বৈঠকে ডেকে বলেছিলেন, “সীমা ছাড়াচ্ছেন, বিপদে পড়বেন”
Junior Doctors' Protest

দেখার অনেক বাকি

দেখা গেল, অনশন তোলার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দু’ঘণ্টা বৈঠক করে এসে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন, তাঁরা অনশন তুলছেন আর জি কর-এ ধর্ষণে মৃত তরুণী চিকিৎসকের মা-বাবার অনুরোধে।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩৪
ঘোষণা: মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জুনিয়র ডাক্তারেরা, ২১ অক্টোবর ২০২৪।

ঘোষণা: মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর জুনিয়র ডাক্তারেরা, ২১ অক্টোবর ২০২৪। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

নবীন চিকিৎসকদের অনশন তুলে নেওয়ার চেয়ে স্বস্তিকর সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারে না। তাঁদের বিভিন্ন দাবি, প্রতিবাদ, স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে ‘সুস্থ’ করার সব লড়াই জারি থাক। কিন্তু আমাদের সন্তানসম ছেলেমেয়েরা যে ভাবে দু’সপ্তাহ ধরে অনশন করতে করতে অসুস্থ, ক্ষীণ হয়ে পড়ছিলেন, সেটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। তাই সবচেয়ে আগে চাইব, তাঁরা সবাই শারীরিক ভাবে ভাল থাকুন।

Advertisement

দেখা গেল, অনশন তোলার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দু’ঘণ্টা বৈঠক করে এসে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন, তাঁরা অনশন তুলছেন আর জি কর-এ ধর্ষণে মৃত তরুণী চিকিৎসকের মা-বাবার অনুরোধে। বৈঠকে তাঁরা যে অখুশি, সেটাও জানিয়ে এক জুনিয়র চিকিৎসক নেতার মন্তব্য, “প্রশাসনের শরীরী ভাষা সন্তোষজনক ছিল না।” প্রসঙ্গত, সে দিনের বৈঠকে আন্দোলনকারীদের দাবি মতো প্রায় সব কমিটিতে পড়ুয়াদের প্রতিনিধি রাখার কথা হয়।

নবান্নে বৈঠকটি ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের। মুখ্যসচিব ছাড়া বাকি অফিসার এবং বিভিন্ন অধ্যক্ষকে রাখা হয়েছিল ‘সাপোর্টিং স্টাফ’ হিসাবে। অর্থাৎ, প্রয়োজনে তথ্য জোগানো। একাংশের অভিযোগ, বৈঠকে মমতা স্বৈরতন্ত্রী হয়ে অধ্যক্ষদের কথা বলতে দেননি। উপরন্তু কলেজ স্তরে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আগে তা স্বাস্থ্য প্রশাসনকে জানানোর কথা বলে তিনি ‘হুমকি সংস্কৃতি’কেই প্রশ্রয় জুগিয়েছেন।

তর্ক নয়। শুধু এই আবহে এক বার ১৯৮৩-র পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে ইচ্ছে হয়। জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট চলাকালীন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বৈঠক। টেবিলের ও-পারে জ্যোতি বসু, এ-পারে সারা বাংলা জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের সাত প্রতিনিধি। জ্যোতিবাবু বললেন, “আপনারা সীমা ছাড়াচ্ছেন। বিপদে পড়বেন। আগে স্ট্রাইক তুলুন, বাকি পরে। আমার কথা শেষ।”

জুনিয়র ডাক্তাররা জানালেন, “আমাদের মাইনে বাড়ানোর দাবি তুলে নিচ্ছি। কিন্তু সাধারণ মানুষের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি দাবি অন্তত আপনি মেনে নিন।” তাতে ছিল হাসপাতালে অত্যাবশ্যক ও জীবনদায়ী ওষুধের ঠিকঠাক সরবরাহ, চব্বিশ ঘণ্টা রক্ত পরীক্ষা, ব্লাড ব্যাঙ্ক চালু রাখা, এক্স-রে, ইসিজি-র বন্দোবস্ত ইত্যাদি। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “মানুষের দাবি আপনাদের থেকে শিখব! আপনারা কী করবেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার। তবে স্ট্রাইক না তুললে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না।”

ধর্মঘট তত দিনে সপ্তাহ পেরিয়েছে। আউটডোরের বাইরে শিবির করে যথাসম্ভব রোগী দেখা ও জরুরি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে দিনও কিন্তু আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অনেক মানুষ।

আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, জ্যোতিবাবু তখন ছিলেন কাশ্মীরে। বিনয় চৌধুরীর হাতে রাজ্যের অস্থায়ী দায়িত্ব। তিনি বলেছিলেন, “হাসপাতালে ধর্মঘটের মোকাবিলা হবে বেয়নেটের মুখে!” আর রাজ্যের অন্যতম স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনারায়ণ গোস্বামী হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, “আমি সিপিএমের বাচ্চা। আন্দোলনের শখ ঘুচিয়ে দেব!”

জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বৈঠকের পরে অচিরেই এক রাতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পুলিশের লাঠি চলল আন্দোলনরত চিকিৎসকদের উপর। পরিণামে আহত, রক্তাক্ত হওয়া এবং কয়েকজনের জেলে যাওয়া। ধর্মঘট উঠে গেল।

সে দিন যাঁরা আন্দোলনের শরিক ছিলেন বা তার কাছাকাছি সময়ের, তাঁদের একটি বড় অংশ আজ নামী চিকিৎসক। এঁদের অনেকেই এখন আন্দোলনকারীদের পাশে থেকে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছেন। পেশায় অগ্রজেরা নিশ্চয় অনুজদের ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে দাঁড়াবেন। এটাই তো স্বাভাবিক। আর জি করের মূল ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং সর্ব স্তরে দোষীদের কঠোরতম শাস্তির দাবি তো বলা বাহুল্য।

সর্বোপরি ওই ঘটনার সূত্র ধরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর যে কদর্যতম চেহারা বেআব্রু হল, তার উপযুক্ত প্রতিবিধান চাওয়াও সকলের অবশ্যকর্তব্য। এখানে বিন্দুমাত্র ফাঁক বরদাস্ত করার নয়। বরং সবাই মিলে নিশ্চিত করতে হবে, সরকারের তরফে উদ্যোগ ও আশ্বাসগুলি বাস্তবায়নের পরে তা যেন ক্ষণস্থায়ী না হয়। অর্থাৎ, হাকিম নড়লেও ‘হুকুম’ যেন অনড় থেকে যায়। মনে রাখা দরকার, প্রশাসন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া এবং আন্দোলনকারীদের বেশির ভাগ দাবি সুষ্ঠু ব্যবস্থার দিশারি।

তবে এরই পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক ও তাঁদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে আলোচনায় আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কত দূর ‘স্বৈরাচারী’ হয়েছেন, এবং চল্লিশ বছর আগের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু-ই বা সে কালের আন্দোলনকারীদের প্রতি কতটা ‘গণতান্ত্রিক ও সংবেদনশীল’ ছিলেন, সেই তুলনা বেমালুম ভুলে থাকলে চলবে কেন? প্রশ্নটি এ ভাবে আসত না, যদি জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এখনও প্রকৃত অর্থে ‘অরাজনৈতিক’ থাকত। না, আর তা নেই।

বস্তুত এখন এই আন্দোলনের যে ধারা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে রাজনীতির ঘোলা জল স্পষ্ট। সেখানে এমন কয়েকটি চেহারা দৃশ্যমান, যাঁদের রাজনৈতিক অতীত (হয়তো বর্তমানও) জনসমক্ষে পরিচিত। তাই ১৯৮৩-র আন্দোলন দমনে জ্যোতি বসুর সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁরা আজ কে কী বলেন, জানতে চাওয়া হয়তো খুব অসঙ্গত হবে না।

বলতে দ্বিধা নেই, আন্দোলনে প্রথম সারির মুখগুলি এখন সিপিএম, অতি-বাম, এসইউসি ইত্যাদি মার্কায় চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। অপর পক্ষে তৃণমূল। এটা শুধু জুনিয়র ডাক্তারদের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁদের পাশে থাকা বড় বড় অনেক চিকিৎসকের বেলাতেও প্রযোজ্য। প্রতিশ্রুতি মতো মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অবশ্যই ছাত্র সংগঠনের ভোট হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে প্রতিবাদী ছাত্র সমাজের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তৃণমূলের ক্ষমতার দামামাও অবশ্যই বাজবে। এবং নির্যাতিতার ঘটনাটিকে সামনে রেখে রাজনীতি তখন কাদার হোলি খেলবে! এই ভবিতব্য খণ্ডানো বিধাতারও অসাধ্য।

আসলে মুখে যত যা-ই বলুন, সব দলের দাদা-দিদিরাই দিনের শেষে ইউনিয়নের মাধ্যমে সর্বত্র নিজেদের হাতে ‘প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ’ চান। এক-একটি কলেজে ইউনিয়নের ক্ষমতা দখল করার ‘মাহাত্ম্য’ সুদূরপ্রসারী। যে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে তা বুঝিয়ে বলতে হয় না। ছাত্র-ইউনিয়ন হাতে থাকা মানে শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতার সমান্তরাল ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা। ইউনিয়ন মানে পথে-বিপথে পকেট ভরার হাজার ‘সুযোগ’। আবার ইউনিয়ন মানে মিটিং-মিছিল থেকে ভোটের ময়দান পর্যন্ত সব জায়গায় রাজনীতির মূল স্রোতে ‘কার্যকর’ শক্তির উৎস। সময় যাদের অধুনা ‘ছাত্র-যৌবন’ বলে থাকে।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সে দিনের বৈঠকে এক জুনিয়র চিকিৎসক বলছিলেন, ‘মেধাবী’ ছাত্রদের একটি অংশ এই আমলে ডাক্তারি পড়তে এসে ‘ক্রিমিনাল’ হয়ে গিয়েছে। তারাই ‘হুমকি সংস্কৃতি’র ধারক-বাহক। তারাই বিভিন্ন অপরাধের হোতা, প্রযোজক ও প্রশ্রয়দাতা। তারা পরীক্ষায় ভাল নম্বর পায়, কিন্তু আদতে একশোয় দশ পাওয়ার যোগ্য! বুঝতে অসুবিধা নেই, তাঁর এই বক্তব্যের নিশানা শাসক তৃণমূল-পোষিত গোষ্ঠী। অভিযোগগুলিও নেহাত অসার নয়।

অনেকেই জানেন, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন-বিধি বদল করে ছাত্র ও কর্মী ইউনিয়নকে পরিচালন কমিটির বাইরে রাখা হয়েছিল। অল্প দিন পরেই আবার তাদের ‘স্বমহিমায়’ ফেরানো হয়। তখন অন্দরমহলের যুক্তি ছিল, এটা না করলে কোনও রাজনৈতিক ‘নিয়ন্ত্রণ’ থাকবে না।

প্রকৃতপক্ষে এই স্তরেই হুমকির বীজ বপন হয়। পরে বিষবৃক্ষ। এই পাঠ তৃণমূল নিয়েছে প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাসের মার্গদর্শন থেকে। যা আজও ‘অনিলায়ন’ বলে খ্যাত! বস্তুত এই পথেই শিক্ষাক্ষেত্রে ‘হুমকি’ এবং ‘সংস্কৃতি’ শব্দ দু’টিও কখন যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছে। তফাত শুধু ব্যবহারিক প্রয়োগে।

আর জি কর আন্দোলনের চাপে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অবস্থা এ বার কিছুটা বদলাতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচিত ইউনিয়ন হয়তো আপাতভাবে ‘অরাজনৈতিক’ তকমাও পাবে। কিন্তু ভিতরে ক্ষমতা সত্যিই তার ‘ধর্ম’ বদলাতে পারবে কি? কঠিন প্রশ্ন। দেখতে হবে আরও।

আরও পড়ুন
Advertisement