দেশভেদে মজার মজার মন্ত্রক তৈরি হতে দেখেছি আমরা আগেও। জাপানে তৈরি হয়েছিল ‘একাকিত্ব মন্ত্রক’। আর এই মুহূর্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে অনুগত চিড়েতনের বিবি আর ইস্কাবনের গোলামদের দিয়ে আমেরিকার প্রশাসনের ‘হাউস অব কার্ডস’ সাজাতে ব্যস্ত ট্রাম্প ভেবেছেন এক নতুন মন্ত্রকের কথা। রবার্ট কেনেডি জুনিয়রকে বসিয়ে দিলেন স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষে, গোয়েন্দা দফতরের চাবি তুলে দিলেন তুলসী গ্যাবার্টের হাতে। আর সরকারি দক্ষতা বৃদ্ধির নতুন মন্ত্রক খুলে তার দায়িত্ব দিলেন দুনিয়ার ধনীতম মানুষ ইলন মাস্ক আর ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান বায়োটেক-উদ্যোগপতি বিবেক রামস্বামীর হাতে। মাস্ক-রামস্বামীকে কোনও ভাবে অবশ্য পুরস্কৃত করতেই হত ট্রাম্পকে। এ বারের ভোটে মাস্কই ছিলেন ট্রাম্প শিবিরের প্রধান কান্ডারি। কয়েকশো মিলিয়ন ডলার তিনি জুগিয়েছেন ট্রাম্পের প্রচারে। রিপাবলিকান প্রাইমারিতে প্রার্থিপদে অভিযান গুটিয়ে ফেলে ট্রাম্পকে সমর্থন করেন রামস্বামী।
তবু, ট্রাম্প-প্রবর্তিত নতুন ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’, আদ্যক্ষর নিয়ে যার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ডজ’, সে কি শুধুমাত্র আনুগত্যেরই পুরস্কার? আপাতভাবে এর উদ্দেশ্য কেন্দ্রীয় ব্যুরোক্র্যাসি মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ কমানো। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক বিষয়সমূহ এবং কর্মক্ষমতার পূর্ণ নিরীক্ষণের মাধ্যমে কঠোর সংস্কারের সুপারিশ করবে সংস্থাটি, এমনটাই চাইছেন ট্রাম্প।
ব্যুরোক্র্যাসির লাল ফিতের ফাঁসে হাঁসফাঁস করে দুনিয়া। তা আলগা করার সরকারি প্রচেষ্টার কথা শুনতে বেশ। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এক আদ্যন্ত ব্যবসায়ী হয়েও এর প্রবক্তা। আর এর মাথায় দুনিয়ার ধনীতম মানুষটি, ব্যবসার চৌহদ্দিতে যাঁর নির্মমতা সুবিদিত। ‘ডজ’কে ‘কালটিভেট’ করতে তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুনিয়ার লালমোহনবাবুরা।
অতিধনীরা রাজনীতিতে কমবেশি নাক গলান বইকি। তবে প্রধানত পর্দার আড়ালে থেকেই। মিডিয়াকে প্রভাবিত করে, ভোট-প্রচারে টাকা জুগিয়ে, রাজনীতিকদের সঙ্গে সামাজিক সংযোগ করে। আমেরিকাতে জন রকাফেলার কিংবা বিল গেটসের মতো শীর্ষ-ধনীরা কখনও আসেননি প্রত্যক্ষ রাজনীতির বৃত্তে।
‘ডজ’-এর আইডিয়াটার সূত্রপাত অগস্টের ২৪ তারিখ। ট্রাম্প ভোটে জিতে মাস্ককে চান পরামর্শদাতা হিসাবে। উত্তরে মাস্ক সম্মতিসূচক পোস্ট করেন তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে; সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত তাঁর একটি ছবি, যেখানে লেখা ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’। এমনিতে জিডিপি-র শতাংশের অনুপাতে আমেরিকার খরচ ফ্রান্স, জার্মানি বা ব্রিটেনের তুলনায় বেশ কম, মাত্র ৩৭.৫%। মাস্ক মনে করছেন, ‘ডজ’ আমেরিকার কেন্দ্রীয় বাজেটকে কমিয়ে দিতে পারে আরও ২ ট্রিলিয়ন ডলার, মোটামুটি ৩০%। আইডিয়াটা ট্রাম্পের মনে ধরেছে নিশ্চয়ই।
সরকারি দক্ষতা বাড়ানো— কী ভাবে? ইলন মাস্কের কাজকর্ম একটু দেখা যাক। ২০২২-এ টুইটার অধিগ্রহণ করে তিনি ছাঁটাই করেন ৬৫০০ কর্মীকে, ফলে কোম্পানিটির নাকি অবমূল্যায়ন হয় ৮০%। সরে যায় অর্ধেক বিজ্ঞাপনদাতাই। কর্মীদের সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টা কাজ করতে বলেন মাস্ক, বিনা পয়সায় খাবার কিংবা কোভিড-কালের ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মতো সুবিধা উঠিয়ে দেন। মাস্কের টুইটার পরিচালনা দেখে দ্য গার্ডিয়ান কাগজের কলামিস্ট আরওয়া মাহদয়ি লিখেছিলেন, যেন একটি বাচ্চার ট্রেন চালানোর চেষ্টা। প্রশ্ন উঠবে, পাবলিক সেক্টরে কি এ সব আদৌ অভিপ্রেত? এমনকি চরম ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যেও?
ক্রিপ্টোসম্পদ, বিশেষত ‘ডজকয়েন’ নামক ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ইলন মাস্কের আগ্রহ সুবিদিত। নতুন মন্ত্রকের সুচিন্তিত সংক্ষেপিত রূপ ‘ডজ’ কি ঊর্ধ্বমুখী করবে ডজকয়েনের জনপ্রিয়তা? সরকারি নীতি নির্ধারণের কাজে মাস্কের উপস্থিতি কি ঘটাতে পারে স্বার্থের সংঘাত? ট্রাম্প দাবি করেছেন, বাণিজ্য সংগঠকের স্টাইলে সরকার পরিচালনার এমন ধারা নাকি দেখেনি দুনিয়া, যা বদলে দেবে সরকার চালানোর প্রচলিত ধারণাকে। এটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই ‘এফিশিয়েন্সি অফিস’ রয়েছে হংকং-এ। আমেরিকাতেও ‘ডজ’-এর এক পূর্বসূরি ছিল ট্রাম্পের প্রথম বারের প্রেসিডেন্সির সময়। ‘অফিস অব আমেরিকান ইনোভেশন’। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির ছাঁচে আমেরিকান সরকারকে বদলে দেওয়ার অভীপ্সা ছিল সে ক্ষেত্রেও। ছিল অর্থনীতিকে সঞ্জীবিত করার আর সরকারকে আধুনিক করার ঘোষিত লক্ষ্য। ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনারের নেতৃত্বে সেখানে আনা হয়েছিল জেফ বেজোস আর টিম কুক-কে।
‘ডজ’ নিয়ে আলোচনায় মাইকেল লুইসের বই দি ফিফথ রিস্ক-এর প্রসঙ্গ উঠবেই। ট্রাম্পের প্রথম বারের প্রেসিডেন্সিতে রাজনৈতিক নিয়োগের প্রভাব নিয়েই বইটি। মাস্ক অবশ্য বলেছেন, ‘ডজ’ গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি নয়, হুমকি ব্যুরোক্র্যাসির উপর। রামস্বামী বলেছেন, ‘উই উইল নট গো জেন্টলি’। ইঙ্গিতটা সম্ভবত ডিলন টমাসের কবিতার দিকে নয়, বরং ইনডিপেন্ডেন্স ডে সিনেমার দিকে, যেখানে এই কথা বলে প্রেসিডেন্ট টমাস হুইটমোর বক্তৃতা দিচ্ছেন ফাইটার পাইলটদের উদ্দেশে।
বহু-আলোচিত ‘ডজ’ কতটা সফল হবে সেটা বলবে সময়। ধরা যাক, ‘ডজ’ ট্রাম্প২.০ সরকারের খরচ কমিয়ে দিল অনেকটা। তা হলে কি এ গ্রহের বিভিন্ন দেশে উদ্যোগপতিদের দিয়েই তৈরি হবে এমন মন্ত্রক? হয়তো তা নয়। হয়তো দীর্ঘমেয়াদি নয়, স্বল্পমেয়াদি লাভের দিকেই নজর, যেমন লুইস লিখেছেন। স্বল্পমেয়াদি লাভকে পাখির চোখ করে বেড়ে উঠবে স্পর্ধিত ধনতন্ত্র, তৈরি হবে ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম-এর নতুন অবয়ব।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা