তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।
এখন দ্বাপর নয়, ঘোর কলি। হস্তিনাপুরী তথা ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে রাজা মন্ত্রী সেনাপতিরা পৌঁছেছেন দিল্লিতে। এমনকি সংসদ ভবনও নবকলেবর ধারণ করেছে। কিন্তু মহাভারত বাস্তবিকই কালজয়ী। অতএব এই ২০২৩ সালে রাজধানীর দরবারে এক সাংসদের উক্তিতে ফিরে এল ‘বস্ত্রহরণ’। ‘ঘুষের বদলে প্রশ্ন’ সংক্রান্ত অভিযোগে অভিযুক্ত কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র লোকসভার এথিক্স কমিটির সামনে জবাবদিহির জন্য হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই তিনি এই অভিযোগ জানিয়ে বেরিয়ে আসেন যে, তাঁকে ‘অনৈতিক’ এবং ‘অন্যায্য ব্যক্তিগত’ প্রশ্ন করে অপদস্থ করা হয়েছে। সমস্বর প্রতিবাদ সহকারে তাঁর সঙ্গেই বেরিয়ে আসেন এথিক্স কমিটির পাঁচ জন সদস্য, যাঁরা বিজেপি-বিরোধী দলের সাংসদ। তাঁদেরই এক জন, বিএসপির দানিশ আলি মন্তব্য করেন: আজ যেন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হল। অতঃপর লোকসভার স্পিকারকে লেখা প্রতিবাদী চিঠিতে মহুয়া নিজেও ব্যবহার করেছেন মহাভারতীয় শব্দটি। অর্থাৎ, ‘বস্ত্রহরণ’ কার্যত ভারতীয় সংসদের নিত্যকর্মপদ্ধতিতে স্থান করে নিয়েছে! সনাতন ভারতের উপাসকরা নিশ্চয়ই গর্বিত বোধ করছেন।
যে অভিযোগকে কেন্দ্র করে এই ঘটনাপরম্পরা, তার সত্যাসত্যবিনিশ্চয়ে সংসদীয় কমিটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিটির কর্তাব্যক্তি বা নিয়ামকদের আচরণ এই বিষয়ে ভরসা দেয় না। নৈতিকতার বৃহত্তর ও গভীরতর মাপকাঠিতে বিচার করলে প্রথমেই বলা দরকার যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে মহুয়া মৈত্র কাঙ্ক্ষিত দায়িত্বজ্ঞান ও বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছেন কি না, তা বিচার্য। যথেষ্ট সময়, নিরপেক্ষতা ও তথ্যের ভিত্তিতে তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সংসদীয় পোর্টাল-এর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র অন্য কোনও ব্যক্তিকে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের যুক্তি প্রয়োগ করতে হয় বা রক্ষাকবচ বজায় রাখতে হয়, এ ক্ষেত্রে তা মেনে চলা হয়েছিল কি না, সে বিষয়েও পরীক্ষা আবশ্যিক। তবে নৈতিকতার ব্যাকরণের সেই প্রথম সূত্রটি সাংসদের মতো পদাধিকারীদের ভুলে গেলে চলে না যে, তাঁদের আচরণ লোকচক্ষে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা জরুরি। ব্যক্তিগত জীবন এবং জনপরিসরের দায়িত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে সীমারেখাটি অস্পষ্ট হয়ে গেলে সন্দেহ ও সংশয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, এই সহজ সত্যটি মাননীয়া সাংসদের অজানা নয় বলেই নিশ্চয় অনুমান করা চলে।
কিন্তু এই ঘটনাবলিতে দেশের শাসক শিবির ও তাদের অনুগামীরা যে আচরণ করেছেন, তা নৈতিকতার বহু শর্তকেই সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে। এথিক্স কমিটির কাছে দাখিল করা বহু অভিযোগের মধ্যে কোনটিকে বিচারের জন্য বেছে নেওয়া হবে, সেই অধিকার প্রয়োগে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির তাগিদ প্রকট হয়ে ওঠেনি কি? মহুয়া মৈত্র সংসদে এবং অন্য পরিসরে শাসক শিবিরের— এবং তাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্যবসায়ীদের— বিরুদ্ধে ক্রমাগত সরব না হলেও তাঁর কাছে একই ভাবে কৈফিয়ত তলব করা হত কি? আবার, যে ভাবে এবং যে ভাষায় ক্ষমতাবানদের বিভিন্ন মহল থেকে এক জন সাংসদকে আক্রমণ করা হয়েছে, তা-ও অত্যন্ত আপত্তিকর। মহুয়া মৈত্রের আচরণ এবং উক্তি নিয়েও আপত্তি থাকতে পারে; তিনি নিজের ক্রোধ বা ক্ষোভকে জবাবদিহি এড়ানোর কৌশল হিসাবে ব্যবহার করেছেন কি না সেই প্রশ্নও উঠতে পারে; কিন্তু এক জন সাংসদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যে ধরনের কুরুচিসঞ্জাত প্রশ্নমালার অভিযোগ উঠেছে, তা এক কুৎসিত পিতৃতান্ত্রিক ‘ঐতিহ্য’কেই চিনিয়ে দেয়, এ দেশের সমাজে— বিশেষত বর্তমান শাসকদের বিভিন্ন মহলে— আজও যার লজ্জাকর এবং উদ্বেগজনক প্রভাব অতিমাত্রায় প্রবল। সংসদীয় নৈতিকতার বিচারপর্বটিতে সওয়াল-জবাব এবং কুশীলবদের আচরণ যে স্তরে নেমে এল, তা একই সঙ্গে কতটা অসংসদীয় এবং অনৈতিক, তার বিচার কে করবে?