Hospitals and Health Workers

বোমার লক্ষ্য হাসপাতাল

প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষ এগিয়েছে, কিন্তু সভ্যতার নিরিখে এগিয়েছে কি? আধুনিক যুদ্ধে বারংবার আক্রান্ত হচ্ছে হাসপাতাল।

Advertisement
জয়ন্ত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৩ ০৬:০৮
An image of Bombing

যুদ্ধ যত তীব্র হচ্ছে, তত আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য-কর্মীরা। ফাইল ছবি।

আধুনিক যুদ্ধ যে কত নৃশংস, প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে, এখন প্রতি দিন সংবাদমাধ্যম তার নিদর্শন হাজির করছে। ইউক্রেন, ইয়েমেন, সুদান থেকে পাওয়া একের পর এক ছবিতে ছিন্নভিন্ন, দগ্ধ দেহের বীভৎস ছবি দ্রষ্টাকে হতবাক করে। তবু মর্মে গিয়ে বেঁধে সুদানের পাঁচ জন মায়ের আর্তনাদ। একটি আন্তর্জাতিক খবরের চ্যানেলকে তাঁরা বলেছিলেন, “আমরা সন্তানদের ইনকিউবেটরে ফেলে এসেছি” (১৮ এপ্রিল)।

হাসপাতালের উপর সামরিক আক্রমণ সম্ভবত একবিংশ সভ্যতার গাঢ়তম কলঙ্কগুলির একটি। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনিতে দেখা যায়, জনপদের থেকে দূরে রণক্ষেত্র বেছে নিয়েছে দুই পক্ষ। প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষ এগিয়েছে, কিন্তু সভ্যতার নিরিখে এগিয়েছে কি? আধুনিক যুদ্ধে বারংবার আক্রান্ত হচ্ছে হাসপাতাল। গত ১৫ এপ্রিল আমেরিকার একটি প্রধান সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল, সুদানের যুদ্ধ যত তীব্র হচ্ছে, তত আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য-কর্মীরা। দেশের সমস্ত হাসপাতাল যেন রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। চিকিৎসার কথা এখানে পরিহাসের মতো শোনায়। মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট-এ সুদানের দু’জন ডাক্তার জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য-কর্মীদের উপর সামরিক বাহিনীর আক্রমণের জন্য দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গভীর সঙ্কটে পড়েছে, বহু চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের উপরে টিয়ার গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো কি যুদ্ধাপরাধ নয়?

Advertisement

২০১৫ সালে আফগানিস্তানের একটি হাসপাতালে আমেরিকার বোমাবর্ষণে ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’ সংগঠনের বিয়াল্লিশ জন ডাক্তার-চিকিৎসাকর্মী মারা যান। সামরিক সংঘর্ষে হাসপাতালকে লক্ষ্য করার প্রবণতা সম্পর্কে ২০২০ সালেই সতর্ক করেছিল আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি। তাদের একটি প্রতিবেদনে (ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স: অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি ফর অ্যাটাকস অন হসপিটালস ইন আর্মড কনফ্লিক্ট) বলা হয়েছে, সশস্ত্র সংঘর্ষে হাসপাতাল ধ্বংস হওয়ার ক্ষতি রাস্তা প্রভৃতি পরিকাঠামো নষ্ট হওয়ার চাইতে অনেক বেশি। অর্থাৎ হাসপাতালের ভূমিকা কেবল রোগীর চিকিৎসা নয়। তা এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে পরিচয় নির্বিশেষে যে কোনও আহত, অসুস্থ মানুষ স্থান পাবেন, পরিচর্যা পাবেন— এই বিশ্বাস সমাজের অন্যতম ভিত্তি। হাসপাতালের নিরাপত্তা হানি হলে গোটা দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

দু’দেশের যুদ্ধে, কিংবা দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধে, যে পক্ষেরই জয় হোক, স্বাস্থ্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার প্রধান কারণ যুদ্ধের জন্য দারিদ্র ও ক্ষুধা আরও তীব্র হয়— আফ্রিকার যে দেশগুলিতে দীর্ঘ দিন সংঘাত চলছে, সেগুলিতে অনাহারের পরিস্থিতিও তৈরি হয়ে রয়েছে। সুদানের জনসংখ্যা সাড়ে চার কোটি, তার এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য-সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। একেই কোভিড-১৯ অতিমারি, এবং ইথিয়োপিয়া থেকে উদ্বাস্তুদের সুদানে প্রবেশের জন্য সে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সঙ্কটে ছিল। এখন জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার মুখে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সংবাদে প্রকাশ, যুদ্ধের আগে থেকেই দেশটি এইচআইভি, টিবি এবং হেপাটাইটিস নিয়ে বিপর্যস্ত ছিল। যুদ্ধের পরে যত সময় এগিয়েছে, চিকিৎসাকেন্দ্রের উপরে ক্রমাগত আক্রমণ, অপ্রতুল চিকিৎসা ইত্যাদি সুদানের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের প্রভাব কী হতে পারে, তার আর একটি দৃষ্টান্ত ইয়েমেন, যেখানে ২০১৫ সাল থেকে হিংসা চলছে। ইয়েমেনে খাদ্যের মূল্য বেড়েছে ৫৫%, জিডিপি-র সঙ্কোচন হয়েছে ৩৩%। ইউনিসেফ-এর হিসাব অনুযায়ী সে দেশের প্রায় ১ কোটি শিশুর কোনও না কোনও রকম ‘পুষ্টি সহায়তা’ প্রয়োজন, এবং পাঁচ লক্ষেরও বেশি শিশুর অপুষ্টি এত তীব্র যে, খুব তাড়াতাড়ি সাহায্য না পেলে তারা প্রাণ হারাতে পারে। ইউনিসেফ মনে করাচ্ছে স্বাস্থ্যের আরও একটি দিক, যা সহজে উপেক্ষিত হয়— মানসিক স্বাস্থ্য। ভয়, শোক, মানসিক চাপ, অবসাদে ইয়েমেনের অন্তত আশি লক্ষ মানুষ দিশাহারা, তাঁদের চিকিৎসা ও পরিচর্যা দরকার। একটি ছোট দেশকে সমস্ত দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। রোগ-মোকাবিলার ব্যবস্থা, জল, নিকাশি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে মৃত্যু হচ্ছে বহু মানুষের। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত হাসপাতালের কাজেও বাধা তৈরি করছে— জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না, ইমার্জেন্সি চিকিৎসা বা আইসিইউ-তে গুরুতর অসুস্থদের চিকিৎসা করা যাচ্ছে না, ভ্যাকসিন এবং ওষুধ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় ‘কোল্ড চেন’ রক্ষা করা যাচ্ছে না। যুদ্ধের সময়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার সময় কারও হয় না।

ইয়েমেনের যুদ্ধের বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ বার বার মনে করিয়েছিল যে, হাসপাতালগুলি আক্রান্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য-পরিষেবা তছনছ হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসক সমাজের তরফ থেকে বার বার আবেদন করা হয়েছে, হাসপাতাল এবং সাধারণ নাগরিকের উপর আক্রমণ বন্ধ করা দরকার। সে কথা কোনও তরফেই শোনা হয়নি। যে কোনও দেশে সংঘাতের ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলির নিরাপত্তা নিয়ে, চিকিৎসা পরিষেবাকে চালু রাখার বিষয়টি নিয়ে কতখানি সরব, সক্রিয় হবে আন্তর্জাতিক মহল, কতটা কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারবে, সেটাই হল প্রশ্ন।

আরও পড়ুন
Advertisement