গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
এই কাচের টুকরাগুলো কেন নিচ্ছ?
ট্রাউজ়ার্সের পকেট থেকে প্লাস্টিকের পুঁচকে প্যাকেট বার করে স্ফটিকের মতো টুকরোগুলো ভরতে ভরতে একগাল হাসে কিশোর। ঝকঝকে দাঁতের পাটি দেখা যায়। কিশোর বলে, ‘‘স্মৃতি হিসাবে। স্বৈরাচারের পতন অইসে। নিব না?’’
এর আগে যখন আসছেন, কোনও আপ্যায়ন টের পাইসেন?
ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আধখানা কেঠো মালা থেকে দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে নারকেল খাচ্ছিলেন যুবক। একগাল হেসে বললেন, ‘‘পাই নাই। তখন তো পয়সা দিয়া ঢুকতে অইসিল। অহন তাই নিজ়েই নিজ়েরে আপ্যায়ন করতাসি। আপনারা কেউ খাবেন?’’ পাশে দাড়়িয়ে দু’হাতে ঝুনো নারকেল কানের পাশে নাড়াতে নাড়াতে তাঁর সঙ্গী যুবক বলছিলেন, ‘‘ভিতরে পানি আসে (আছে)। অনেক পানি আসে। শব্দ অইতাসে।’’
শব্দ অবশ্য চারদিকে। শব্দ ইতিহাস ভাঙচুরের। শব্দ জাতির পিতার বাসভবন গুঁড়িয়ে যাওয়ার। শব্দ লাউডস্পিকারের। শব্দ অবিরত স্লোগানের। শব্দ এক অপার্থিব উল্লাসের। শব্দ শাবল-হাতুড়ি-গাঁইতির নির্বিচার আঘাতের। শব্দ বুলডোজ়ারের।
শব্দ? না কি গর্জন?
গর্জন! গর্জন মৌলবাদের। গর্জন স্বেচ্ছাচারিতার। গর্জন ইতিহাসকে বুলডোজ়ারের তলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া উন্মত্ত জনতার।
ভিড়ের মধ্যে বিশেষ ভাবে চোখে পড়ল স্পাইডারম্যানের পোশাক-পরা একটা চেহারা। ধানমন্ডিতে বুধবার। ছবি: এএফপি।
কাতার দেওয়া সেই জনতা মনের সুখে ভাঙছে শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি। ভাঙছে, আগুন ধরাচ্ছে, লুট করছে আসবাব। বাড়ির পিছনে যত্নে তৈরি সংগ্রহশালা থেকে নিয়ে যাচ্ছে মনের মতো ‘স্মৃতিচিহ্ন’। বাড়ির ভাঙা দেওয়ালের খোঁদল দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভিতরে কিলবিল করছে বিভিন্ন বয়সের লোকজন। তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে-নামছে। ভাঙা বারান্দায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির চৌহদ্দিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে শাবলের ঘায়ে নুয়ে-পড়া নারকেল গাছগাছালির পাশে। ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছে ভাঙা দরজার ফ্রেম। বয়ে নিয়ে গিয়ে তুলছে সামনে দাঁড়ানো রংবাহারি সাইকেল রিকশায়। কেউ নিয়ে যাচ্ছেন ফাইলপত্র আর বই। সবই ওই, ‘স্মৃতি’। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্রসুলভ দেখতে এক তরুণ সগর্বে বলছেন, ‘‘এই বই নিয়ে যাচ্ছি স্মৃতি হিসেবে। আর নারকেল নিয়ে যাচ্ছি খাব বলে। মুজিব তো শিখিয়েছিলেন নিজের খাবার নিজেকে জোগাড় করে নিতে হবে। তা-ই তো করছি।’’
কোথাও কোনও উর্দিধারীর নামগন্ধ নেই। না সেনা। না পুলিশ। কোথাও কোনও তদারকি সরকার বা তার নোবেলজয়ী প্রধানের দেখা নেই। যথেচ্ছাচার চলছে ঢাকা শহরের অন্যতম অভিজাত একটি এলাকায়। আইনের শাসন পিঠটান দিয়েছে খিড়কির দরজা দিয়ে।
অভূতপূর্ব জনরোষের মুখে গত ৫ অগস্ট দেশ ছেড়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি অনলাইনে ভাষণ দেবেন শুনে ৩২, ধানমন্ডির বাড়িতে আছড়ে পড়ল জনরোষ। মাত্র ছ’মাসের ব্যবধান। ধানমন্ডির বাড়ির সঙ্গে ভাঙচুর হল হাসিনার বাসভবন সুধা সদনও। দ্রুত সেই তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশ জুড়ে। যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসস্থান, সমস্ত ভাঙচুর শুরু হল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ভাঙা হতে লাগল মুজিবের ম্যুরাল। স্রেফ হাসিনা অনলাইনে ভাষণ দেবেন শুনেই। চমৎকার উপমা দিচ্ছিল ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর অনুজপ্রতিম সাংবাদিক (এবং বাংলাদেশের হকিকত সম্পর্কে দীর্ঘ দিন ধরে সম্যক অবহিত) দেবদীপ পুরোহিত, ‘‘বোলার বলই করেনি! শুধু বলেছে, বল করবে। কিন্তু উইকেটে বল পড়ার আগেই ব্যাটার ব্যাট ঘোরাতে শুরু করে দিল!’’
জ্বলছে মুজিবের বাড়ি। চলছে ভাঙচুর, লুটপাট। বারান্দার পাঁচিলে লিখে দেওয়া হয়েছে, ‘থাকবে না ৩২’। বুধবার ধানমন্ডিতে। ছবি: রয়টার্স।
হাসিনা স্বৈরাচারী ছিলেন। ঠিক। হাসিনা একের পর এক নির্বাচনে প্রবল কারচুপি করে জিতেছেন (সেই রসিকতা এখনও মুখে মুখে ঘোরে: নির্বাচনের পরে মাত্র তিনটি ভোট-পাওয়া বিরোধী বিএনপি-র হেরো প্রার্থীর স্ত্রী ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছেন। স্বামী রাগের কারণ জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘‘একডা ভোট তো তুমি নিজ়েরে দিসো। একডা ভোট দিসি আমি। তিন নম্বর ভোটটা দিল কেডা!’’ অর্থাৎ, তৃতীয় ভোটটা নিশ্চয়ই তাঁর কোনও গোপন প্রেমিকা দিয়েছেন। সেই জন্যই বাপের বাড়ি যাত্রা)। ঠিক। হাসিনার আমলে বাংলাদেশ যে দুর্নীতি দেখেছে, সহ্য করেছে, তার তুলনা পাওয়া কঠিন। এ-ও ঠিক। হাসিনার দল আওয়ামী লীগের নেতারা তো বটেই, তাঁর পিয়নও যে পরিমাণ টাকা করেছিলেন, তাক লাগানোর মতো!
বস্তুত, হাসিনার যে পরিণতি হল, তার জন্য সবচেয়ে দায়ী তিনি নিজে। দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ রাখতে পারেননি (বিরোধীরা বলেন, চাননি) তিনি। বিরোধীদের শায়েস্তা করতে বিভিন্ন প্যাঁচ-পয়জার কষেছেন। নইলে তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রতিস্পর্ধার জন্ম হত না।
সবই ঠিক। হাসিনা এবং তাঁর শাসনাধীন আওয়ামী লীগের তামাম নেতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ-ক্রোধ-বিদ্রোহ সমস্ত ঠিক। কিন্তু তার এই বহিঃপ্রকাশ? যে বাড়ি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল, সেই বাড়ি একটা গোটা রাত এবং দিন ধরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হতে থাকল? হতেই থাকল? যত ক্ষণ না তার সমস্ত চিহ্ন মাটিতে মিশে যায়! সেটা কি হাসিনার প্রতি ক্রোধ? না কি স্বাধীন বাংলাদেশের অভিজ্ঞানকেই লোপাট করে দেওয়ার চেষ্টা? ৩২ নম্বর ধানমন্ডি তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহ। আঁতুড়ঘর।
এই বাড়ির ঠিকানা দিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা মেয়েদের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। ঠিকানা দাও ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর।’’ দাউ দাউ জ্বলতে-থাকা সেই বাড়ির ধ্বংসস্তূপের বারান্দার গায়ে কালো রঙে লিখে দেওয়া হল— ‘থাকবে না ৩২’।
থাকবে না? ঠিকই, রইলও না!
উন্মত্ত জনতা যখন গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি, মনে পড়ছিল, এই বাড়িটা ছিল একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম এবং অন্ধকারতম মুহূর্তের সাক্ষী। উজ্জ্বলতম, কারণ সত্তরের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ৩২, ধানমন্ডি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ সঞ্জাত উচ্চাকাঙ্ক্ষার গর্ভগৃহ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এই বাড়ি থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন মুজিব। এই বাড়ির একতলার ড্রয়িংরুমে তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেছেন রাষ্ট্রনায়কেরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই চালিত এবং পরিচালিত হয়েছে এই ঠিকানা থেকে। অন্ধকারতম, কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট এই বাড়িতে হত্যা করা হয়েছিল সপরিবার মুজিবকে। সেই দিন থেকে এই বাড়ি পরিচিত মুজিব এবং তাঁর পরিবারের গণহত্যার ‘শহিদবেদি’ হিসাবে।
ষাটের দশকে এই বাড়িতেই মুজিবের জন্য প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছিল পাকিস্তানের পুলিশ। সেই শুরু। তার পরে একের পর এক গ্রেফতারি পরোয়ানা এসেছে মুজিবের নামে। এই বাড়িতেই। ১৯৬৬ সালের ৮ মে এই বাড়ি থেকেই মুজিবকে প্রিজ়ন ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। তার অব্যবহিত আগে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চেয়ে তিনি ছ’দফা দাবিসনদ ঘোষণা করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই বাড়িতেই হামলা করেছিল পাক ফৌজ। ধানমন্ডির লেকের পাশ বরাবর রাস্তায় গুলিবৃষ্টি করতে করতে সেনাবাহিনী পৌঁছেছিল এই বাড়ির প্রধান ফটকে। তাদের অবিশ্রান্ত বুলেটের ঘায়ে যখন এ ফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে যাচ্ছে ৩২, ধানমন্ডির প্রধান ফটক আর একতলা-দোতলার ঘরের কাঠের দরজা, ঝনঝন করে ভেঙে পড়ছে জানালার কাচ, মুজিব স্বয়ং বেরিয়ে এসেছিলেন দোতলার বারান্দায়। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গলা চড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘গুলি চালানো বন্ধ কর! আমি আসছি।’’
কয়েক মিনিটের মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন মুজিব। দ্রুত তাঁকে তোলা হয় পাক সেনার ভ্যানে। সটান নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ধানমন্ডির এই বাড়ির দখল নেয় পাকিস্তানি ফৌজ।
৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে আবার প্রাণের স্পন্দন ফিরেছিল পরাজিত পাকিস্তান মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার পরে। তখন তিনি আর কালকুঠুরির বন্দি নন। তিনি তখন স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা। মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ধানমন্ডির বাড়িতে ফিরেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবুর রহমান। সেই দিন থেকে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই বাড়িই ছিল বাংলাদেশ পরিচালনার মস্তিষ্ক।
বুলডোজারের আঁকশির একের পর এক ঘা পড়ছিল ইতিহাসে ঠাসা সেই মস্তিষ্কে। খসে খসে পড়ছিল সিমেন্টের দেওয়াল, কড়ি-বর্গা, কংক্রিটের থাম। বেরিয়ে আসছিল বাংলাদেশের কঙ্কাল।
৩২ নম্বর ধানমন্ডির সামনে জড়ো-হওয়া সেই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ল স্পাইডারম্যানের মুখোশ-পরা একটা চেহারা। কাঁধে ঝান্ডায় লটকে আছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। ‘ফ্রেন্ডলি নেবারহুড স্পাইডারম্যান’-কে কোনও দিন কোনও বিপজ্জনক কিছুর সঙ্গে জুড়ে দেখিনি। কিন্তু ওই চেহারাটা দেখে ঝপ করে মনে হল— কী আশ্চর্য প্রতীকী! মনে হল, ওই ভিড়ের প্রতিটি মুখে রয়েছে একটি করে মাকড়সার মুখোশ। মাকড়সার মতোই তারা জাল বুনছে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে।
সেই লূতাতন্তুতে জড়িয়ে দম আটকে ছটফট করছে একটা আস্ত দেশ!