দুষ্কৃতীদের গায়ে ‘দলের জামা’ থাকলে এই বিষ দূর করা শক্ত
Unrest over Ram Navami Procession

হে রাম! হায় রাজনীতি!

উত্তর কলকাতার এক বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাকে দেখেছি, পাঞ্জাবির দু’পকেটে মন্দির ও মসজিদের আশীর্বাদি নিয়ে তিনি প্রচারে বেরোতেন। যেখানে যেটা দরকার সেটা পকেট থেকে বেরোত।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:০৮
Rama Navami procession.

উগ্র: হাওড়ায় অস্ত্র হাতে রামনবমীর মিছিল। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

রামনবমী নিয়ে পর পর অশান্তিতে রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তাপ তীব্র হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রবণতা হল, রাজনীতির মূলস্রোতকে পারস্পরিক বিদ্বেষের অন্ধকার চোরা গলিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা। বলতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক ‘সংস্কৃতি’র এই অবতার সারা দেশেই সাম্প্রতিক আমদানি, অল্প কয়েক বছরে যার বাড়বৃদ্ধি আগাছার মতো অনিয়ন্ত্রিত। উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা তার অলঙ্কারস্বরূপ!

এটা ঠিক যে, ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে হিসাব কষা এই রাজ্যেও নতুন কিছু নয়। সংরক্ষিত আসনের বাইরে প্রার্থী করা বা ভোট আদায়ের জন্য প্রচারের সময় সব দলই খেয়াল রেখেছে সেই কেন্দ্রে ভোটারের ‘ভাগাভাগি’ কী রকম। তবে আজকের মতো রাজনীতির মঞ্চে সেগুলি কখনও সম্প্রীতির মূল কাঠামোকে আঘাত করার চক্রান্তে ব্যবহৃত হয়নি। এটাই বাংলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য হয়েছে।

Advertisement

যেমন ধরা যাক, ২০০৪-এর লোকসভা ভোটে জঙ্গিপুরে তৃণমূলের প্রার্থী বদলের বিষয়টি। এ-নিয়ে কেউ কোনও দিন আলাদা করে ভাবার প্রয়োজনই বোধ করেন না। শুধু মনে করানোর জন্য বলি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে সেখানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মদন মিত্রকে ঘোষণা করেছিলেন। পরে প্রার্থী করা হয় আরএসপি থেকে যাওয়া শীষ মহম্মদকে। কেন ওই প্রার্থী বদল, ভোটের অঙ্কে তার বিশদ আলোচনা এখানে অর্থহীন। তবে ঘটনা হল, সিপিএম-কে হারিয়ে সে বারই প্রথম সরাসরি ভোটে জেতেন প্রণববাবু। এটাই ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।

উত্তর কলকাতার এক বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাকে দেখেছি, পাঞ্জাবির দু’পকেটে মন্দির ও মসজিদের আশীর্বাদি নিয়ে তিনি প্রচারে বেরোতেন। যেখানে যেটা দরকার সেটা পকেট থেকে বেরোত। এ সবের মধ্যে মজার খোরাক এবং রাজনীতি দুটোই ছিল। কিন্তু কোথাও কোনও রকম বিভেদ সৃষ্টির লেশমাত্র ছিল না।

শুধু কি তা-ই? কোনও এলাকার ভাষাগত প্রাধান্যের দিকও তো ভোটের বিবেচনায় থাকে। বড়বাজার অঞ্চলের প্রার্থী, আর বাগবাজার পাড়ার প্রার্থী কি একই মাপকাঠিতে বিবেচনা করা হয়! তবে বাংলায় এ সবই বহিরঙ্গের আবরণ, চেতনার গভীরে যার ছাপ পড়ে না।

বরং, আমরা যারা বাংলায় থাকি, এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, বা যারা পুরুষানুক্রমে ‘বঙ্গবাসী’, সবাই জানি, হানাহানি ও বিভাজনের ক্ষত আমাদের কত বড় ক্ষতি করেছে। সেই আগুনে আমরা সবাই পুড়েছি। তাই এমন কোনও পরিস্থিতি বাংলা চাইতে পারে না, যেখানে বিভেদের বিষ শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে। তা হলে কোন মন্ত্রবলে হঠাৎ সেই বোধ এখন লোপ পাচ্ছে? সে কোন রাজনীতি!

দুর্গাপুজো, কালীপুজো, ইদ, মহরম, বড়দিনের মতো নানা ধর্মের উৎসব পালন তো যুগ যুগ ধরে হয়ে চলেছে। তুলনায় এই রাজ্যে রামনবমী, হনুমানজয়ন্তী ইত্যাদি প্রসার লাভ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। কলকাতার অলিগলিতে এখন যে ভাবে সর্বজনীন গণেশপুজো হয়, দশ বছর আগেও তেমন দেখা যেত না। তার পিছনে রাজনীতি ছাড়াও কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ আছে বলে মনে হয়।

কিন্তু সেই সব বিশ্নেষণে না গিয়ে আপাতত এটুকু বলার যে, কোনও ধর্মের কোনও উৎসব কখনও মানুষের রক্তচাপ বাড়ায়নি। এখন বাড়ায়। দুর্গাপুজোর সঙ্গে মহরমের সময় মিলে গেলে কিংবা রামনবমীর মিছিল বার হলে ইদানীং জল্পনা, ফিসফাস, গুজব হাওয়ায় ছড়াতে থাকে। তার সব যে অমূলক, সেটাও বলা যাবে না। পরিণতি কী হয়, এ বার রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে একাধিক বড় অশান্তি ও দুর্বৃত্তদের দাপাদাপি তার সর্বশেষ এবং নিদারুণ উদাহরণ।

স্বাধীনতার মানে যে যথেচ্ছাচার নয়, দুষ্কৃতীদের কাছে সেই বোধ আশা করা মূর্খামি। কিন্তু এ-দল, সে-দলের তকমা দিয়ে তাদের যাঁরা মাঠে নামান, সেই রাজনীতির কারবারিদের ‘চৈতন্য’ ফিরবে কবে? যত দিন যাচ্ছে, প্রশ্নটি বোধ হয় ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

রামনবমীর মিছিলে ইট পড়ার সব অভিযোগই একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়ার জায়গা নেই। বস্তুত এমন ঘটনা একটিও ঘটে থাকলে তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দনীয়। কারণ, এটা পারস্পরিক সৌহার্দের পরিপন্থী। এই দুর্বুদ্ধির উৎস যেখানেই থাক, তার যথাযথ সাজা প্রাপ্য। তবে একই ভাবে রামচন্দ্রের জন্মোৎসবের শোভাযাত্রায় খোলা তরোয়াল উঁচিয়ে আস্ফালন, ডান্ডা তুলে, আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’-এর জয়ধ্বনি দেওয়া প্রভৃতি ‘বিধান’ কোন ধর্মপুস্তকে লেখা আছে, সেটাও এই পরিসরে পরিষ্কার হওয়া দরকার। এই রকম প্রদর্শনে যে প্ররোচনার উপাদান থাকতে পারে, মিছিলের উদ্যোক্তা এবং প্রশ্রয়দাতাদের তা না বোঝার কথা নয়। তার পরেও এ জিনিস চলতে পারে কী করে, আইনের এটিও দেখা উচিত।

আইনশৃঙ্খলাজনিত যে কোনও ঘটনায় সরকারের দিকে প্রথম আঙুল ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিরোধীরা শাসককে কাঠগড়ায় তোলেন। পাল্টা বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ জানান ক্ষমতাসীনরা। ইদানীং তার সঙ্গে বার বার যুক্ত হয়ে পড়ছে জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের তকমা। আর এক হাতে তালি বাজে না বলেই ‘বিপদ’ বাড়ছে।

রামনবমীর মিছিল ঘিরে হাওড়ার শিবপুর, হুগলির রিষড়া, উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা সবই বস্তুত সেই সুতোয় বাঁধা। কোথাও অঘটনের মাত্রা কিছু বেশি, কোথাও হয়তো একটু কম। সে সব বর্ণনা যত এড়ানো যায় ততই ভাল। কারণ, সেই চর্চায় গ্লানি বাড়ে। আর কিছু কুচক্রী মনে করে, তারা কতই না ‘মহান’ কাজ করেছে!

যদিও বিষবৃক্ষের শিকড় তাতে ওপড়ানো যায় না। কারণ যে সমাজে আমরা বাস করছি, তারই একটি অংশ সেই বিষগাছকে ক্রমাগত জল-হাওয়া জুগিয়ে ‘লালন’ করে চলেছে। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ বা অন্য কোনও ছলে। তাই ওই রকম কোনও অশান্তির কবলে সাধারণ মানুষের বাড়ি ভাঙলে, দোকান পুড়লে, স্কুটার-গাড়ি চুরমার হলে এখন আগে খোঁজ নেওয়া হয়, হিন্দু, না ওরা মুসলিম? যেন সেটাই আঘাতের মাপকাঠি! উভয়ের রক্তের রং যেন আলাদা! ‘মানুষ’ ভাবনাটিই সেখানে বিবেচ্য হয় না। এটাই দুর্ভাগ্য!

আরও দুর্ভাগ্যের হল, এ সব ক্ষেত্রে আক্রান্ত এবং আক্রমণকারী হিসেবে ‘চিহ্নিত’ দু’পক্ষের গায়ে প্রথমেই রাজনীতির দু’টি জামা পরিয়ে দেওয়া। শাসক এবং বিরোধী কেউ এ-কাজে কম যায় না। ফলে মূল বিষয়টি দ্রুত আড়ালে চলে গিয়ে দলবাজি হয়ে ওঠে মুখ্য।

অর্থাৎ, আমার বিরুদ্ধে যদি আপনাকে আক্রমণ করার অভিযোগ ওঠে, তা হলে তার মূলে পৌঁছে সত্যাসত্য নির্ধারণ এবং ভবিষ্যতের জন্য শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির আগেই রাজনৈতিক চাপানউতোরে বিষয়টির মোড় ঘুরে যায়। তখন কোন দল কোন দলকে আক্রমণ করেছে বা কোন দল কোন দলকে প্ররোচিত করেছে, সেটা হয়ে ওঠে প্রধান বিতর্ক এবং ভোট কুড়োনোর হাতিয়ার। পাপের বীজ তাই মরে না! সব দল এই দোষে দুষ্ট।

দোষের ভাগ পুলিশেরও কম নয়। সবাই জানেন, উর্দি পরা পুলিশবাহিনীতে কোন অফিসার কোন দলের ‘অনুগত’, সেই চর্চা মুখে মুখে ফেরে। তার কতটা ঠিক বা ভুল, সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ধারণাটি জনমনে বাসা বেঁধে আছে। তার মধ্যে যেতে চাই না। শুধু জানতে ইচ্ছা করে, পুলিশের ‘ইন্টেলিজেন্স’ কি কোনও ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক ঘটনাবলির আগাম আভাস পায়নি? তবে সেই ব্যর্থতার চুনকালি পুলিশের মুখে লাগবেই। আর জেনেও যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা তারা না-নিয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে, আজ পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement