়, চাষের কিংবা অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের জল সংগ্রহের জন্য প্রতি দিন ছয় থেকে সাত কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়। সংসারের আর পাঁচটা কাজ সামলে এই দূরত্ব বারে বারে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাই এক-এক বারে দুই হাতে ও মাথায় করে তাঁরা বয়ে আনেন কুড়ি লিটার জল। তাঁদের অপুষ্ট, গড়পড়তা চুয়াল্লিশ কেজি ওজনের শরীরের অর্ধেক মাত্র!
গোড়ার কথায় ফিরি। মিনতির ‘দারুণ’ দেখার জিনিসটি কী, জানতে চাইলাম। মিনতি জানাল যে, বছর কয়েক আগে তাদেরই গ্রামের এক জন কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়েন। জঙ্গল ছোট হয়ে আসায় বাঘ যে কখন কোথায় হানা দেয়, বোঝা মুশকিল। তবে লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় আওয়াজ পেয়ে গ্রামবাসীরা ছুটে যান। প্রাণে বাঁচলেও তাঁর এক দিকের মুখ, কান, কাঁধ ও মাথার একটি অংশ বাঘে উপড়ে নেয়। সেই ক্ষতবিক্ষত, চিরকালের জন্য শয্যাশায়ী মানুষটিই নাকি এখন দর্শনীয়— শহুরে স্যররা তা দেখে ‘দারুণ’ দর্শনতৃপ্তি লাভ করেন, পরিতৃপ্তির উপঢৌকনস্বরূপ বকশিশও দেন। তাতে বন্যায় চাষ জমি হারানো, এক অথর্ব সদস্য-সহ পরিবারটির অন্নসংস্থানে খানিক সুবিধাও হয়।
মিনতিকে জিজ্ঞাসা করি, সেই আহত মানুষটি মহিলা, না কি পুরুষ? প্রশ্ন শুনে সে ভারী অবাক হয়। বলে, “কী যে বলেন ছ্যার, মেয়েমানষির মুখ অমন খাবলি গেলি ছে কি লোকের সামনি আসতি পারত? কবে তারে বাড়ি থিকাই দূর করি দিত…।”
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়