ধর্মীয় আবেগ নয়, রুটিরুজিই ভারতীয় রাজনীতির মূল প্রশ্ন
Indian Politics

নেতারা বার্তা নিলেন কি

নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। জওহরলাল নেহরুর পরে এই প্রথম কেউ টানা তিন বার প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশের যাবতীয় সমস্যার জন্য মোদী নেহরুকেই দায়ী করে থাকেন।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৪২
পুনরায়: লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বিজেপির সদর দফতরে নরেন্দ্র মোদী ও জে পি নড্ডা। ৪ জুন, দিল্লি।

পুনরায়: লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বিজেপির সদর দফতরে নরেন্দ্র মোদী ও জে পি নড্ডা। ৪ জুন, দিল্লি। ছবি: পিটিআই।

বিদায়ী বছরের শুরু হয়েছিল অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধনে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২২ জানুয়ারি আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে পাশে নিয়ে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিরোধী শিবির তখন একটাই কথা ভেবেছিল—‘খেলা শেষ!’ অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করে ফেললেন। লোকসভা ভোট নিছক নিয়মরক্ষা।

Advertisement

রামমন্দির উদ্বোধনের পরে দেশ আবেগে ভেসে গিয়েছিল। বিজেপির একাধিক শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীর মত ছিল, লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আনা হোক। এই উন্মাদনা থাকতে-থাকতেই নির্বাচন সেরে ফেলা ভাল! মোদী-শাহ শেষ পর্যন্ত সে পথে হাঁটেননি। ভোট হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়েই। ‘মোদীর গ্যারান্টি’ হাতিয়ার করে নরেন্দ্র মোদী ‘অব কি বার, চারশো পার’-এর হুঙ্কার দিয়েছিলেন। পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাহুল গান্ধী সংবিধান হাতে প্রচারে নেমে পড়েছিলেন।

নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। জওহরলাল নেহরুর পরে এই প্রথম কেউ টানা তিন বার প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশের যাবতীয় সমস্যার জন্য মোদী নেহরুকেই দায়ী করে থাকেন। সম্প্রতি সংসদে সংবিধানের পঁচাত্তর বছরের যাত্রা নিয়ে আলোচনাতেও সংবিধান সংশোধন করে আরএসএস-এর মুখপত্র নিষিদ্ধ করার জন্য তিনি নেহরুকে দুষেছেন। সেই নেহরুর রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে ফারাকটা হল, তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়ও নেহরুর পিছনে জনগণের সমর্থন অটুট ছিল। সেই তুলনায় তৃতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদীর আসন অনেকটাই নড়বড়ে। আরএসএস লোকসভা ভোটের সময় হাত গুটিয়ে বসে থেকে মোদী তথা বিজেপিকে নিজের প্রয়োজনীয়তাটুকু টের পাইয়ে দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীকে এখন শরিক দলের উপর নির্ভরশীল হয়ে সরকার চালাতে হচ্ছে। তা-ও তেলুগু দেশম পার্টি, জেডি(ইউ)-এর মতো এমন কিছু শরিক দল, যারা মতাদর্শগত ভাবে বিজেপির বিপরীত অবস্থানে। এবং যাদের বড়সড় মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে।

মোদী এ-যাবৎ কোনও নির্বাচনে হারেননি। তবে বিদায়ী বছর বার্তা দিয়েছে, তিনি ‘অপরাজেয়’ নন। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার রেখচিত্র নিম্নগামী হলেও বিরোধী শিবির, বিশেষ করে কংগ্রেস খুব একটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না। কারণ হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন কংগ্রেসকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বিজেপি এখন নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার ঢেউয়ে সওয়ার না-হলেও জিততে পারে। বলা ভাল, দুর্বল সংগঠনের জেরে কোমর ভাঙা কংগ্রেসকে হারাতে বিজেপির এখন মোদীকেও প্রয়োজন পড়ছে না। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রে কয়েকটি জনসভা করেছিলেন মোদী। তা সত্ত্বেও বিজেপি হইহই করে জিতেছে।

কংগ্রেসের এই দুর্বলতার সুযোগে তৃণমূল নেতৃত্ব বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব দাবি করছেন। প্রশ্ন উঠছে, বাংলায় ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় রাজনীতিতে হঠাৎ তৃণমূলের এই সক্রিয়তা কেন? এমন নয় যে, এখন মমতা ইন্ডিয়া জোটের নেতা হলেই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরা হবে। লোকসভা ভোট তো পাঁচ বছর পরে। না কি, এর পিছনে মহম্মদ সেলিম, অধীর চৌধুরীদের ‘সেটিং-তত্ত্ব’ অনুযায়ী কোনও রকম বিজেপি-তৃণমূল আঁতাঁত রয়েছে?

রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে না-চটানোর নীতি নিয়েই চলছিলেন ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক ও অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াই এস জগন্মোহন রেড্ডি। খাতায়-কলমে এনডিএ-র শরিক না হলেও বিজু জনতা দল ও ওয়াইএসআর কংগ্রেস সংসদের ভিতরে-বাইরে বরাবরই মোদী সরকার তথা বিজেপিকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। কিন্তু বিদায়ী বছরে বিজেপির কাছেই হেরে গিয়ে নবীন পট্টনায়কের ২৪ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ইতি পড়েছে। এখন বিজেপি তাঁর দলে ভাঙন ধরাচ্ছে। অন্ধ্রে বিজেপির শরিক চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম জগন্মোহনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। মোদ্দা কথা হল, হয় তুমি বিজেপির বিরুদ্ধে, না হলে বিজেপির সঙ্গে। বিরোধিতা করলে বিজেপি আঞ্চলিক দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করবে। যেমন শিবসেনা, এনসিপি-র ক্ষেত্রে করেছে। ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থানে থাকলেও বিজেপি ছেড়ে কথা বলবে না। যেমনটা বিজু জনতা দল ও ওয়াইএসআর কংগ্রেসের বেলায় হয়েছে।

বিরোধী জোটের আঞ্চলিক দলের নেতানেত্রীদের বাগে আনতে বিজেপি ইডি-সিবিআইকে কাজে লাগাচ্ছে বলে অনেক দিনের অভিযোগ। দুর্নীতির মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে গিয়েও যে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ফেরা যায়, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার হেমন্ত সোরেন তা বিদায়ী বছরে প্রমাণ করে দিয়েছেন। এখন সেই একই ভেল্কি দেখাতে জেল থেকে বেরিয়ে মাঠে নেমেছেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। নতুন বছরের গোড়াতেই দিল্লির বিধানসভা ভোট। বিদায়ী বছর ২০২৪ আঞ্চলিক দলগুলির জন্যও বার্তা রেখে যাচ্ছে।

আসল প্রশ্ন হল, বিদায়ী বছরের রাজনৈতিক উত্থান-পতন থেকে বিজেপি ও কংগ্রেস, দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কি আদৌ কোনও শিক্ষা নিচ্ছে?২০২৪-এর লোকসভা ভোটে আমজনতা রামমন্দিরের আবেগে ভেসে গিয়ে ভোট দেননি। নরেন্দ্র মোদীকে ফের প্রধানমন্ত্রীর আসনে ফিরিয়ে মানুষ সরকারের ধারাবাহিকতার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অথচ ভোটাররা বিজেপিকে একার জোরে সরকার গঠনের সংখ্যা ছুঁতে দেননি— এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, যাতে যে কোনও পদক্ষেপের আগে নরেন্দ্র মোদীকে শরিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হয়; প্রয়োজনে বিরোধীদের পাশে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। মোদী সরকার নিজের কর্মসূচিতে এগোলেও ওয়াকফ বিল থেকে ‘এক দেশ, এক ভোট’ বিল যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে হয়েছে। শরিকদের সঙ্গে বিরোধীদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করতে হচ্ছে। ‘চারশো পার’ করে লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসার স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে এই হাত-পা বাঁধা দশাই এখন মোদী সরকারের বাস্তবতা।

বছর শুরু হয়েছিল অযোধ্যা রামমন্দিরের উদ্বোধন থেকে। সেই অযোধ্যাতেই বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির কাছে হেরে গিয়েছিল। সমস্যা হল, দেশের মানুষ যে রামমন্দিরের আবেগে ভেসে লোকসভা নির্বাচনে ভোট দেননি, বছর ফুরোনোর আগেই তা বিজেপি নেতারা ভুলে গিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তাই নতুন করে মন্দির-মসজিদ বিবাদ তৈরি করা হচ্ছে। আজ সম্ভলের জামা মসজিদ, কাল অজমের শরিফ দরগার নীচে মন্দির ছিল বলে দাবি তোলা হচ্ছে। শতবর্ষে পা দেওয়া আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত প্রশ্ন তুলেছেন, বার বার এই মন্দির-মসজিদ বিবাদ খুঁচিয়ে তোলা কেন? কিন্তু ভাগবত সত্যিই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের থামানোর চেষ্টা করছেন, না কি মুখের কথায় প্রলেপ দিচ্ছেন, তা নিয়ে বিরোধীদের সন্দেহ রয়েছে। যে ১০টি মসজিদের জায়গায় মন্দিরের দাবি উঠেছে, তার সিংহভাগই যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে। কংগ্রেস নেতৃত্ব একে বিজেপি-আরএসএস’এর দ্বিচারিতা হিসাবেই দেখছেন।

কংগ্রেস নেতৃত্বও বিদায়ী বছরের রাজনৈতিক বার্তা পড়ে উঠতে পেরেছেন, তেমন মনে হচ্ছে না। কংগ্রেস লোকসভায় ৯৯টি আসন জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু শরিকদের নিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা করার মতো জায়গাতে পৌঁছতে পারেনি। অথচ বিজেপির আসন কমে যাওয়া এবং কংগ্রেসের আসন বৃদ্ধিতেই রাহুল গান্ধীরা কার্যত বিজয় উৎসব শুরু করে দিয়েছেন। ভুলে গিয়েছেন যে, মানুষ কেন বিজেপির দিক থেকে কিছুটা হলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। একাধিক সমীক্ষা জানিয়েছে, এর পিছনে অন্যতম কারণ হল মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব। এক কথায় রুটিরুজির সমস্যা। অথচ হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের ভোটে সেই রুটিরুজির সমস্যাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী কৌশল গড়ে তুলতে কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে। তার বদলে বার বার জাতিগণনার দাবি তুলে ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন রাহুল গান্ধী।

নতুন বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তরের জন্য অবশ্য সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই সময়ই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ছোটবেলার বন্ধু আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত প্রায় একই সঙ্গে পঁচাত্তর বছরে পা দেবেন। বিজেপিতে মার্গদর্শক মণ্ডলী ওরফে রাজনৈতিক অবসরে চলে যাওয়ার বয়স। সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হোক বা না হোক, বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদীর উত্তরাধিকারী হওয়ার লড়াই নতুন বছরে তীব্রতর হবে, এটুকু বলাই যায়।

Advertisement
আরও পড়ুন