Medicine Price

ওষুধের দাম, প্রাণের মূল্য

প্রতিটি গ্রামে, এমনকি শহরেও, এক বা একাধিক ডিগ্রিহীন চিকিৎসক বা ‘কোয়াক ডাক্তার’ আছেন। ঝড়-জলে, দিনে-রাতে এঁরাই গ্রামের মানুষের সঙ্গী।

Advertisement
জয়ন্ত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:৫৪

গত মাসে এগারোটি অত্যাবশ্যক ওষুধের মূল্যের উপর নিয়ন্ত্রণ তুলে নিল কেন্দ্র। ফলে এ ওষুধগুলোর দাম বাড়বে ৫০ শতাংশ অবধি, অর্থাৎ দেড়গুণ। এই সব ওষুধের মধ্যে হাঁপানি, গ্লুকোমা, থ্যালাসেমিয়া, টিবির মতো রোগের জন্য প্রথম ধাপের ওষুধগুলো (ফার্স্ট লাইন ড্রাগস) রয়েছে। এ ছাড়াও বেনজ়াইলপেনিসিলিন, অ্যাট্রোপিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন (টিবি ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ), সালবিউটামল ট্যাবলেট এবং ইনহেলার (শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত), অ্যান্টিবায়োটিক সেফাড্রক্সিল, থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ডেসফেরিঅক্সামিন ইনজেকশন, মানসিক রোগের ওষুধ লিথিয়াম ইত্যাদি রয়েছে।

Advertisement

গত কয়েক বছরে বার বার দাম বেড়েছে ওষুধের। ২০২১ সালে অত্যাবশ্যক তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম প্রায় ১১ শতাংশ বাড়িয়েছিল ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (এনপিপিএ)। ২০২৩ সালে ওই বর্ধিত অঙ্কের উপর দাম বেড়েছিল আরও ১২ শতাংশ। আর ২০২৪ সালে এক লাফে পঞ্চাশ শতাংশ অবধি দাম বৃদ্ধি হল। এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিঘাত পড়ছে শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের উপরে, এবং গ্রামের নানা স্তরের মানুষের উপরে। খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দামে বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় বৃদ্ধি ঘটেনি। ফলে জেলা শহর বা গ্রামাঞ্চলে রোগীদের কিছু প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ছে। এর কতকগুলো ধাপ বা পর্যায় আছে। এক, কয়েক দিন ওষুধ খাওয়ার পরে পয়সার অভাবে ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছেন (যার পোশাকি নাম ‘ড্রাগ ডিফল্টার’), চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত আসাও বন্ধ করছেন। কয়েক মাস পরে যখন হাতে পয়সা আসছে তখন আবার দেখাতে আসছেন। এতে অদৃশ্য ভাবে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের অসুখের রোগীদের।

দুই, প্রতিটি গ্রামে, এমনকি শহরেও, এক বা একাধিক ডিগ্রিহীন চিকিৎসক বা ‘কোয়াক ডাক্তার’ আছেন। ঝড়-জলে, দিনে-রাতে এঁরাই গ্রামের মানুষের সঙ্গী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে এঁদের অনেকেই দু’তিন দিনের ওষুধ দিয়ে, রোগের উপসর্গ স্তিমিত হলেই রোগীকে সুস্থ বলে মনে করেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওষুধ খেয়ে যেতে বলেন না। ফলে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। আবার রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে এ রকম বহু রোগী প্রামাণ্য চিকিৎসকদের দেখাতে আসেন। তত দিনে সুলভ ওষুধগুলিতে রোগীর প্রতিরোধ জন্মে যায়।

এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ হল প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগী এবং চিকিৎসকের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, এবং রোগী পরবর্তী চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবেন বুঝতে পারেন। অনেক উন্নত দেশও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হচ্ছে। ১১ অক্টোবর ২০২৪-এ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডসিন-এ প্রকাশিত ‘দ্য ফেলিং ইউএস হেলথ সিস্টেম’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, যে-দু’টি বিষয়ে আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায়-পূর্ণত ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলি হল: এক, ব্যক্তি মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা দেওয়া, এবং দুই, ভাল থাকার উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশ তৈরি করা। রোগীদের অপ্রয়োজনীয় কষ্ট এবং অবান্তর মৃত্যু এড়ানোয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যর্থ। আমেরিকার জিডিপির ১৭-১৮ শতাংশ স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও তা হল স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অসুখী দেশগুলোর একটি। সেখানে ভারতের স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির বরাদ্দ এখনও দু’শতাংশের কম।

‘সবার জন্য চিকিৎসা’ নিশ্চিত করতে সরকার প্রধানত বিমার জন্য বিপুল বরাদ্দ করেছে— স্বাস্থ্যসাথী, আয়ুষ্মান ভারত প্রভৃতি প্রকল্প দরিদ্রকেও বড় হাসপাতালে প্রবেশের ছাড়পত্র দিচ্ছে। কিন্তু যদি প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভঙ্গুর এবং মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকে, তা হলে সাধারণ অসুখের জন্যেও উচ্চতম স্তরের (টার্শিয়ারি) সরকারি হাসপাতাল কিংবা কর্পোরেট হাসপাতালে ছুটতে হবে মানুষকে। বিমা থাকলেও বেশ কিছু খরচ মেটাতে হয় পকেট থেকে। এর সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে খাওয়ার জন্য ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি যুক্ত হলে খরচের অঙ্ক কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়।

কেবল খরচের দিকটিই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগও উঠেছে। ২০২২ সালে সরকার ওই তালিকা প্রকাশের পরে লান্সেট-এ একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এই নির্দেশিকায় ওষুধগুলো কী ভাবে ব্যবহৃত হবে, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বিবশকারী ওষুধ ‘লিগনোকেন’-এর ক্ষেত্রে এক শতাংশ, দু’শতাংশ, পাঁচ শতাংশ ও সাড়ে সাত শতাংশ দ্রবণের ইনজেকশনের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোন ইনজেকশন কী ভাবে দিতে হবে, তার গাইডলাইন নেই। আবার ‘ড্রপস’ বলে কিছু ওষুধের কথা বলা আছে। কিন্তু কোনটা শিশুদের মুখে দিতে হবে, কোনটিই বা চোখের ড্রপ, সে কথারও উল্লেখ নেই। এই অস্পষ্টতার দায় কার? তালিকায় উল্লিখিত কোন ওষুধের কী উদ্দেশ্য, কোন পরিমাপে ব্যবহার করা যেতে পারে, নির্ধারণ করতে টাস্ক ফোর্স তৈরি করা দরকার ছিল। ২০২৪ সাল শেষ হতে চলেছে, সে কাজ করা হয়নি।

আরও পড়ুন
Advertisement