দিল্লির চিড়িয়াখানায় আফ্রিকান হাতি শঙ্কর। ছবি: লেখক।
খুব ছেলেবেলার একটা স্মৃতি এখনও মনকে নাড়া দেয়। তখন আমার বছর দুয়েক বয়স। ইলাহাবাদে থাকতাম। এক মাহুত তাঁর হাতি নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। কাছে যেতেই তো সে আমাকে শুঁড়ে করে ধরে বসিয়ে দিল নিজের মাথায়। উঠিয়ে তো দিল। কিন্তু নামব কী করে! মাহুত তো আর আমাকে নামাতেই চাইছেন না। বকশিশ চাই। শেষমেশ পয়সাকড়ি দিয়ে মাহুতকে সন্তুষ্ট করে আমাকে হাতির মাথা থেকে নামানো হয়। ঘটনাটা এখনও শুধু মনে আছে তাই নয়, হাতি নামক প্রাণীর প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ জাগ্রত রেখেছে।
পরবর্তী কালে বহু জায়গায় হাতি দেখার পাশাপাশি তাদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। মুক্ত-বন্য অবস্থা ও বন্দিদশায় হাতির বিবিধ ব্যবহার, বিচিত্র জীবনপ্রণালীর সঙ্গেও পরিচিত হয়েছি। বর্তমানে পেশাদারি কারণে কাজ করছি জয়পুরের বন্দি হাতিদের নিয়ে। এদের গোটা জীবনটাই কাটে পর্যটক-সওয়ারি নিয়ে। মুক্ত অবস্থায় পলামু, পারান্বিকুলাম এবং কাজিরাঙার হাতিদের পর্যবেক্ষণ করে যতটা আনন্দ পেয়েছি, ততটাই মর্মাহত হয়েছি জয়পুর এবং অন্যান্য জায়গায় বন্দি হাতিদের দেখে।
সাম্প্রতিক সময়ে হাতি নিয়ে কয়েকটা ঘটনা মন নাড়িয়ে দিয়েছে। চলতি বছরের অগস্টে ঝাড়গ্রাম এলাকায় একটি গর্ভবতী হাতিকে জ্বলন্ত বর্শা দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার আলোচনা এবং সমালোচনা হয় দেশ জুড়ে। প্রশ্ন ওঠে তথাকথিত ‘হুলা পার্টি’র হাতি তাড়ানোর ভূমিকা নিয়ে। এই পদ্ধতিতে যে হাতির প্রভূত ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বন্যপ্রাণপ্রেমী সরব হয়েছেন।
বন্য হাতির সঙ্গে মানুষের সংঘাত নতুন কিছু নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে এই ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে, মানুষ ও পশুর সঙ্গে সংঘাতের সময় উভয় পক্ষেরই মঙ্গল যাতে হয় সেই রকম এক সমাধানের প্রচেষ্টা করা। নইলে যে হাতির সঙ্গে মানুষের সংঘাত হচ্ছে, তাকে ‘পাগলা হাতি’ ঘোষণা করে মেরে ফেলা তো অনেক বারই হয়েছে!
হাতির সঙ্গে মানুষের সংঘাতের বিষয়টি কোনও জাদুদণ্ডে সমাধান করা যাবে, এমনটা আমার মনে হয় না। আমাদের দেশে বন্যপ্রাণীর পারিপার্শ্বিকে থাকা মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি যেমন অসহিষ্ণুতা আছে, তেমন আছে সহমর্মিতাও। যদি তা না হত, ভারতের মতো জনবহুল দেশে এই সংখ্যায় হাতি, বাঘ, সিংহ, গন্ডার ও অন্যান্য প্রাণী পাওয়া যেত না। ঝাড়গ্রামের ঘটনার শুধু প্রতিবাদ করলেই হবে না, স্থানীয় মানুষ ও বন দফতরের সহযোগিতায় গুরুতর এই বিষয়টি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বন্যপ্রাণপ্রেমীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যদি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না বেরোয়, তা হলে পর্যাপ্ত আইনি সাহায্য প্রয়োজন।
মানুষের সঙ্গে হাতি বা অন্যান্য প্রাণীর সংঘাত হলেই ইদানীং দেখি সমাজমাধ্যমে একতরফা খুবই তর্কবিতর্ক হয়। এক দল পশুপ্রেমী আছেন, যাঁদের মতে মানুষ মানেই ‘রাক্ষস’ আর সকল পশুই ‘দেবতুল্য’। অন্য একটা দল মনে করেন, পশুপাখির অধিকার বলে কিছুই হয় না। সবার উপরে মানুষ সত্য! এই দুই দলের বাদানুবাদে আসল সমস্যার সমাধান বা পশুপাখি ও মানুষ— উভয় পক্ষের কল্যাণের পন্থা বার করার প্রচেষ্টাটা লঘু হয়ে যায়।
বিদেশি এক অতিথির সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। তার নাম শঙ্কর। আঠাশ বছরের এক আফ্রিকান হাতি। ১৯৯৮ সালে জিম্বাবোয়ে সরকারের তরফে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মাকে দেওয়া উপহার হিসেবে বছর দুয়েকের শঙ্কর ও তার সঙ্গী ভাম্বাই দিল্লির চিড়িয়াখানায় আসে। দু’জনকেই জঙ্গল থেকে ধরা হয়েছিল। তার বছর দুয়েক পর, অর্থাৎ ২০০০ সালে গবেষণার কারণে আমি দিল্লি চিড়িয়াখানায় গিয়ে শঙ্কর-ভাম্বাইকে পর্যবেক্ষণ করি নিবিড় ভাবে। প্রচুর ছবিও তুলেছিলাম। ২৪ বছর আগের অভিজ্ঞতায় প্রথমেই মনে হয়েছিল, কোথাকার বন্যপ্রাণ কোথায় কী ভাবে আছে! জিম্বাবোয়ের জঙ্গলে মুক্ত পরিবেশে জন্ম নেওয়া প্রাণী মাত্র দু’বছর বয়সে মা-পরিবার ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে এক কারাগারে বন্দি!
মানুষের মতো হাতির শৈশবও পরিবারের সঙ্গে কাটে। যেখানে মা ও অন্য বয়স্ক হাতিরা বাচ্চাদের আগলে রাখে। জীবনের বিভিন্ন কার্যকলাপ তাদের শেখায়। মানুষের মতো হাতিরও সমাজ আছে। আছে সমাজবন্ধনও। সেখানে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আফ্রিকার বহু দেশে এই পারিবারিক বন্ধন নির্মম ভাবে ভেঙেছে। মা-হাতি ও তার প্রাপ্তবয়স্ক সঙ্গীদের গুলি করে মেরে বাচ্চাদের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় রফতানি করা হয়েছে। শঙ্কর-ভাম্বাইয়ের দুর্গতিপূর্ণ জীবনের সূত্রও এটা। ফলে শৈশবের একটা বড় ক্ষত তাদের সারা জীবন ধরে নিয়ে চলতে হয়।
২০০১ সালে ভাম্বাই মারা যায়। কারণ, নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে না-নিতে পারা। তার পর থেকে শঙ্কর একা। নিজের স্বাভাবিক বন্য জীবন থেকে অনেকটা দূরে তার যাপন। ২০০১ থেকে এখনও পর্যন্ত শঙ্করকে আমি বহু বার পর্যবেক্ষণ করেছি। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ২০১৬ সালে তাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা ও ছবি তোলার সুযোগও পেয়েছি। তার জীবনের অনেক অধ্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শীও থেকেছি। দেখেছি, শঙ্করের মাহুত তাকে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারছেন। কারণ, সে সব সময় মাহুতের আজ্ঞাবাহী হয়েছে, এমনটা নয়। দেখেছি, সারা দিন শিকলবাঁধা অবস্থায় শঙ্করের বিরামহীন দুলুনি। যা আসলে মানসিক ব্যাধির লক্ষণ। তবে এ সবই চিড়িয়াখানায় দর্শকের কাছে আমোদের খোরাক।
শঙ্করকে এক বার ‘পূর্বাশ্রমে’ পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই উদ্যোগে আমিও ছিলাম। এক দল বন্দি আফ্রিকান হাতিকে ইংল্যান্ড থেকে কেনিয়ায় ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ‘এসপিনাল ফাউন্ডেশন’। বিশ্বে প্রথম। তারাই বন্দি অবস্থা থেকে শঙ্করকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। বন্দি পশুকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে ইংল্যান্ডের ওই সংস্থা অগ্রণী। শঙ্করকে নিয়ে একটি আইনি মামলায় দিল্লি হাই কোর্টকে বিষয়টি জানানো হয়। আবেদন জানানো হয়, শঙ্করকে দিল্লি চিড়িয়াখানা থেকে মুক্ত করা হোক। কিন্তু হাই কোর্ট সেই আবেদন নাকচ করে দেয়!
শঙ্কর এখনও বন্দি। এখনও একা। দীর্ঘ কাল তাকে শিকল দিয়ে আটকে রাখার জন্য দিল্লি চিড়িয়াখানাকে ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড করেছে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ জুস অ্যান্ড অ্যাকুয়ারিয়ামস’। কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিংহ নিজে দিল্লি চিড়িয়াখানায় গিয়ে শঙ্করের দেখভালের খোঁজ নিয়েছেন। তার শিকল খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তাতে শঙ্করের একাকিত্ব ঘোচেনি।
ভারতের চারটি চিড়িয়াখানায় আফ্রিকান হাতি ছিল। আশির দশকে গুয়াহাটি চিড়িয়াখানায় ছিল লক্ষ্মীপ্রসাদ এবং রূপা। মাইসুরু চিড়িয়াখানায় ছিল টিম্বো ও জাম্বি। এরা দু’জনেই মৃত। কিন্তু তাদের সন্তান র্যাম্বো এখনও জীবিত। জামনগরের চিড়িয়াখানায় কয়েকটি আফ্রিকান হাতি আছে। দিল্লির চিড়িয়াখানার শঙ্করের একাকিত্ব ঘোচাতে তাকে মাইসুরুর র্যাম্বো বা জামনগরের আফ্রিকান হাতিদের সঙ্গে মেলানো যায় কি না, তা ভাবার সময় এসেছে। ভাবার কথা বলছি, কারণ দিল্লি চিড়িয়াখানা জিম্বাবোয়ে বা বৎসোয়ানা থেকে অন্য একটি আফ্রিকান হাতি এনে শঙ্করের একাকিত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছে। ২৬ বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভারতে আনার পরে শঙ্কর-ভাম্বাইয়ের যে দুর্দশা হয়েছিল, নতুন একটা হাতিকে আফ্রিকা থেকে আনার পর সেই একই অবস্থা হবে না তো!
শঙ্করের এই করুণ পরিণতি আমাকে চিড়িয়াখানা বিষয়টা নিয়েই ভাবায়। কলকাতা চিড়িয়াখানার রামব্রহ্ম সান্যাল বা ইংল্যান্ডের জেরাল্ড ডারেল, জন এসপিনালেরা বন্দি অবস্থায় প্রাণীরক্ষা ও প্রজনন করিয়ে পথিকৃৎ। আজও তাঁদের কাজ থেকে বন্দিপ্রাণীর পরিচর্যার বিষয়ে অনেক কিছু শেখার আছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে আলিপুর চিড়িয়াখানার ১০০ বছর উপলক্ষে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘‘চিড়িয়াখানায় প্রাণী যত ভাল ভাবেই রাখা হোক না কেন, এটা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন আছে যে, বনের প্রাণী বন্দি থাকবে কেন?’’ প্রশ্নটা আমাকে এখনও নাড়িয়ে দেয়। দিল্লি চিড়িয়াখানার প্রাক্তন অধিকর্তা এবং ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রথম কর্ণধার কৈলাস সংখলা লিখেছিলেন, ‘‘চিড়িয়াখানার আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, সেটা ভাল করে অনুধাবন করতে হবে।’’ এ সব বিষয় আজও প্রাসঙ্গিক।
দক্ষিণ দিল্লির এক মন্দিরের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি অসম থেকে একটি হাতি আনার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি নিয়ে চারদিকে আলোচনাও হচ্ছে। হাই কোর্টের নির্দেশে বেসরকারি মালিকানায় থাকা দিল্লির শেষ সাতটি হাতিকে অন্যত্র পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে আগেই। বেসরকারি মালিকানায় থাকা শেষ হাতির নাম ছিল লক্ষ্মী। তার মালিক ইউসুফ আলির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। তার কিছু দিন পরেই লক্ষ্মী পুনর্বাসিত হয় অন্যত্র। তাই আবার দিল্লিতে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানায় হাতি আনার সম্ভাবনায় আমার মতো অনেকেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন। বিষয়টি নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়ে আবেদন জানিয়েছে, অসম থেকে যেন দিল্লিতে হাতি আনা না হয়।
আগেই বলেছি, হাতি যূথবদ্ধ প্রাণী। তাকে জোর করে, বন্দি অবস্থায় একা রাখলেই তার শারীরিক ও ব্যবহারিক বিচ্যুতি ঘটে। মন্দির বা যে কোনও জায়গায় হাতিকে পুজো বা শ্রদ্ধা করার চিন্তা ইতিবাচক পদক্ষেপ। বিশেষত, হাতি যখন জাতীয় হেরিটেজ পশু। কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, বন্যপ্রাণীর বনে থাকাটাই শ্রেয়। মন্দিরে আবদ্ধ অবস্থায় নয়। কেরল, তামিলনাডু এবং অন্য কিছু জায়গায় যেখানে মন্দিরে হাতি আবদ্ধ থাকে, তাদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। জয়পুরের হাতি ‘ক্রীতদাস’ হিসাবে মানুষের আজ্ঞাবাহী হয়ে পর্যটকদের মনোরঞ্জন করছে। একটি বনের প্রাণী, যে কিনা মুক্ত অবস্থায় দিনে ২০ কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটে, নদী সাঁতরে বেড়ায়, অন্যের সঙ্গে খেলা করে, সেই প্রাণী আজ ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছে! তার দাঁতের জন্য শিকারিরা তাকে হত্যা করছে। বন্দি অবস্থায় সে মানুষের হাসির খোরাক বা তথাকথিত উপাসনার বস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে শিকলবদ্ধ অবস্থায়, যেখানে তার নড়াচড়া করার জায়গা খুবই সীমিত!
ভারতে হাজার হাজার বছর ধরে হাতি নিয়ে অনেক শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। চাণক্য হাতি নিয়ে দু’হাজার বছর আগে লিখেছেন তাঁর অর্থশাস্ত্রতে। সর্বোপরি আছেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। তিনি মঙ্গল ও সমৃদ্ধির প্রতীক। মূর্তির সঙ্গে শ্রদ্ধা থাকুক জীবন্ত গণেশের উপরেও। যাতে শঙ্করের মতো হাতিদের আর যন্ত্রণা ভোগ করতে না হয়।
(লেখক ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর ওয়াইল্ড লাইফ ক্যাম্পেন ম্যানেজার। মতামত নিজস্ব)