—প্রতীকী ছবি।
এ বছরের গোড়ার দিকে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতের সব হাই কোর্ট থেকে সমকামী-রূপান্তরকামীদের বিবাহ, দত্তক, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সব মামলা শীর্ষ আদালতে নিয়ে আসে। একটি পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে মামলার শুনানি চলে, তা অনলাইনেও প্রচার হয়। ছ’মাস পরে সব আশা ধূলিসাৎ হল। পরিবর্তন আনার দায়িত্ব শীর্ষ আদালত তুলে দিল সংসদের হাতে। ১৭ অক্টোবরের এই রায়কে সম্মান জানিয়েও বলতে হয়, সংসদে এখন সংখ্যাগুরু এমন একটি দল, যার সরকার ওই মামলাতেই বিবাদী পক্ষ হয়ে জানিয়েছিল যে, সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। ‘অজাচার’ (ইনসেস্ট) ও ‘বালকামিতা’-র (পেডোফিলিয়া) সঙ্গে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতাকে তুলনা করেছিল! সেখানে পরিবর্তনের আশা কতটুকু?
অনেকে বলছেন, এই মামলার সূত্রে সমকামী-রূপান্তরকামীদের দৃশ্যমানতা বেড়েছে, তা-ও তো অনেক। হতে পারে, তবু এটাই সত্য, সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে ভারতীয় সমকামী-রূপান্তরকামীরা বিবাহের, দত্তকের এবং উত্তরাধিকারের সমানাধিকার পেলেন না। ভারতে সরকার কে বানাবে, সেই দল নির্বাচনের জন্য ভোটাধিকার সব প্রাপ্তবয়স্কের থাকতে পারে, কিন্তু বিবাহের জন্য সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার নেই সমকামী-রূপান্তরকামীদের। সারা জীবন এক সঙ্গে কাটালেও খোরপোশ-পেনশনের উত্তরাধিকারী বলে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না নিজের সঙ্গীকে। তাঁদের পালন করা সন্তানকে অধিকারহীন ঊনমানব হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
তবে এটাই প্রথম নয়। ২০০৯ সালে দিল্লি হাই কোর্ট ৩৭৭ ধারা— যা সমকামকে ‘অপরাধ’ বলে ধার্য করে— অবলুপ্ত ঘোষণা করলেও, ২০১৩-য় সুপ্রিম কোর্টে এ-বিষয়ে মামলা হলে ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় যে, ব্যাপারটি ভারতীয় সংসদের এক্তিয়ার-ভুক্ত। যা পরিবর্তন হবে, তা সংসদের সদস্যরাই করবেন। সংসদের কোনও সদস্য তার পর এ-বিষয়ে একটি শব্দও বলেননি। এর পাঁচ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৩৭৭ ধারাকে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য অবলুপ্ত করে ‘অপরাধী’ তকমা থেকে তাঁদের বার করে। ওই রায়েই এক বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের উচিত সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা— এত দিন কেবল লিঙ্গ-যৌনতার জন্য যে সামাজিক হেনস্থা-হিংসা ও অবমাননার মধ্যে দিয়ে তাঁদের যেতে হয়েছে, তার জন্য।
২০১৪ সালে নালসা রায় (যা রূপান্তরকামীদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে) এবং ২০১৮ সালে ৩৭৭ ধারার বিলুপ্তি— সুপ্রিম কোর্টের এই দুটো রায় ভারতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। যুগ যুগ ধরে পরিবারে, শিক্ষাঙ্গনে, কাজের জায়গায়, টিভি চ্যানেলে নানা বয়সের সমকামী-রূপান্তরকামীরা হেনস্থা-হিংসার শিকার হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পেয়েছিলেন ওই দু’টি রায়ের কারণে। সেই সাহসে ভর করেই তাঁরা বিবাহ, দত্তক ও উত্তরাধিকারের সমানাধিকার দাবি করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্ট যে সংসদের উপরেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা হয়তো পদ্ধতিগত ভাবে যথার্থ। কিন্তু এ-ও সত্য, ভারত একটি সমকাম-বিদ্বেষী রাষ্ট্র। এখানে প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন যৌনতার মানুষ অত্যাচারের শিকার হন। শুধু সামাজিক হেনস্থা এড়াতে বিসমকামী বিবাহে আবদ্ধ হন। ধর্মীয় গুরুরা ‘সমকামিতার রোগ’ নিরাময়ের আশ্বাস দেন জাতীয় টেলিভিশনে! আর সরকার মনে করে, কেবল সন্তানোৎপাদনই যৌনতার উদ্দেশ্য! ২০১৪-র নালসা রায় এবং ২০১৮-য় ৩৭৭ ধারা অবলুপ্তির রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল বিভিন্ন গণমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে দেশের সমকামী-রূপান্তরকামীদের অধিকার সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করার। তা পালন করেনি কোনও সরকার। ১৭ অক্টোবরের রায় নিয়েও মুখে কুলুপ এঁটেছে সকলে।
লেরয় এফ অ্যারান্স তাঁর প্রেয়ার্স ফর ববি উপন্যাসে দেখিয়েছেন, ববির মা মেরি গ্রিফিথ তাঁর সন্তানের সমকামিতা মেনে নিতে পারেন না, কারণ তাঁর খ্রিস্টধর্মে সমকামিতা পাপ। তিনি ছেলেকে আরও ধর্মমুখী হয়ে নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন। এই চাপের মুখে ববি অসহায় হয়ে পড়ে। সদ্য প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে সে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। মেরি দিশাহারা— আত্মহত্যাও যে খ্রিস্টধর্মে মহাপাপ। তা হলে সমকামী ববির আত্মার কী হবে? চার্চের এক রেভারেন্ড ফাদারকে এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ভগবানের চোখে সকলেই সমান। তাঁর দয়া ও ভালবাসায় বৈষম্য নেই।” ভারতীয় সংবিধানের মূল কথাও তো ঠিক তাই। আইনের চোখে সব ভারতীয়ের সমানাধিকার। যখন সমাজে তা নেই, তখন সংসদ ও বিচারব্যবস্থার কর্তব্য তা নিশ্চিত করা। এ বার শীর্ষ আদালত যে সিদ্ধান্ত নিল, তাতে সমানাধিকারের জন্য সমকামী-রূপান্তরকামীদের প্রতীক্ষা আরও দীর্ঘ হল, অনিশ্চিতও। হয়তো যে প্রজন্মের মানুষেরা আবেদন করেছিলেন দেশের বিভিন্ন আদালতে, তাঁদের অনেকেই জীবদ্দশায় বিবাহ, দত্তক, উত্তরাধিকারে বিসমকামীদের সঙ্গে সমানাধিকার দেখে যেতে পারবেন না। এ শুধু ভারতের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বিপন্নতা নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের সামনেই এক মস্ত পরীক্ষা।