প্রতীকী ছবি।
এই বছরের সবচেয়ে চমকপ্রদ মুখ ক্রিপ্টোকারেন্সি, বললে তিলমাত্র অতিকথন হবে না। ব্লকচেন প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল মুদ্রা, যার জন্য কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বা সরকারের প্রয়োজন নেই। এই মুদ্রা জাল করাও প্রায় অসম্ভব। জিনিসটা কিন্তু মোটেও এই বছরের নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সির সবচেয়ে পরিচিত ব্র্যান্ড বিটকয়েন এসেছে এক দশকেরও বেশি আগে। কিন্তু ২০২১ সালে এসে এই বৈদ্যুতিন মুদ্রা হইচই ফেলে দিয়েছে। বিটকয়েন বা এথেরিয়ামের নাম মুখে মুখে ফিরছে। কেন, তা বুঝতে গেলে অর্থনীতির দুনিয়ায় বিশ্বাস বস্তুটির মাহাত্ম্য বুঝতে হবে।
টাকা বস্তুটি পুরোপুরিই দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের উপর। সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটি ভরসা দিচ্ছে বলেই আমরা ভরসা পাচ্ছি। সেই কারণেই কিছু কাগজের টুকরোকে মহামূল্যবান জ্ঞান করছি; ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ বা ইলেকট্রনিক চিপ লাগানো একখণ্ড প্লাস্টিককে সম্মান করছে দুনিয়ার সব দোকান-বাজার। বহু মানুষকে ক্রিপ্টোকারেন্সি এমন এক ভরসা দিতে পারছে যা কোনও সরকার বা তাবড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। এখানে ভরসা প্রযুক্তি-জ্ঞানের, এবং সেই দুনিয়ায় কোনও বিগ ব্রাদারের নাক গলানোর অসম্ভাব্যতার। একবিংশ শতকের ক্রমবর্ধমান অসাম্যের পিছনে একটি বড় ভূমিকা রয়ে গিয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম টেকনোলজি সংস্থাগুলির। এই টেক দানবদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষ ভরসা করতে চাইছেন ‘ওয়েব ৩.০’-এর উপর, এক নতুন পরিবেশ যেখানে প্রযুক্তির দৌলতে মানুষ হয়ে উঠবে পুরোপুরি স্বাবলম্বী। সরকারের উপরও নির্ভর করতে হবে না, টেক সংস্থার উপরও নয়। অর্থনৈতিক লেনদেনের আঙিনায় এ-হেন বিকেন্দ্রীকরণের স্বাধীনতা পেতে গেলে ক্রিপ্টোকারেন্সিই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ভরসা। ব্যাঙ্কের উপর ভরসা করতে হচ্ছে না, ফাইন প্রিন্টের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফি দিতে হচ্ছে না, সমষ্টিগত ভাবে তৈরি কিছু নিয়ম মেনে চললেই এই স্বাধীনতা আমাদের
হাতের মুঠোয়।
এ আশা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু খুব দ্রুত সে দিকে এগিয়ে চলেছে উন্নত দেশগুলি। বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির হাত ধরে গত দু’বছরে এই ‘ডিসেন্ট্রালাইজ়ড ফিন্যান্স’ বা ‘ডেফি’তে মোট বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৯৩ বিলিয়ন ডলার। কয়েক বছর আগেও যাঁরা ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, তাঁরা এখন আশার কথা শোনাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিয়োগমূল্য পড়ে গিয়েও ফের বাড়ছে, বারংবার। এবং মানুষ সহজে আস্থা হারাচ্ছেন না, ফলে বিটকয়েন বা এথেরিয়ামের মতন প্রতিষ্ঠিত ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময়মূল্যও ডলার, পাউন্ড বা ইউরোর নিরিখে ক্রমেই বেড়েছে। যে সব লগ্নিকারী ‘ওয়েব ৩.০’ বা অর্থনীতির মানবিক মুখ নিয়ে মাথা ঘামান না, তাঁরাও ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে পাওয়া মুনাফার বহর দেখে স্তম্ভিত। ২০১৭ থেকে ২০২১, এই চার বছরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম বেড়েছে প্রায় ৬১০০%— অর্থাৎ একষট্টি গুণ, যেখানে আমেরিকার স্থাবর সম্পত্তির দাম বেড়েছে মাত্র ২৯%।
এ বছরের অক্টোবর মাসে একটি বিটকয়েন ফান্ড নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত হয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিয়োগকারী এবং সমর্থকদের জন্য বিশাল সাফল্য। এর ফলে পৃথিবীর জুড়েই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে, এবং একই সঙ্গে বাড়বে ক্রিপটোকারেন্সি-নির্ভর আর্থিক লেনদেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, এ বার থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি না কিনেও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করা যাবে। কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য? কারণ, এর ফলে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসাবে ক্রিপটোকারেন্সির বিশ্বাসযোগ্যতা মজবুত হবে। ভারত, রাশিয়া বা চিনের মতো দেশ যেখানে বহু ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে এই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারাটা ভবিষ্যৎ সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে।
তবে, মনে রাখা দরকার যে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরিরও প্রস্তুতি চলছে। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে বিনিময়ের মাধ্যম যে ক্রমেই ডিজিটাল হয়ে উঠবে, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ রাষ্ট্রশক্তিও পোষণ করে না— তাদের মাথাব্যথা বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্তর্নিহিত স্বশাসন নিয়ে, যেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনও অবকাশ নেই। তবে, বহু ক্রিপ্টোকারেন্সি প্ল্যাটফর্ম অস্বাভাবিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে মানুষকে প্রতারিত করছে, এটাও ঘটনা।
বছর শেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে— বেসরকারি ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে সরকারের সম্পর্কটা শেষ অবধি কী রকম দাঁড়াবে? বেশ কিছু দেশ এই ডিজিটাল মুদ্রাকে লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আবার, বহু দেশই তার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা ভাবছে। সহযোগিতা, না কি সংঘাত, সম্পর্কটা কোন খাতে বইবে,২০২২ সালে তার স্পষ্টতর উত্তর মেলার সম্ভাবনা প্রবল।