অতিমারি-উত্তর সময়ে ভারতের ত্রি-স্তরীয় শাসনব্যবস্থায় পুর-বোর্ড বা পঞ্চায়েতগুলি উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডে কেমন ভূমিকা নেবে, তা এখন থেকেই ঠিক করা প্রয়োজন। নগরায়ন এখন দেশের অর্থনৈতিক তথা সামাজিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এক বিশেষ শর্তও বটে। এই চিন্তার পরিসরে পুর-পরিষেবা এখন আর কেবল জল-জঞ্জাল-নিকাশির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। তাই বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাইরে, আজকের নগরজীবন নাগরিকের প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণে সক্ষম কি না, তা পুর-বোর্ড পরিচালনার কার্যকলাপে আসা উচিত।
এক জন নাগরিক তাঁর দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক, মানসিক, ও শারীরিক ভাবে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন, সেই সামগ্রিক বিকাশকেই এই চাহিদা নির্দেশ করে। সুতরাং পরিষেবা নয়, নাগরিক জীবনের সামগ্রিক বিকাশই পুরসভা পরিচালনার লক্ষ্য হওয়া উচিত। আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসে নগর-পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছে জনস্বাস্থ্য-জনিত সঙ্কটগুলি থেকে। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে, ইউরোপ ও আমেরিকায় শহরগুলোর ঘিঞ্জি, নোংরা পরিবেশে শ্রমিকদের গাদাগাদি বসবাসই রোগ সংক্রমণের প্রধান কারণ। তার ফলে জনস্বাস্থ্য কারিগরিবিদ্যা নগর পরিকল্পনার প্রধান অংশ হয়ে ওঠে, যা নিকাশি থেকে পয়ঃপ্রণালী, পানীয় জলের সংযোগ থেকে বসতবাড়ির নকশা— সবই নির্ধারণ করত। শহরের পরিচ্ছন্নতা, বাসস্থানকে আলো-বাতাসময় ও বসতি অঞ্চলকে রোগমুক্ত রাখাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। প্রসঙ্গত, তৎকালীন কলকাতায় কলেরা মহামারির (১৮১৭-২১) পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে শহরের সার্বিক পরিচ্ছন্নতায় ১৮১৭ সালে গঠিত লটারি কমিটির ভূমিকা আজও অনস্বীকার্য।
কিন্তু বিংশ শতকের শুরু থেকেই নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব কমতে থাকে। কারণ তত দিনে ‘জার্ম থিয়োরির’ আবির্ভাবের দরুন জনস্বাস্থ্য নিজের অভিমুখ সংক্রামক রোগের জীবাণু নিয়ে গবেষণা এবং টিকা আবিষ্কারের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। তার ফলে রোগ প্রতিরোধে মানবদেহে টিকাকরণই মুখ্য হয়ে ওঠে; রোগ নির্মূলের জন্য পরিবেশের যে সার্বিক উন্নয়ন দরকার, তা অবহেলিত হতে শুরু করে। জনস্বাস্থ্যের এই বিবর্তনই নগর পরিকল্পনা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এবং এখন কেবল কিছু বিক্ষিপ্ত পরিষেবায় (যেমন, জল সরবরাহ, জঞ্জাল সাফাই, নিকাশিব্যবস্থা, টিকাকরণ কর্মসূচি ইত্যাদি) পর্যবসিত করেছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বাজার অর্থনীতির ইঁদুরদৌড় কলকাতার মতো শহরগুলোকে আড়ে-বহরে-উচ্চতায় ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। পুকুর থেকে মাঠ সব চুরি হয়ে যাচ্ছে, ফুটপাত-রাস্তা বেদখল হচ্ছে, খাল থেকে নালা-নর্দমা জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ না নিতে পেরে বুজে যাচ্ছে, বাসস্থান আয়তনে ছোট হতে হতে আলো-বাতাসহীন হয়ে পড়ছে, বসতি অঞ্চলেই পরিবেশ দূষণকারী ব্যবসা গজিয়ে উঠছে। আপাতদৃষ্টিতে এই সমস্ত অনিয়মকে পুরসভাগুলোর প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলে দেগে দেওয়াই যেতে পারে। কিন্তু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে, আজকের নগরজীবন হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক লড়াইয়ে বেঁচে থাকার জন্য নাগরিকদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক যান্ত্রিক পদ্ধতি। এই যান্ত্রিকতা কেবল শহরের সার্বিক উন্নয়নকেই বাধাপ্রাপ্ত করছে না, নাগরিকের সামগ্রিক বিকাশেরও অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এখানেই পুরসভাগুলির গুরুত্ব। তাদের বেশ কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। প্রথমত, নীতিগত ভাবে জনস্বাস্থ্যকে আবার নগর পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কারিগরিবিদ্যা ছাড়াও জনস্বাস্থ্য আধুনিক নগর পরিকল্পনায় জন-সুরক্ষা (প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা প্রশাসনিক গাফিলতিজনিত দুর্ঘটনা) থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বা শহরে ‘স্পেস ডিজ়াইনের’ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো থেকে বিভিন্ন সামাজিক জায়গাগুলোকে বয়স্ক, মহিলাদের, শিশুদের ও বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। এ ছাড়া শহরাঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, সামাজিক একাকিত্ব, অপরাধজনক কাজকর্ম কমাতেও জনস্বাস্থ্যই ভরসা। সুতরাং, নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্য কেবল আর সংক্রামক রোগ ঠেকাতেই নয়, নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনচর্যায় সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিকূলতাকে জয় করতেও পথ দেখাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই নীতিগত কাঠামোর উপর ভিত্তি করে পুরসভা পরিচালনায় নাগরিকের সরাসরি অংশগ্রহণের রাজনৈতিক অঙ্গীকার করা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যে জনগণের অংশগ্রহণ হল প্রধানতম শর্ত। তাই ওয়ার্ড কমিটি তৈরির মাধ্যমে নাগরিকদের এলাকাভিত্তিক সামগ্রিক বিকাশে বাধা সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ দিতে হবে। পুর-প্রতিনিধিদের কাজ হবে সেগুলোর সমাধানের চেষ্টা।
ভারতের সংবিধান ও কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অ্যাক্ট (১৯৮০) অনেক আগেই টাউন প্ল্যানিং ও নাগরিক অংশগ্রহণকে পুরসভা পরিচালনার অবশ্যকরণীয় বলে অভিহিত করেছে। এই কাঠামো এক দিনে তৈরি হবে না। কিন্তু, সবার আগে চাই সদিচ্ছা।