একমাত্র: রাজস্থানে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছেন এক বিজেপি প্রার্থী। ৩ নভেম্বর। পিটিআই।
এই মুহূর্তে সাংবাদিক সম্মেলন করলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটা প্রশ্ন করা যেত— ২০২৪-এর লোকসভা ভোটই কি আপনার শেষ নির্বাচন? প্রশ্নটা অকারণ চিমটি কাটার জন্য নয়। নরেন্দ্র মোদীর বয়স এখন ৭৩ বছর। দু’বছর পরে তিনি পঁচাত্তরে পা দেবেন। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাজত্বের বিজেপির অলিখিত নিয়মই বলে, পঁচাত্তরে পা দেওয়ার পরে আর ভোটে লড়াইয়ের টিকিট মেলে না। সেই হিসাবে আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজয়রথ ছুটিয়ে তিনি তৃতীয় বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও, সেটাই নরেন্দ্র মোদীর শেষ নির্বাচন হওয়া উচিত।
নরেন্দ্র মোদী অবশ্য সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। তাই উত্তর মেলা দূরের কথা, প্রশ্নটাই করা সম্ভব নয়। তিনি এমনিতেও এখন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে ব্যস্ত। নিয়মমাফিক ২০২৪-ই যদি তাঁর শেষ নির্বাচন বলে ধরে নিই, তবে সেই শেষ বারের মতো রণাঙ্গনে নামার আগে এই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনই ‘মোদী ম্যাজিক’-এর অন্তিম মহড়া। ‘মোদী ম্যাজিক’-এর চমক এখনও বহাল কি না, চব্বিশের লোকসভাতেও তাতে ভর করে বিজেপি বৈতরণি পার হবে কি না, তা পরখ করার এর থেকে ভাল কষ্টিপাথর আর বোধ হয় মিলত না।
কারণ? কারণ এই প্রথম পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে শুধুই নরেন্দ্র মোদী ময়দানে। এই প্রথম বিজেপির হোর্ডিং-পোস্টার-ব্যানারে মোদীর পাশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে রাজ্যের কোনও নেতার মুখ দেখা যাচ্ছে না। এই প্রথম ছত্তীসগঢ়ে রমন সিংহ আর বিজেপির মুখ নন। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজেকে আর মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে তুলে ধরা হয়নি। তাঁরা মাঠে রয়েছেন। তবে সেনাপতি হিসাবে নন। মধ্যপ্রদেশে ১৮ বছর মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে থাকা শিবরাজ সিংহ চৌহানকেও সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তিনিও মাঠে রয়েছেন। তবে দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে, ভিড়ে মিশে। এই প্রথম রাজস্থানে অশোক গহলৌত, ছত্তীসগঢ়ে ভূপেশ বাঘেল, মধ্যপ্রদেশে কমল নাথ বা তেলঙ্গানায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীই বিজেপির একমাত্র মুখ। মোদী প্রচারে গিয়ে বলছেন, পদ্মফুল প্রতীকই দলের একমাত্র নেতা।
উল্টো দিকে, বিরোধী জোট ইন্ডিয়া গঠনের পরে কংগ্রেস এই প্রথম নির্বাচনী লড়াইয়ে নামছে। সব রাজ্যের নির্বাচনেই কংগ্রেসের প্রধান অস্ত্র মোদী সরকারের আর্থিক নীতির ফলে মানুষের দুরবস্থা। এবং সেই দুরবস্থায় আমজনতার সুরাহা হিসাবে বেকার ভাতা, সরকারি চাকরি, অর্ধেক দামে রান্নার গ্যাস, চাষিদের ঋণ মকুব, নিখরচায় চিকিৎসার মতো কংগ্রেসের বহুবিধ গ্যারান্টি। মোদীর ওবিসি পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা তোলা ঠেকাতে বিরোধী শিবির জাতগণনার দাবি তুলেছে। মোদী তা মানতে নারাজ। তিনি গরিবদের ‘সবচেয়ে বড় জাত’ বলে দাবি করেছেন। নিজেও দারিদ্র থেকে উঠে এসেছেন বলে নিজের গায়ে ওবিসি ও গরিব, দুই পরিচিতিই চাপিয়ে নিয়েছেন। বিরোধীদের জাতপাতের রাজনীতি বনাম বিজেপির হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রাখার প্রথম পরীক্ষাও এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে। ‘মোদী ম্যাজিক’ ধরে রাখতে নরেন্দ্র মোদী কিছু দিন আগেই মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করিয়েছেন। তার সুফল মিলবে কি না, মোদীর মহিলা ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রয়েছে কি না, এ বার তারও প্রথম পরীক্ষা। সর্বোপরি এই পাঁচ রাজ্যেই ভরাডুবির প্রবল ঝুঁকি সত্ত্বেও মোদী একাই মাঠে নেমেছেন।
কংগ্রেসের যে কোনও ভোটে হারের দায় যেমন রাহুল গান্ধীর উপরেই বর্তায়, ঠিক সে ভাবে বিজেপির কোনও হারের দায় এত দিন নরেন্দ্র মোদীকে নিতে হয়নি। বিজেপি ভোটে জিতলে দিল্লিতে দলের সদর দফতরে গিয়ে মোদীই কর্মী-সমর্থকদের সামনে হাজির হয়ে জয়ের অভিবাদন গ্রহণ করেন। কিন্তু বিজেপি হারলে তার দায় রাজ্যের নেতাদের উপরে, বা দলের সভাপতি হিসাবে জে পি নড্ডা, এমনকি অমিত শাহের উপরেও গিয়ে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদীর ভরসায় বিজেপি অধুনা রাজ্যের বিধানসভা ভোটে জিততে না পারলেও, মোদীর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু এ বার পাঁচ রাজ্যে বিজেপি খারাপ ফল করলে কি ‘মোদী ম্যাজিক’-এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে?
নিশ্চিত ভাবেই। কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে বিজেপির হারের পরেই আরএসএস-এর মুখপত্রে লেখা হয়েছিল, শুধু প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার ভরসা না করে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে শক্তিশালী করতে হবে। নরেন্দ্র মোদী ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছেন। তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে নিজের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করেই মাঠে নেমেছেন। আরএসএস-এর তত্ত্বকে যেন ভুল প্রমাণিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদী ব্যর্থ হলে হয়তো তাঁর অনুগামীরা বলবেন, রাজ্য নেতাদের ভরসায় থাকলে ফল আরও খারাপ হত। কিন্তু বাস্তবে মোদীর লড়াই চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে আরও কঠিন হয়ে উঠবে। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, তেলঙ্গানা, মিজ়োরাম— এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে ২০১৮-তেও নরেন্দ্র মোদী কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছিলেন। দক্ষিণের তেলঙ্গানা বা উত্তর-পূর্বের মিজ়োরামে বিজেপি কোনও লড়াইতেই ছিল না। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান— হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যেই কংগ্রেসের কাছে হেরে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীর আসল কৃতিত্ব ছিল, তিন রাজ্যেই বিধানসভা ভোটের ফল তিনি লোকসভা ভোটে গিয়ে উল্টে দিয়েছিলেন। বিধানসভা ভোটে হারলেও বিজেপি লোকসভা ভোটের সময় ছত্তীসগঢ়ের ১১টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৯টি জিতেছিল। মধ্যপ্রদেশের ২৯টি আসনের মধ্যে ২৮টিই বিজেপি পেয়েছিল। রাজস্থানে ২৫টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি ২৪টি, তার শরিক দল একটি আসন জিতেছিল। রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস লোকসভায় একটি আসনও জিততে পারেনি। এমনকি তেলঙ্গানা থেকেও বিজেপি ৪টি আসন জিতেছিল। ঠিক যেমন ২০১৮-র গোড়ায় কর্নাটকে কংগ্রেস-জেডি(এস) সরকার গড়লেও, লোকসভা ভোটের সময় বিজেপি রাজ্যের ২৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২৫টি জিতেছিল। বিজেপির সমর্থনে এক জন নির্দল প্রার্থীও জিতে এসেছিলেন। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস, জেডি(এস)-কে একটি করে আসনে জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
নরেন্দ্র মোদী এ বার মিজ়োরামে প্রচারে যাননি। মিজ়োরামে মাত্র একটি লোকসভা আসন। এনডিএ-র শরিক দলের কাছে। বাকি চারটি রাজ্যে বিজেপির ৬৫ জন সাংসদ রয়েছেন। তার মধ্যে হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ৬১ জন। যদি তার সঙ্গে কর্নাটকের লোকসভা আসন ধরি, তা হলে কর্নাটক, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তেলঙ্গানা থেকে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ৯০ জন। এই রাজ্যগুলির ভোটে খারাপ ফল করেও নরেন্দ্র মোদী যদি লোকসভা ভোটে ফের বিজেপি-কে ৯০ জনের মতো সাংসদ এনে দিতে পারেন, তা হলে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর গদিও তৃতীয় বারের জন্য সুনিশ্চিত থাকবে বলা যায়। রাজ্যের ভোটে না হলেও, শেষ লোকসভা নির্বাচনের লড়াই পর্যন্ত ‘মোদী ম্যাজিক’ অক্ষুণ্ণ ছিল, তা প্রমাণ হবে।
গত লোকসভা ভোটে পুলওয়ামায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে জঙ্গি হামলা এবং তার জবাবে বালাকোটে বায়ুসেনার হানাকে নির্বাচনী পুঁজি করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেনাবাহিনীর বীরত্বের নামে ভোট চেয়েছিলেন। তাতে নোট বাতিলের ফলে মানুষের হেনস্থাও ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। এ বার লোকসভা নির্বাচনে কোন প্রশ্ন বড় হয়ে উঠবে, তা এখনও অস্পষ্ট। রামমন্দিরের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে যে আবেগ তৈরির চেষ্টা হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিরোধীরা মোদীর বিরুদ্ধে আদানি-কেলেঙ্কারি থেকে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, আমজনতার আর্থিক দুরবস্থাকে হাতিয়ার করছে। এ থেকে আমজনতার নজর ঘোরাতে নরেন্দ্র মোদীর হয়তো রামমন্দির ছাড়াও অন্য কিছু বিতর্ক, অন্য কিছু চমক প্রয়োজন পড়বে।
নরেন্দ্র মোদী সাংবাদিক সম্মেলন করলে প্রশ্ন করা যেত, তিনি নিজেও এই পাঁচ রাজ্যের ভোটে ‘মোদী ম্যাজিক’-এর কার্যকারিতা যাচাই করে নিতে চাইছেন? না কি, আরএসএস-কে ভুল প্রমাণ করাটাই তাঁর কাছে একমাত্র চ্যালেঞ্জ!