—প্রতীকী ছবি।
অতি পরিচিত প্রবাদ সেই কোন যুগ থেকে আমাদের কানে কানে বলে এসেছে রোগ সারাবার চেয়ে আটকানোটাই বেশি দরকারি। সে কথায় আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিই না, কেননা গরুর পালে রোজ বাঘ পড়ে না। দুর্ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার পর আমরা বুক চাপড়াই, বিচার চাই, শাস্তি চাই; কিন্তু তাতে তো ঘটনাটাকে মুছে ফেলা যায় না। তখন আমরা ভাবতে থাকি কী করলে বা না করলে ঘটনাটা হয়তো ঘটত না। এই ‘হয়তো’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এইটুকুই আমাদের হাতে আছে।
বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে নির্যাতিতা হয়ে ফিরল একটি কিশোরী। নির্যাতনকারীরা এতই ক্ষমতাবান যে, মেয়েটিকে চিকিৎসা পর্যন্ত পেতে দেওয়া হল না, পরিণামে মেয়েটি প্রাণ হারাল। এই অপরাধীদের শাস্তি হোক বা না হোক, মেয়েটি তো আর ফিরবে না। ভাবতে চেষ্টা করি মেয়েটি যদি ওই পার্টিতে না যেত, তা হলে হয়তো ঘটনাটা ঘটত না। কিছু না জেনে (বা হয়তো জেনেও) একটি কিশোরী একা পৌঁছে গিয়েছিল ফাঁকা বাড়িতে শুধুমাত্র কয়েকটি ছেলের আড্ডায়, যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সামান্য এবং সমাজমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। এক প্রজন্ম (মোটামুটি দু’দশক) আগে এমন সম্পর্কের কথা ভাবাই যেত না, এখন যে যায় তার ভাল দিকটুকুর সঙ্গে বার বার জড়িয়ে যায় এমন অভিশাপ। নাছোড় প্রেমিকের ছুরির কোপে কিংবা হতাশ প্রেমিকের ছোড়া অ্যাসিডের জ্বালায় ধ্বংস হয়ে যায় জীবনের পর জীবন।
কথাটা আবার মনে পড়ল একটি ওয়েব সিরিজ় দেখতে দেখতে। ইস্কুলের এক জন শিক্ষক কী ভাবে এক-একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ করে তাকে মুগ্ধ করছে, তার বিশ্বাস অর্জন করছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে পরিবারের কাছ থেকে সরিয়ে এনে, তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করছে। তার পর তাকে সায়ানাইড জাতীয় ওষুধ খাইয়ে খুন করে তার টাকা-পয়সা-গয়না সব নিয়ে নিচ্ছে। এই ধারাবাহিক (দহড়) একটি সত্যি ঘটনার উপর তৈরি, যেখানে এই অপরাধী ২০০৩-২০০৯ মাত্র এই ছ’বছরে ২০ জন মেয়েকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করেছে। দেখতে দেখতে হাড় হিম হয়ে আসে, মনে প্রশ্ন আছড়ে পড়ে যে, মেয়েগুলো ফাঁদে পা দিচ্ছে কেন, কাউকে কিছু জানাচ্ছে না কেন? আর তখনই মনে হয়, আমাদের বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে; প্রযুক্তির উৎকর্ষ, সম্পর্কের খোলা হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বিপদের সঙ্কেতকে আমরা উপেক্ষা করছি, আর সেটা খেয়াল হচ্ছে যে দিন যার পালে বাঘ পড়ছে।
সংসারের মধ্যে থেকেও রোজই কিন্তু নানা রকম ভাবে কারও না কারও পালে বাঘ পড়ছেই। অর্থাৎ, ঘরে-বাইরে-রাস্তায়-কর্মস্থলে মেয়েরা নানা রকম ভাবে হিংসা ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, যার অন্তিম পরিণতি মৃত্যু। পণের দাবিতে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে কেউ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছেন, কেউ স্বামী-প্রেমিকের নিরন্তর আঘাত ও বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে না পেরে নিজেই ঝুলে পড়ছেন। প্রশ্নটা হল— কেন? ভালবেসে বিয়ে করেছেন এমন মেয়েরা, এমনকি যে স্বাবলম্বী মেয়েরা তাঁরাও কেন শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে, প্রেমিক বা স্বামীকে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন না?
এর উত্তর পেতে হলে নিজেকে বসাতে হবে তাঁদের জায়গায়। একটি বিবাহিত মেয়ে স্বামীর বাড়িতে অত্যাচারিত হলে কী করতে পারেন? সহজ উত্তর, মা-বাবার কাছে ফিরে আসা। মাত্র কয়েক দিন আগে আলোয়-অলঙ্কারে-চন্দনে সেজে ধুমধাম-সহ পতিগৃহে যাত্রার পর এই ফিরে আসা বড় সহজ হয় না। এর সঙ্গে নিজের এবং পরিবারের যে সামাজিক অসম্মান জড়িয়ে থাকে, সেটার মুখোমুখি হতে মেয়েরা ভয় পান। তাই বাধ্য না হলে প্রাথমিক ভাবে অনেকেই চেষ্টা করেন মানিয়ে নিয়ে থেকে যেতে।
তবে এহ বাহ্য। একটি মেয়ে ফিরে আসতে চাইলে নানা রকমের নতুন গল্প লেখা শুরু হয়, যারা তাঁর ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে রাজি থাকেন না; যে রাজহাঁস সোনার ডিম দেবে বলে আশা আছে, তাকে কে-ই বা হাতছাড়া করে! তাই বার বার মেয়েটিকে মিষ্টি কথা বলে ‘বুঝিয়ে-সুঝিয়ে’ কথা দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। সদ্যবিবাহিত যে মেয়েটি সংসার করতেই গেছেন, তাঁর পক্ষে স্বামীকে বিশ্বাস করে ফেলাটা এই পরিস্থিতিতে প্রায় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত যখন সবাই চাইছেন তিনি ফিরেই যান। দেখা যাবে, মরে যাওয়ার আগে অনেক মেয়েই একাধিক বার এই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে গেছেন। শূন্যস্থান কোথাও অপূর্ণ থাকে না; একটি মেয়েও স্বামীর ঘরে চলে গেলে নিজের বাড়িতে তার জায়গাটা আর ফাঁকা থাকে না। তাই সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, ফিরে আসার পরিস্থিতি হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা-বাবার কাছেও মেয়েটি আর ঠিক আগের জায়গাটা পান না। তাঁরাও সংসারহীন মেয়ের সুদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা ভাবেন, স্বামীর ঘরে তাঁর অদূর ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ততটা ভাবেন না। তাই মেয়েটি ফিরে যেতে রাজি হয়ে গেলে তাঁর বাড়ির লোকও কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
যদি ফিরেও আসেন, বিবাহবিচ্ছিন্না একটি মেয়েকে সমাজ স্বাভাবিক ভাবে নেয় না। মানিয়ে নিতে না পারার দোষ কখনও না কখনও তাঁর উপরে পড়েই, বিশেষত তিনি যদি স্বাবলম্বী না হন। তিনি একা থাকতে চাইলে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তিনি বাড়িতে থাকলে তাঁর অন্য বোন বা ভাইয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ বিনা দোষে একটি মেয়ে তাঁর স্বাভাবিক জীবন ও সামাজিক অবস্থান থেকে ছিটকে পড়েন। ফিরে আসার আগে এ সব সম্ভাবনার কথাও মেয়েদের পিছন থেকে টেনে ধরে বইকি! এক জন বিপত্নীক বা বিবাহবিচ্ছিন্ন পুরুষের তুলনায় একটি বিবাহবিচ্ছিন্না মেয়ের আবার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা এখনও অনেকটাই কম, যদি না তিনি উপার্জনক্ষম হন। তাই গড়পড়তা একটি মেয়ে কেন নানা রকম অত্যাচার সয়েও স্বামীর বাড়িতেই পড়ে থাকেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এর পাশাপাশি ভালবাসা ও সংসারের আকর্ষণ, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস আর একা ও প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার ভীতিও মেয়েদের সংসারে আটকে রাখে। কিংবা সাংঘাতিক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়। অনেক সময়ে কিছু বিষাক্ত সম্পর্কের ধারাবাহিক অত্যাচার ও ভালবাসার দাবি বুদ্ধিমতী ও স্বাবলম্বী মেয়েদেরও এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে ও বিচ্ছিন্ন করে দেয় যে, তাঁরা সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন। এইখানে এসে মনে হয়, আমাদের মেয়েদের চিন্তাভাবনায়, বেড়ে ওঠায় একটা বড়সড় ভুল থেকে যাচ্ছে। একটি মেয়েকে নিরাপদে বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে, বিয়ের পরবর্তী নিরাপত্তা নিয়ে আমরা আদৌ চিন্তিত হচ্ছি না। মেয়েটিকেও মানিয়ে নিতে যত উপদেশ দিচ্ছি, নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষা নিয়ে তার এক অংশও নয়, যদিও সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আইন কিন্তু মেয়েদের অনেকটাই আশ্রয় দেওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে।
সুতরাং, সাবধান হতে হবে নিজেকেই। মনে রাখতে হবে, জীবন একটাই; ভালবাসা, সংসার, মানসম্মান সব কিছু সেই জীবনের জন্য। তাই ভালবাসার মানুষকে বিশ্বাস করার পাশাপাশি কয়েকটি সাবধানবাণীও মাথায় রাখা দরকার। এক, সমাজমাধ্যমের মায়াপাতার পরিচয়কে পুরোপুরি ভরসা করার আগে পরিবার, পড়াশোনা বা কাজের জায়গা বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। দুই, অহেতুক গোপনীয়তা বাদ দিয়ে কিছু বিষয় জানিয়ে রাখতে হবে নিজের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকে। তিন, যে বিষাক্ত সম্পর্ক পরিবার ও অন্য বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, তাকে চিনে নিতে হবে ও প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আর সব কিছুর উপরে, চার, যে কোনও হিংসায় একটুও সঙ্কোচ না করে মানসম্মান নামক বায়বীয় পদার্থটির তোয়াক্কা না করে সোজা আইনের সাহায্য নিতে হবে, তা হলে ‘হয়তো’ ছবিটা আস্তে আস্তে বদলাবে।
পুনশ্চ। এ কথা সত্যি যে, পারিবারিক হিংসায় পুরুষের সঙ্গে প্রায় সমান তালে মেয়েরাও শামিল হন, এবং কখনও পুরুষও সেই হিংসার শিকার হন। তাই মানবাধিকার দিবসে আইন ও অধিকার বুঝে নেওয়ার পাশাপাশি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবার উপদেশ আসলে নারী-পুরুষ সকলের জন্য।