Science vs Religious Politics

বিজ্ঞান নেই, বিশ্বাস রয়েছে

দেশের মানুষের বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা তৈরি হওয়ার সম্ভাব্য সকল পরিসরকেই, সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চালের মাধ্যমে সমর্পিত ধর্মীয় প্রার্থনায় বেঁধে ফেলার প্রয়াস চলছে বহু দিন।

Advertisement
প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:২৭


“তোমরা সুনীতা উইলিয়ামসের জন্য প্রার্থনা করছ?”

Advertisement

(সমস্বরে) “হ্যাঁ।”

“তোমরা ওঁর মতো হতে চাও?”

(সমস্বরে) “হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

“জানো, সুনীতা উইলিয়ামস কে?”

“না!”

উপরের কথোপকথনটি গুজরাতে সুনীতা উইলিয়ামসের পৈতৃক ভিটে ঝুলাসান গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এক টেলিভিশন সাংবাদিকের। সাংবাদিক প্রশ্ন করছেন, ছাত্ররা প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে উত্তর দিচ্ছে, ছাত্রীরা পিছনে ঘুরঘুর করছে। সাংবাদিক বলছেন, গত সাত মাস ধরে রোজই এরা এমন প্রার্থনা করছে, সুনীতা উইলিয়ামসের নিরাপদ অবতরণের জন্য। ছাত্ররা জানাল, তারা সুনীতা কে, তা জানে না। ছাত্রীরা জানে কি না, টের পাওয়া গেল না— টেলিভিশনের সাংবাদিক ছাত্রীদের কোনও প্রশ্ন করেননি।

সুনীতা কে, ওরা জানে না— এ কথায় মর্মাহত হওয়ার আগে ভাবা যাক, বিগত কয়েক মাসে ওদের ঠিক কী শিখিয়েছি আমরা? শিখিয়েছি, একটি আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন মিশনের মতো উচ্চমার্গীয় বৈজ্ঞানিক বিষয় সম্পর্কে এতটুকু না-জেনেও তাকে ধর্মের রং লাগিয়ে উৎসবে পরিণত করা যায়; পূজাপাঠ আর প্রার্থনার গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা যায়; ধর্মাচরণ আর ঈশ্বরবিশ্বাসই সকল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রাণভোমরা, তাই তার সাফল্যকেও উদ্‌যাপিত করতে হয় পুরোহিত ডেকে, যজ্ঞ করে, কিংবা হর হর মহাদেব মন্ত্রে বাতাস গরম করে। শিখিয়েছি, মহাযজ্ঞ নিঃসরিত কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার আশীর্বাদস্পর্শে ধন্য হলেই উইলিয়ামসদের মহাকাশযান নির্ঝঞ্ঝাটে পৃথিবীতে ফিরবে।

অথচ মহাকাশ বিজ্ঞানের এমন এক অমূল্য সাফল্যকে প্রেরণা করে কিন্তু অনায়াসে এ দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করা যেত। সোশ্যাল মিডিয়া বা ইউটিউবে এই মহাকাশসফরের যে টুকরোটাকরা ভিডিয়ো রয়েছে, তা দেখিয়ে হাতেকলমে তাদের অভিজ্ঞ করে তোলা যেত এক জন মহাকাশচারীর জীবন ও কাজ সম্পর্কে; শেখানো যেত মহাকাশযানের প্রাথমিক কার্যপদ্ধতি, গঠনবিন্যাস। দেখানো যেত মাধ্যাকর্ষণের তারতম্যের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে কী ভাবে বেঁচে থাকতে হয় মহাকাশে। আর সর্বোপরি বোঝানো যেত, যে কোনও সাফল্যের পিছনে ঠিক কতটা সময়, নিষ্ঠা, ত্যাগ, পরিশ্রম আর অধ্যবসায় থাকে।

পাশাপাশি সুনীতা উইলিয়ামসকে প্রতিষ্ঠা করা যেত এ দেশের ছেলেমেয়েদের রোল মডেল হিসাবে। বিশেষত, মেয়েদের। গবেষণায় এ কথা বার বার উঠে এসেছে যে, কোনও একটি মেয়ের সাফল্যের নজির সমাজের বাকি মেয়েদের তো প্রভূত অনুপ্রেরণা জোগায়ই, পাশাপাশি মেয়েদের প্রতি তাদের পরিবারের, এমনকি গোষ্ঠী কিংবা গোটা সমাজেরও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। সুনীতার সাফল্যকে আমরা এ রকম কোনও গঠনমূলক কাজে লাগাতে পারলাম না।

দেশের মানুষের বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা তৈরি হওয়ার সম্ভাব্য সকল পরিসরকেই, সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চালের মাধ্যমে সমর্পিত ধর্মীয় প্রার্থনায় বেঁধে ফেলার প্রয়াস চলছে বহু দিন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এ দেশের মানুষের ধর্মান্ধতাকে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। ধর্মের সঙ্কীর্ণতাকে কাটিয়ে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার এই মানসিকতাটি অবশ্য নেহরুর একান্ত নিজস্ব চিন্তাধারা নয়— এটি ভারতীয় নবজাগরণের উত্তরাধিকার, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি অংশ যা বহন করেছে দীর্ঘ দিন। ভারত সে কথা শুনেছে, কিন্তু অন্তরে গ্রহণ করেনি। ফলে, আজ যখন রাজনীতি চাইছে মানুষকে বিজ্ঞানের উল্টো পথে চালিত করতে, ভারতবাসী বিনা প্রতিরোধে সে পথে হাঁটতে আরম্ভ করেছে।

আর্থিক উদারীকরণের যুগে, বিশ্বায়িত বাজারের যুগে আমরা আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠলাম। আজকের দিনে স্থানীয় হোক বা দেশীয়, ভারতের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ভোটবাক্স ধর্মীয় ভাবাবেগকেন্দ্রিক। এই উস্কানিমূলক রাজনীতির বিস্তার ও গ্রহণযোগ্যতা উভয়ই ক্রমশ বাড়ছে। ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতিতে ‘পাওয়ার’ বা ক্ষমতা ভাগ হয়ে যায় ধর্ম অবলম্বী আর অনাবলম্বীর মাঝে— যারা ক্ষমতাসীনের পক্ষের ধর্মে সোৎসাহ গলা মেলায়, তারা হয়ে ওঠে ক্ষমতার ভাগীদার। ফলে ক্ষমতার গ্রহীতা মন বুঝে দাতার আরাধনা করে। গ্রহীতার কাছে দাতাই তখন রাজা, দাতাই তখন আদর্শ, দাতাই সত্য, ঈশ্বর কিংবা ধর্ম। যাকে প্রশ্ন করতে নেই, যাতে বস্তু মিলায় বিশ্বাসে।

আনুগত্যনির্ভর ও ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত তৈরি করে। সেই রাষ্ট্রের নাগরিক প্রশ্ন করেন না, বিশ্বাস করেন— বিজ্ঞানের স্বরূপ চেনার চেয়ে তাঁর কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে হরেক কুযুক্তির জাল বিস্তার করে সেই বিজ্ঞানকে নিজের অবনত দেখাতে চাওয়া ধর্ম এবং সেই ধর্মের ধ্বজাধারীরা। তার ফল আমরা চোখের সামনে দেখছি— সুনীতা কে, তা না জেনেই ছাত্রছাত্রীরা তাঁর নিরাপদ অবতরণের জন্য ধর্মের কাছে হাত পেতেছে। বিজ্ঞান নেই, বিশ্বাস রয়েছে।

Advertisement
আরও পড়ুন