প্রযুক্তিতে যাঁরা বাদ পড়ছেন

সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে প্রযুক্তিগত কারণে যদি কেউ গোলমালে পড়েন, এবং পরিষেবা না পান, তবে তিনি কোথায় যাবেন?

Advertisement
সুমন সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০৩

নমিতা হালদার কলকাতা শহরতলির দক্ষিণ প্রান্তের বাসিন্দা। লোকের বাড়ি ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ করেন। গত লকডাউনে যত কাজ ছিল, এখন তা-ও নেই। কোভিড-কালের আগে রোজ সকাল ৮টায় যাদবপুর স্টেশনে নামতেন নমিতা, তার পর ছ’বাড়ি কাজ করে, শেষ বাড়িতে দু’মুঠো খেয়ে, সামান্য স্নান সেরে সাড়ে ৩টের ক্যানিং লোকালের জন্য দৌড়। কিন্তু দেড় বছরে তিন বাড়ির কাজ চলে গিয়েছে। দিদি-বৌদিরা বলেছেন, আসতে হবে না। প্রথম কয়েক মাস পুরো মাইনে পাওয়া গিয়েছিল, যখন নমিতার বর সাইকেলে করে এসে বলতেন, আর চলছে না। কিন্তু চার মাসের পর থেকে তারাও আর পারবে না বলে দিয়েছে। কিন্তু যে তিন বাড়িতে ঝামেলা ছিল না, ইদানীং তারাও বলতে শুরু করেছে, ভ্যাকসিন না নিলে কাজে আসা যাবে না। কিন্তু নমিতা নেবেন কী করে? ওঁর তো স্মার্টফোন নেই। তাই তিনি অপেক্ষা করছেন, কখন এলাকার পঞ্চায়েতের তরফে টিকার শিবির হবে। ট্রেনে গৌরীদি বলেছেন, “তোমাকে আমার স্মার্টফোনে রেজিস্ট্রেশন করে দেব, তুমি ভ্যাকসিন নিয়ে সার্টিফিকেটও পেয়ে যাবে।” নমিতা যদিও তাতে রাজি নয়, কারণ তাতে যদি কেউ ভাবে তিনি শংসাপত্র জাল করেছেন? ‘কোউইন’-এর কথা শুনেও তিনি আশ্বস্ত নন। নমিতা আসলে অনেক নাগরিকের মতোই এক জন, যিনি এই ডিজিটাল ভারতে বাদ পড়ার আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

সরকারি প্রযুক্তি নমিতাদের রোজই ঘিরছে। রেশন, টিকা, লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, গ্যাসের ভর্তুকি, কৃষি যোজনা— রাষ্ট্র ক্রমশ আরও বেশি মানুষকে প্রযুক্তির বশবর্তী করতে চাইছে, আর ফলাফল হিসাবে বাদ পড়ে যাচ্ছেন আরও প্রচুর মানুষ, যাঁদের কথা হয়তো শোনাও যাচ্ছে না। প্রচারের তোড় এত বেশি যে, ঝাড়খণ্ডের সন্তোষী, বা বালুরঘাটের মামণির কথা খবরের কাগজের কোনাতেও ঠাঁই পাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। আসলে, যে কোনও প্রযুক্তিই শহুরে, উচ্চবিত্ত, পুরুষকে মাথায় রেখে ভাবা হয়, যিনি কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে সড়গড়। এই বিষয়ক নিয়মকানুনের ক্ষেত্রেও দেখব যে, ‘যুক্তিপূর্ণ পুরুষ’ কী ভাবে ভাবছেন, সেটাই মাপকাঠি।

Advertisement

কিন্তু ভারতের বেশির ভাগ মানুষই এখনও প্রযুক্তির সঙ্গে তো দূরস্থান, তার শব্দগুলোর সঙ্গেই পরিচিত নন। বিশেষত মেয়েরা। ভারতে মেয়েদের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২১ শতাংশ, পুরুষেরা দ্বিগুণ। নানা সমীক্ষা বলে, মেয়েরা এখনও প্রযুক্তির তুলনায় মানুষের উপর বেশি নির্ভরশীল। এর কারণটি সামাজিক। গ্রামীণ ভারতে— যেখানে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের বাস— মাত্র এক-চতুর্থাংশের হাতে ইন্টারনেট আছে। ফলে ডিজিটাল জগতের সঙ্গে বাস্তবের দূরত্ব বাড়ছে।

করণীয় কী? প্রযুক্তিকে বয়কট করা? এক সময়ে যেমন কম্পিউটার ঢুকতে না দেওয়ার আন্দোলন হয়েছিল, তেমন করা? না কি ডিজিটাল প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তাকে গণমুখী করে তোলার কথা বলা? সেখানে লিঙ্গ-বয়স নিরপেক্ষ ভাবেই প্রত্যেক ব্যবহারকারী ও নাগরিক প্রযুক্তির সুযোগ পাবেন; দাবিদাওয়া জানাতে পারবেন, তা নিয়ে কথা বলতে পারবেন। প্রশ্ন হল, তা হলে প্রযুক্তিকে দেখার দৃষ্টি কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়?

প্রথমত, যে কোনও প্রযুক্তিগত উপায় যেন সব রকম ব্যবহারকারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে বানানো হয়। আগে বানানো আর তার পর বলা যে, এ ছাড়া গতি নেই, এটা বৈজ্ঞানিক পন্থা হতে পারে না। মানুষ কী ভাবে প্রযুক্তিকে নিতে পারছেন, তা দেখেই সরকারি ভাবে তা চালু করা উচিত। দ্বিতীয়ত, যাঁরা প্রযুক্তি বিষয়ে স্বচ্ছন্দ নন, তাঁদের কাছে অন্য মানুষের সূত্রেই পৌঁছতে হবে, যাতে তাঁরা রক্তমাংসের মানুষের উপর ভরসা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এলাকার জনপ্রিয় ব্যক্তিদের সামনে আনা যায়। তাঁরা যদি প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ করে বোঝাতে পারেন, তা হলে এই মানুষদের পক্ষে প্রযুক্তি ব্যবহারের আত্মবিশ্বাস কিছুটা তৈরি হয়। মহিলা ও বৃদ্ধদের প্রযুক্তি বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধা, সেই সঙ্কট এ ভাবে কিছুটা সমাধান হতে পারে। তৃতীয়ত, সরকারি স্তরে যাঁরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার কাজ করছেন, তাঁদের আরও বেশি করে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সংযোগ করা জরুরি। তাতে তাঁরাও বুঝতে পারবেন শেষতম মানুষটি কী ভাবছেন।

এ দেশে প্রযুক্তির সাধারণ ব্যবহারকারীর মন নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। আবার, কারও অসুবিধা হলে তিনি কার কাছে অভিযোগ করবেন, সে উত্তরও তাঁর কাছে থাকা দরকার। না হলে নমিতার মতো মানুষেরা আধার সংযুক্তিকরণ বা বায়োমেট্রিকের মতো পদ্ধতির কারণে টিকাকরণ, রেশন সরকারি অর্থ-সহায়তা প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হতে থাকবেন। সহজ কথা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে প্রযুক্তিগত কারণে যদি কেউ গোলমালে পড়েন, এবং পরিষেবা না পান, তবে তিনি কোথায় যাবেন? এই সমাধান ভাবার দায়িত্ব ব্যবহারকারীর নয়। দায়িত্বটা তাঁদেরই, যাঁরা এই প্রযুক্তি-ব্যবস্থা চালাচ্ছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement