ভারতে আইন বা আইনের খসড়া তৈরিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে না বললেই চলে। কোনও উচ্চস্তরীয় কমিটির উপরেই বিলের খসড়া তৈরির দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। তাই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো বিতর্কিত আইনের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি করবে কয়েকটি নাগরিক সংগঠন, এমন প্রস্তাব অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে কি না, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানে সব ধর্ম, সব আচার-বিচারের মানুষের জন্য একটিই বিধি, যা বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি পারিবারিক বিষয় নির্ধারণ করবে। খসড়া তৈরিতে অংশ নেয় সেকুলার মিশন, রিফর্মিস্ট মুসলিম সোসাইটি, ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চ, জনজাতি পরিষদ, মার্টিন লুথার কিং ট্রাস্ট প্রভৃতি সংগঠন। সদস্যরা একত্র হয়ে ২০১৭ সাল থেকে ক্রমাগত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়া তৈরির কাজ শুরু করে। একশোটিরও বেশি আলোচনা সভা হয়, যেগুলিতে বহু প্রান্তিক মানুষও অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক— নানা পেশার মানুষ। খসড়া আইনে রয়েছে ১১৫টি সেকশন ও ৫টি তফসিল। কেন্দ্রীয় আইন কমিশন, আইন মন্ত্রক, ক্যাবিনেট সচিব প্রমুখের কাছে তা বিবেচনার জন্য পাঠানোও হয়েছে।
এই আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে একেবারে প্রথম থেকেই। সংবিধানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অনুচ্ছেদটি রাখা হবে কি না, তা নিয়ে সংবিধান সভায় বিস্তর আলোচনা চলে। ২৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ পক্ষে ও বিপক্ষে দশ জন সদস্য বক্তব্য রাখেন। অধিকাংশ মুসলিম সদস্য এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা করে বলেন, এই বিধির প্রয়োগ হলে মুসলিম পারিবারিক আইন বলে আর কিছু থাকবে না। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইনে নারী কী ভাবে সমানাধিকার পাবে, সে ব্যাপারে তাঁরা নীরব থাকেন। নাজ়িরুদ্দিন আহমেদের বক্তব্য ছিল, নিঃসন্দেহে এক দিন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মেনে নেব, কিন্তু সে সময় এখনও আসেনি। এক জন অমুসলিম সদস্যও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা করেন। সে সব যুক্তি ধোপে টেকেনি। অনুচ্ছেদটি গৃহীত হয়, তবে বিধির প্রণয়ন ও প্রয়োগের দায়িত্ব ভবিষ্যতের সাংসদদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই দিক থেকে দেখলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রণয়ন ও প্রয়োগ একটি সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি, যা এখনও পালন হয়নি।
২০১৭ সালে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যক্তিগত আইন সংশোধন করে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না। বর্তমানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিপরীতে ভারতে ষোলোটির মতো আইন কার্যকর আছে। কোনও কোনও পারিবারিক আইনে বহু পরিবর্তন এসেছে, লিঙ্গবৈষম্য বিশেষ নেই। অন্যগুলিতে কোনও পরিবর্তনই আসেনি। যেমন, হিন্দু কোড বিল পাশ হওয়ার পর, এবং ধাপে ধাপে তার সংশোধনী হওয়ার ফলে সেটিতে নারীদের প্রায় সমান অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইনে সংশোধন হয়নি বললেই চলে। মেয়েদের প্রাপ্য সেখানে পুরুষের অর্ধেক, বা তারও কম। কোনও কোনও বিষয়ে নারীদের অধিকার সম্পূর্ণই অস্বীকার করা হয়েছে। মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের সম্ভাবনাও কম, কারণ মুসলিম ব্যক্তিগত আইন এখনও বিধিবদ্ধ বা ‘কোডিফায়েড’ নয়। তাই স্থির হয়, সমাজের সর্বস্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি করা হবে, যেটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতীয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জনজাতি, সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে এই আইন।
খসড়া নীতি যদি কার্যকর হয়, তা হলে বাতিল হবে সব পারিবারিক আইন। পারিবারিক বিষয়ের সব ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার থাকবে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অংশ নারীর প্রাপ্য হবে। ধর্ম-নির্বিশেষে বিবাহের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হবে। সব সম্প্রদায়ে নাবালিকা বিবাহ নিষিদ্ধ, বহুবিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। সব ক্ষেত্রেই বিবাহ বিচ্ছেদ হবে আদালতের মাধ্যমে। আদালতের বাইরে ডিভোর্স নিষিদ্ধ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরুষদের সঙ্গে মেয়েরাও দত্তক নেওয়ার, সন্তানের অভিভাবক হওয়ার আধিকারী।
ভারত একটি বিশাল, বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। নানা সংস্কার, রীতি-নীতি, আচার ও অনুষ্ঠানে ভরা। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির খসড়ায় সেগুলিকে নস্যাৎ করা হয়নি। প্রতিটি ব্যক্তি, জাতি, জনজাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় তাদের মতো করে আচার, অনুষ্ঠান বা প্রথা মেনে চলতেই পারে, কিন্তু সেগুলি আইনের সমান মর্যাদা পেতে পারে না। এবং কোনও ক্ষেত্রেই নারীর সমানাধিকারকে নস্যাৎ করতে পারবে না।
১৯৫০ সালে সংবিধান চালুর সময় যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, তার বয়স আজ বাহাত্তর বছর। জাতি হিসাবে আমরা এখন পরিণত। তাই অনতিবিলম্বে ভারতে নারী সমাজের প্রতি বৈষম্যহীন একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরি করা দরকার। এই খসড়া বিধি তার প্রথম পদক্ষেপ।