Economy

পঞ্চম থেকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার পথে কী ভাবে হাঁটব

ভারত যখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে স্বীকৃত, তখন ডেনমার্ক জাতীয় উৎপাদনের ক্রমপর্যায়ের সারণিতে ভারতের তুলনায় অনেক নীচে, ৩৮তম স্থানে।

Advertisement
সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২৮
In a journey from 5th economy to being 3rd economy of the world how India should proceed.

—প্রতীকী চিত্র।

বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েও কিন্তু আমরা উন্নয়নের নিরিখে নিম্ন মধ্যবিত্ত। আর এটাই আসলে উন্নয়ন বিতর্কের মূল প্রশ্ন, যার উত্তর ভারতের ব্যক্তি আয়ের শীর্ষে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের জীবনের গল্পে লুকিয়ে নেই। এর উত্তর আসলে লুকিয়ে রয়েছে দেশের সাধারণ নাগরিকের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্যেই। লুকিয়ে রয়েছে তাঁদের জীবনের আর্থিক সুরক্ষার সংস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং রাষ্ট্রের সেই দুশ্চিন্তা দূর করার অপারগতার মধ্যেও। বিশ্বের চোখে আমাদের এই পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি শুধু এখন নয়, আগামী কয়েক দশকের জন্য আর্থিক অসাম্য লালনের অন্যতম আঁতুড়ঘর হিসাবেই কিন্তু চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

Advertisement

আমাদের থেকে জাতীয় উৎপাদনের অঙ্কে অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ ডেনমার্কের উদাহরণ নেওয়া যাক। ইউরোপের যে কোনও দেশের কথা উঠলেই কিন্তু সে দেশ আমাদের থেকে উন্নত হবেই, মনে মনে তা আমরা ধরে নিই কোনও তথ্য না-দেখেই। ডেনমার্কের নাম পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যদি সে রকমই মনে হয়, তা হলে কিন্তু দোষেরও কিছু নেই। কারণ, আপনার সহজাত বোধের সঙ্গে তথ্যও হাত মিলিয়ে হাঁটছে। তা হলে ডেনমার্কের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম কেন? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই। আপাত এগিয়ে থাকার তথ্য আর বাস্তবের মধ্যে ফারাককে ঝালিয়ে নেওয়ার জন্যই।

ভারত যখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে স্বীকৃত, তখন ডেনমার্ক জাতীয় উৎপাদনের ক্রমপর্যায়ের সারণিতে ভারতের তুলনায় অনেক নীচে, ৩৮তম স্থানে। কিন্তু মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতে যখন বিশ্বের অর্থনীতির সারণিতে ১৩৯তম স্থানে, ডেনমার্ক তখন একই সারণিতে নয় নম্বর স্থানে জ্বলজ্বল করছে উন্নত দেশের তকমা নিয়ে।

আমরা আসলে বাজারের নিরিখে বহরে বড় বলে যতই বড়াই করি না কেন, সেই বহরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাধারণ নাগরিকের জীবনধারা তুলনামূলক ভাবে বদলাতে পারিনি বলেই আমরা উন্নয়নশীল থেকেই গিয়েছি। পাশাপাশি, বহরে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও ডেনমার্ক উন্নত দুনিয়ার পাকাপাকি তকমা নিয়ে অবস্থান করছে।

আর করবে না-ই বা কেন? প্রায় ১৪০ কোটির দেশ ভারতে ২০২২-২৩ সালে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন মাত্র সাত কোটি ৪০ লক্ষ নাগরিক। এঁদের মধ্যে রাজকোষে নানান ছাড়ের সুবিধা নিয়ে পাঁচ কোটি ১৬ লক্ষ বা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে কর দিতে হয়নি ৭০ শতাংশ আয়কর দাতার! তবে পরোক্ষ করের কল্যাণে কিন্তু আয়ের পিরামিডের একদম নীচে থাকা নাগরিককেও পরোক্ষ কর দিতে হয় বাজারে পা দিলেই কোনও বা কোনও ভাবে! এমনকি, চিকিৎসার জন্যও। অনেকেই এঁকে রাজদণ্ডকে মুগুরের মতো ব্যবহারের তুলনা করতে পারেন। কিন্তু সে তুলনা কতটা সঠিক অথবা আদৌ বেঠিক কি না, সে আলোচনার পরিসর অন্য।

ফেরা যাক ডেনমার্কের সঙ্গে তুলনায়। ভারতের থেকে জাতীয় উৎপাদনের সারণিতে ৩৪ ধাপ পিছিয়ে থাকা দেশটিতে কিন্তু প্রতিটি প্রবীণ নাগরিকই অবসরভাতা পাওয়ার অধিকারী। সেই অধিকারের স্তর ভেদ আছে। আয়ের সঙ্গে অবসরভাতার একটা আনুপাতিক অঙ্ক কাজ করে। কিন্তু অন্য কোনও আয় না-থাকলে এক জন নাগরিক ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা মাসে অবসরভাতা পাবেনই। অন্য দিকে, ভারতে প্রবীণ নাগরিকদের মাত্র ৩০ শতাংশ কোনও না কোনও ভাবে অবসরভাতা পেয়ে থাকেন। আর সেই ভাতার গড় হল ১০ হাজার টাকা!

জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে ৩৮তম স্থানে থাকা দেশটির প্রতিটি প্রবীণ নাগরিক শুধু কোনও না কোনও অবসরভাতা প্রকল্পের সদস্য তাই নয়, রাষ্ট্রের দায় থাকে নাগরিকদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। প্রত্যেক নাগরিকের সরকারি অবসরভাতা পাওয়ার অধিকার আছে অন্য সূত্রে অবসরভাতা পেলেও। এবং তা প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার ৫০০ ডানিশ ক্রোনার বা ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৮৮৪ টাকার মতো। এই ভাতা কমতে পারে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণের অন্য সূত্রে পাওয়া ভাতার উপর।

ডেনমার্কের আর্থিক ব্যবস্থায় এক জন নাগরিক তার অবসরের জন্য—

• নিজের অবসরভাতার জন্য কোনও প্রকল্পে সঞ্চয় করতে পারেন

• সরকারের কাছ থেকে অবসরভাতা পেতে পারেন

• যে সংস্থায় তিনি কর্মরত সেই সংস্থার কোনও অবসরভাতা প্রকল্প থাকলে তার সুযোগ নিতে পারেন

এ রকম নয় যে, এর যে কোনও একটির উপর তাঁকে নির্ভর করতে হবে। অবসরের পরে এই তিনটি সূত্র থেকেই একসঙ্গে আয়ের অধিকার তাঁর রয়েছে।

বিশ্বের আর্থিক বলে ৩৮তম স্থানে থাকা দেশটি কিন্তু তাঁর নাগরিকদের জন্য বিস্তৃত সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে যা আর্থিক বলে পঞ্চম স্থানে থাকা আমাদের দেশে এখনও দুষ্প্রাপ্য। ডেনমার্কের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যবিমা ও চিকিৎসার দায় রাষ্ট্রের। মাতৃত্বকালীন বিশেষ পারিবারিক ভাতা, সন্তান পালনের জন্য বিশেষ ভাতা, বেকার ভাতা এবং আরও অনেক কিছুও।

অনেকেই বলবেন, ডেনমার্কের মতো ছোট দেশে নাগরিকের জন্য যা করা সম্ভব, শত কোটির উপর নাগরিকের জন্য তা করতে গেলে যে পরিমাণ আর্থিক জোর থাকা দরকার ভারতের রাজকোষের তা নেই। আর সমস্যাটা সেখানেই। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠা যে শ্লাঘা তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু আমরা যদি তাতেই মজে থাকি, তা হলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হয় বৈকি।

একটা যুক্তি সাধারণ ভাবে আলোচনায় বা নানান বিতর্কে শোনা যায়— আগে দেশ ‘বড়লোক’ হোক, তার পরেই তো দেশ নাগরিকের কথা ভাববে! এই যুক্তির উল্টো দিকের যুক্তিটায় কিন্তু ধার অনেক বেশি বলে মানেন অনেকে। তা হল রাষ্ট্রকে নাগরিকের সমষ্টি হিসাবে ভাবা। আর ব্যক্তি নাগরিকের মঙ্গল করে রাষ্ট্রের উন্নয়ন করা।

আজকাল একটি চিকিৎসা বিমার বিজ্ঞাপন খুব চলছে। ওই বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে, রোগী চিকিৎসার মাঝপথেই হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছে কারণ, তাঁর পক্ষে চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, অবশ্যই বিমা নেই তাই। বিমা থাকলে কিন্তু এটা হত না। তাই চিকিৎসা বিমা কিনুন।

চিকিৎসা বিমা নিশ্চয়ই কেনা উচিত। কিন্তু এ বার ভাবুন, এই বিমার প্রিমিয়ামের পরিমাণ। বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকদের যে টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয়, তাতে অনেকেই কম বয়সে বিমা কিনলেও, যে বয়সে গিয়ে এই বিমার প্রয়োজন সেই বয়সে গিয়ে আর ওই বিমার খরচ চালানোর আর্থিক ক্ষমতা থাকে না। আর এই বয়সে আমাদের দেশে কিন্তু রাষ্ট্রও পাশে থাকে না চিকিৎসার সুব্যবস্থা করতে।

আরও পড়ুন:

ঠিক একই ভাবে যদি আমরা স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো সামাজিক সুরক্ষার প্রধান কয়েকটি স্তম্ভ দেখি, তা হলে নিজেদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা দিয়েই তার অভাবের উপর সিলমোহর দিতে হাত কাঁপবে না। আসলে সমস্যাটা ঠিক এখানেই। আমরা এই ১৩০ কোটির দেশের নাগরিক কি জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে পঞ্চম বৃহত্তম থেকে তৃতীয় বা প্রথম হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়নশীলের তকমা নিয়ে ঘুরব, না কি ব্যক্তি নাগরিকের সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধির পথে হেঁটে প্রথম হওয়ার লড়াই জিতব?

প্রথম পথে হাঁটলে যে সাধারণ নাগরিকের উন্নয়ন হবেই তার কোনও গ্যারান্টি নেই। যেমন আমেরিকা। যেখানে সরকারি তথ্যই বলছে আর্থিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। তাই দেশের আয় বাড়লেই যে সাধারণ নাগরিকের উন্নয়ন হবে তা নয়। তা নির্ভর করবে রাজকোষ নীতির উপর। রাজকোষ বৃদ্ধির ফলে সেই রাজস্ব সাধারণের স্বার্থে কী ভাবে বণ্টন করা হচ্ছে তার উপর। আর উল্টো দিকে নাগরিকের আর্থসামাজিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়ে বৃদ্ধির নীতি যে হেতু প্রথম থেকেই বৈষম্য দূর করে দেশের বৃদ্ধির পথ খোঁজে, তাই এই পথে সুষম উন্নয়ন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই এ বার বোধহয় সময় এসেছে পঞ্চম থেকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার পথে কী ভাবে হাঁটব, নাগরিকের স্বার্থে, না শুধুই দেশ হিসাবে আরও বড় আর্থিক শক্তি হয়ে ওঠার নেশায়, সেই ভাবনায় নিজেদের নিয়োগ করার।

আরও পড়ুন
Advertisement