ট্রাম্পের সাফল্য বলছে বামগন্ধী এলিট রাজনীতির কী সমস্যা
US Presidential Election 2024

এই ফিরে আসার অর্থ

এত মানুষ এমন একটা কাজ করছেন, কেন, সেটা ভাবতে গেলে মনে হয় মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভরসা রাখতেই হবে। কেমন কাণ্ডজ্ঞান?

Advertisement
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:২০

ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে এলেন। গত চার বছর ধরে তাঁর বিরুদ্ধে চলেছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মামলা, নারীঘটিত থেকে অর্থনৈতিক জালিয়াতি। এ সব সত্ত্বেও আমেরিকার মানুষ তাঁকেই ব্যাপক সমর্থন দিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন। প্রধান কারণ একটাই, বামগন্ধী এলিট রাজনীতিতে মানুষ বিরক্ত।

Advertisement

এত মানুষ এমন একটা কাজ করছেন, কেন, সেটা ভাবতে গেলে মনে হয় মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভরসা রাখতেই হবে। কেমন কাণ্ডজ্ঞান? যে কোনও মানুষ শুনলে অবাক হবেন যে ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশে এক হাজার ডলার মূল্যের কমে চুরি করলে তা গুরুতর অপরাধ নয়, তাতে কার্যত কোনও সাজা হয় না। সুতরাং সেখানে বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল দোকানে দল বেঁধে চুরি করা এখন কোনও ব্যাপার নয়। সেখানে দোকানের রক্ষীরাও এ সবে বাধা দেন না, কারণ এ নিয়ে পুলিশ কিছু করবে না। এর ফলে ড্রাগের পয়সা উঠে আসছে এই নিরাপদ চুরির মাধ্যমে, বাড়ছে ড্রাগ মাফিয়াদের দাপাদাপি। ফলে অনেক বড় দোকান তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য প্রদেশে। এ বারের নির্বাচনে ৭০% ক্যালিফোর্নিয়াবাসী জানিয়েছেন যে, তাঁরা এই ব্যবস্থার অবসান চান। (আমেরিকার নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ছাড়াও আরও নানা বিষয়ে মতামত দেওয়ার ব্যবস্থা আছে)।

নিউ ইয়র্ক শহরে ৫০ শতাংশ মানুষ সরকারি বাসে ভাড়া দেন না, তাঁদের কেউ কিছু বলেও না। এতে নিউ ইয়র্ক পরিবহণ ব্যবস্থার ক্ষতি হয় বছরে ৩১ কোটি ডলার (২৫০০ কোটি টাকা)। বিভিন্ন প্রদেশে শিশু-সন্তানের যৌনতার সিদ্ধান্ত থাকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে, অর্থাৎ আপনার সন্তান পুরুষ না নারী, তা শুধু তার শারীরিক চিহ্নের উপর নির্ভর করবে না, সেটা ঠিক করে দেবে বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা যাঁরা মূলত ‘সজাগ’ (ওক) পন্থী। এর বিরুদ্ধে গেলে মাতাপিতার সাজা অবশ্যম্ভাবী। সাধারণ আমেরিকান এই সব নিয়ে বিরক্ত।

এর পর এল জর্জ ফ্লয়েড কাণ্ড। জর্জ এক জন অপরাধী। ১৯৯৭ থেকে ২০০৫, এই আট বছরে আট বার তার কারাবাস হয়েছে ড্রাগ-সহ অন্যান্য অপরাধে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ জেলে কাটিয়েছে এক জনের উপর অস্ত্র দিয়ে আক্রমণের অপরাধে। ২০২০-র মে মাসে জর্জ ফ্লয়েড ধরা পড়ে দোকানে ২০ ডলারের ভুয়ো নোট দেওয়ার অপরাধে এবং তাকে গ্রেফতারের সময়ে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ তাকে এমন মাটিতে চেপে ধরে যে, সে প্রাণ হারায়। সেই পুলিশ এখন কারাগারে। এই ঘটনায় দেশ জুড়ে শুরু হয় ধ্বংসাত্মক আন্দোলন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বা ‘কৃষ্ণাঙ্গের জীবনও গুরুত্বপূর্ণ’। প্রচুর মিছিল সভা বিক্ষোভ ভাঙচুর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবরোধ ইত্যাদি। অথচ এই আন্দোলনের প্রচারে একটি সত্য লুকিয়ে রাখা হল, আমেরিকার ‘ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস’ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হন কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বারাই। এই আন্দোলনের একটি প্রধান দাবি ছিল— পুলিশের বাজেট কমাও, সেই অর্থে হবে বঞ্চিতদের উন্নয়ন। অনেক ডেমোক্র্যাট-শাসিত রাজ্যে শহরে পুলিশের বাজেট কমানো হল, ফলে অপরাধ হলে পুলিশ পাওয়া সমস্যা হল, ছোটখাটো অপরাধে পুলিশ সাড়া দেওয়া বন্ধ করল। নাগরিক জীবনে সমস্যা বাড়ল।

এ সব কেন হচ্ছে? গত কয়েক দশকে বাম-উদারপন্থীরা মনে করছেন, একটি সর্বরোগহর ঔষধ হল বৈচিত্র-সমতা-অন্তর্ভুক্তি (ডাইভার্সিটি-একুইটি-ইনক্লুসিভনেস, বা সংক্ষেপে, ‘ডিইআই’)। সোজা কথায় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানকে বলা হল তুমি সব সমস্যার কারণ, তার নিরসনে প্রয়োজন ডিইআই।

অভিযোগ, আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতির মুখ্য চালক আমেরিকাকে দুর্বল করে, নিজেদের মর্জিমাফিক চালনার চেষ্টায় রত এই ডিইআই গোষ্ঠী। এর প্রধান অস্ত্র সংবাদমাধ্যম, তথ্যমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে নিয়ন্ত্রিত ও একপক্ষীয় প্রচার চালানো। এই ভাবনা এত দিনে প্রবিষ্ট হয়েছে কর্পোরেট মহল থেকে শিক্ষা জগতে। আমেরিকার বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি হয়ে উঠেছে আরব দুনিয়ার সমর্থক, যে আরবের শাসকরা কিন্তু কোনও রকম বৈচিত্র— ধর্ম, লিঙ্গ বা ভাষার বৈচিত্র— সহ্য করেন না। অথচ, এই গোষ্ঠী শিক্ষার প্রাঙ্গণে চিন্তার বৈচিত্র একদম পছন্দ করে না, একে প্রশ্ন করে এমন শিক্ষক বা পুস্তক আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনে প্রায় অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ।

ডেমোক্র্যাট ও উদার বামপন্থীরা আমেরিকার মানুষকে গাত্রবর্ণ, লিঙ্গের বহু কিসিমের বিভাগ, ভাষা ইত্যাদির ভাগাভাগির উপর ভিত্তি করে নির্বাচনী সুবিধা পেতে চেয়েছিলেন। এ বারের ভোটের ফল বলে দিচ্ছে, আমেরিকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মনে করেছেন এ সব হইচইয়ের মধ্যে তাঁদের জীবন ও জীবিকার সমস্যাগুলি গুরুত্ব হারাচ্ছে। গত চার বছরে আমেরিকার সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা বেড়েছে, বেড়েছে নিরাপত্তার অভাব ও অরাজকতা। এই সাধারণ মানুষ ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমেরিকান টেলিভিশন মাধ্যম ক্রুদ্ধ হয়েছে যে, স্প্যানিশভাষীরা, কৃষ্ণাঙ্গরা, নারীরা এ বার ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমেরিকান নারীদের একটি অংশ যেমন গর্ভপাত নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থানে অসন্তুষ্ট, তেমনই আর একটি অংশ নারীদের খেলা থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘নারী’ বলে চিহ্নিত জৈবিক পুরুষদের যোগদানে ট্রাম্পের বিরোধিতায় খুশি। ফলে গড় আমেরিকানদের বিপুল সমর্থনে গত বারের সুইং স্টেটগুলি— যে সব রাজ্যের জয় চূড়ান্ত জয় এনে দিতে পারে, এ রকম সব ক’টি রাজ্যে গত বারের ডেমোক্র্যাটদের জয়কে মুছে দিয়ে এ বার জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

প্রসঙ্গত, গত চার বছরে আমেরিকাতে এক কোটির বেশি বেআইনি অনুপ্রবেশ করেছেন। আমেরিকা সরকার এঁদের স্বাগত জানিয়েছে, আইনি নাগরিকদের টাকায় তাঁদের বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করেছে, এক-একটি ছোট শহর জনপ্লাবিত হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে নানা ধরনের অপরাধ, নেশা ব্যবসা। এঁদের অনেকে ভোটও দিচ্ছেন। ট্রাম্প বলেছেন, এঁদের সবাইকে তিনি দেশছাড়া করবেন। এক বিরাট অংশের আমেরিকান নাগরিকের কাছে এই অবস্থান জোরালো কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক।

সাম্প্রতিক বেআইনি অভিবাসনের জেরে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গিন অবস্থা দেখলেও বোঝা যায়, পরিস্থিতির গুরুত্ব কতটা। বললে ভুল হবে না যে, ইউরোপীয় সংস্কৃতি এখন ঢেকে যেতে বসেছে কালো বোরখায়। বৈচিত্রের দাবিতে এখন লন্ডনে ইংরেজি না জেনে বাংলাতেই বেঁচে থাকা যায়। ট্রাম্পের জয় ইউরোপের অভিবাসন-বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে, ধরে নেওয়া যায়। বেআইনি অনুপ্রবেশ ভারতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গেও অন্যতম সমস্যা। কেন্দ্রীয় সরকার মাঝেমধ্যে গরম গরম কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই করে ওঠে না।

আর একটি গুরুতর বিষয় হল পরিবেশ। ট্রাম্পের পরিবেশনীতি সরল: আমেরিকান অর্থনীতিকে ক্ষতি করবে এমন পরিবেশনীতি মান্য হবে না। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে বিশ্বময় কার্যক্রমের বিরোধী ট্রাম্প আগের শাসনের সময়ই এ নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে আমেরিকার যোগদান অনেকাংশে সীমিত করেছিলেন। এ বারও নিশ্চয় তা-ই করবেন। ফলে, পরিবেশ নিয়ে নানা নীতির বাস্তবায়নে ইউরোপের আর্থিক দায়িত্বই বাড়বে অনেক।

ভারতের পরিবেশ সংক্রান্ত দায়িত্বের দু’টি দিক আছে। এক বিভিন্ন বিদেশি যৌথ প্রকল্প বা ব্যবসায় ভারতকে আন্তর্জাতিক পরিবেশনীতি মানতে বাধ্য হতে হয় যার জন্য আর্থিক দায়ভার নিতে হয়। দ্বিতীয় দিকটি হল, একটি বড় অংশের ভারতীয় বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও আধিকারিকেরা এখনও চিন্তায় পশ্চিমি দাসত্ব বহন করে চলেছেন, তাঁরা অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় পরিবেশ নিয়ম, প্রযুক্তির পক্ষে থাকেন। গরিব দেশে উন্নয়নই যে প্রধান দায়িত্ব এই কাণ্ডজ্ঞান তাঁদের কম। ট্রাম্প-যুগের প্রত্যাবর্তন কি তাঁদের কোনও বার্তা দিচ্ছে?

আরও পড়ুন
Advertisement