ভারতের সর্বত্র শ্রম কোড চালু করার দিন ধার্য হয়েছে ১ এপ্রিল, ২০২৫। নাগরিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, এ সবের খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্য যে পরিবর্তনগুলি আনছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার, শ্রম কোড তার অন্যতম। এই সব সংস্কারের প্রতিবাদ করতে বিরোধী সাংসদরা সংসদের কক্ষ ত্যাগ করেছেন, অনির্দিষ্ট কালের জন্য সংসদ বয়কট করেছেন। তাতে লাভ হয়নি। প্রশ্ন ওঠে, কৃষকদের গণ-আন্দোলনের ফলে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হল কেন্দ্র, শ্রম কোডের বেলায় তেমন কিছু হল না কেন? তার অন্যতম কারণ, যে সব বিরোধী দল সংসদে শ্রমিক কোডের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছে, সংসদ বয়কট করছে, সে সব দলেরই ভোল বদলে যাচ্ছে রাজ্যে। রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস, সিপিএম-এর মতো দল স্বচ্ছন্দে শ্রম কোড পাশ করছে। এই দ্বিচারিতা যতটা বিস্মিত করছে, ততটাই হতাশ করছে বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিককে।
ভারতে রাজ্যের এবং কেন্দ্রের শ্রম-সংক্রান্ত আইন রয়েছে দেড়শোরও বেশি। এগুলির মধ্যে ঊনত্রিশটি শ্রম আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চারটি শ্রমিক কোড তৈরি করেছে। সেগুলির বিষয়— মজুরি, শিল্পে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, শ্রমিকের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ, এবং শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা। ২০১৯ সালে করোনা অতিমারি চলাকালীন কোনও আলোচনা ছাড়াই সংসদে এই কোডগুলি পেশ করা হয়, এবং মজুরি সংক্রান্ত কোডটি কার্যত চালু হয়ে যায়। বাকি তিনটি শ্রমিক কোড সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ২০২০ সালে সেগুলিকে পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্র।
অথচ, এই আইনগুলির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন, মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে চালু রয়েছে ‘টাইম রেট’ ও ‘পিস রেট’, যা শ্রমিকের দক্ষতার মাপকাঠিকে গণ্য করে না। বিভিন্ন পেশায় এত দিন মজুরি নির্ধারণ হত কয়েকটি শর্ত মেনে, যার মধ্যে ধরা থাকত খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, সন্তান পালন, পেনশন, সঞ্চয় ইত্যাদি বিষয়গুলি। এগুলো শ্রম কোডে বাদ পড়ে গেল। নির্দিষ্ট সময় পর পর মজুরি সংশোধনের দায় রইল না নিয়োগকারীর। কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা (আট ঘণ্টা) তুলে দেওয়া হল। আপত্তি উঠেছে, এমন আইন কি সংবিধানের ধারাকে লঙ্ঘন করে না? মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন নির্দেশকে অমান্য করে না?
কেন্দ্র সর্বনিম্ন (ফ্লোর লেভেল) মজুরি নির্ধারণ করেছে দৈনিক ১৭৮ টাকা বা মাসে ৪৬২৮ টাকা। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত কমিটিই সুপারিশ করেছিল যে মজুরি হোক দৈনিক ৩৭৫-৪৪৭ টাকা। তা গ্রহণ করা হয়নি। কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পানীয় জল, শৌচাগার, ক্রেশ, ক্যান্টিন ইত্যাদির ব্যবস্থা করার আইনি দায় থেকেও কার্যত মুক্তি দেওয়া হয়েছে নিয়োগকারীকে। এগুলি তাঁর সদিচ্ছার উপর ছাড়া হয়েছে। সর্বোপরি, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক, যাঁরা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ, তাঁদের অধিকার শ্রম কোডে সুরক্ষিত হয়নি।
শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে গত সেপ্টেম্বরে সারা দেশে হাজার খানেক সভা করল বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। এগুলির মধ্যে রয়েছে কংগ্রেস, সিপিআইএম, সিপিআই প্রভৃতি দলের দ্বারা প্রভাবিত নানা ইউনিয়ন। ৭ এপ্রিল সিপিআইএম-এর একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে চারটি শ্রম কোড শ্রমজীবীদের উপর দাসত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার প্রকল্প, শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হামলা। এর পিছনে রয়েছে নিখাদ শ্রেণি প্রতিহিংসার মনোভাব। অথচ, কেরলে সিপিআইএম পরিচালিত পিনারাই বিজয়ন সরকার ২০২১ সালেই চারটি কোড চালু করে দিয়েছে। তার কয়েক মাস পরে সিটু-র সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা শিলিগুড়িতে এক সভায় (২৬ ডিসেম্বর, ২০২২) বলেছিলেন যে, কৃষক আইন বাতিলের মতো, শ্রম কোড প্রত্যাহারের জন্যও আন্দোলন করতে হবে। এর মানে কী?
কেবল সিপিআইএম নয়, প্রশ্ন ওঠে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও। কেন্দ্রীয় সরকার শ্রম কোড আনার আগে ২০১৮ সালে রাজস্থানে অশোক গহলৌত সরকার শ্রম আইনে এমন কিছু রদবদল আনে, যা নিয়ে সারা দেশে শ্রমিক মহলে প্রতিবাদ শুরু হয়। ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট-এ পরিবর্তন করে কাজের ঘণ্টা বাড়ানো, উৎপাদন কেন্দ্রিক মজুরিকে সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি। এই পরিবর্তনগুলো মোদী সরকারকে ‘অনুপ্রাণিত’ করেছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। ২০১৯ সালে মজুরি সংক্রান্ত কোড পাশ হওয়ার পরে, বাকি তিনটি কোড ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০, বিনা আলোচনাতেই পাশ হয়েছিল, কারণ সে দিন কৃষি বিলের বিরোধিতা করে সংসদ বয়কট করছিলেন বিরোধীরা। অতঃপর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বিবৃতি দেন, কৃষকদের পর কেন্দ্রীয় সরকারের আক্রমণের লক্ষ্য শ্রমিকেরা। তা হলে সংসদ বয়কট করে বিনা বিরোধিতায় শ্রম কোড পাশ হতে দিল কেন কংগ্রেস?
২০২০-২০২৩ সালের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী বলে পরিচিত অন্তত চোদ্দোটি রাজ্যে শ্রম কোড চালু হয়ে গিয়েছে। কেরল, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, পঞ্জাব, তেলঙ্গানা, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্য, যেগুলি বিজেপি-বিরোধিতার জন্য পরিচিত, সেগুলিতেও চালু হয়ে গিয়েছে শ্রমিক কোড। ভারতের আটাশটি রাজ্য এবং আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। সব মিলিয়ে ছত্রিশটি, চার-পাঁচটি বাদে বাকিগুলিতে গেজ়েট ঘোষণার মাধ্যমে শ্রম কোডের বিধি-নিয়ম ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য শ্রম কোড গ্রহণ করেনি। কেন্দ্র আপাতত রাজ্যকে ‘বুঝিয়ে বলা’-র নীতি নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গেও আলোচনা জারি রেখেছে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক। ট্রেড ইউনিয়নগুলি এখনও নাছোড় মনোভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু রাজ্য-রাজনীতির দিকে তাকালে মনে হয়, এ হয়তো ছায়াযুদ্ধ।