Senior Citizens

নিঃসঙ্গদের ভার নেবে কে

দেশের ‘সিনিয়র সিটিজ়েন’রা ভাল নেই। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, পাড়া-প্রতিবেশী— অনেকেই বয়োজ্যেষ্ঠদের যথাযথ মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন না। অবজ্ঞা, লাঞ্ছনাই ভাগ্যলিপি।

Advertisement
অরবিন্দ সামন্ত
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৪ ০৭:৩৪

মেট্রো ব্রেক কষলেই বয়স্ক মানুষটি টাল সামলাতে না পেরে সামনের সিটের উপর ঝুঁকে পড়ছিলেন। সামনের সিটে, প্রবীণ নাগরিকদের আসনে, বলিষ্ঠ কপোত-কপোতী অপার্থিব উদাসীনতায় বসে আছেন। বাড়িতেও কি বয়স্ক বাবা-মা, ঠাকুমা-ঠাকুর্দাকে এমন অভদ্র, নির্মম উপেক্ষায় অভ্যস্ত এই অল্পবয়সিরা?

Advertisement

দেশের ‘সিনিয়র সিটিজ়েন’রা ভাল নেই। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, পাড়া-প্রতিবেশী— অনেকেই বয়োজ্যেষ্ঠদের যথাযথ মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন না। অবজ্ঞা, লাঞ্ছনাই ভাগ্যলিপি। অথচ একটা সময়ে, যৌথ পরিবারে, বয়স্করাই ছিলেন অন্যতম নীতি নির্ধারণকর্তা, কর্তৃত্বেরও অনেকখানি অধিকারী। সময় বদলেছে, এঁরা এখন প্রান্তিকায়িত। ‘সিনিয়র সিটিজ়েন’ এক সামাজিক নির্মাণমাত্র। ‘সিনিয়র’-এর সম্মান তো নয়ই, কখনও কখনও ‘সিটিজ়েন’ বলেও গ্রাহ্য নন। প্রাপ্য সামাজিক মর্যাদা জোটে না।

নিঃশব্দে এঁদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৩-এর ‘ইন্ডিয়া এজিং রিপোর্ট’ বলছে, ৬০ কিংবা ষাটোর্ধ্বের সংখ্যা দেশে ১৪.৯ কোটি— জনসংখ্যার প্রায় ১০.৫%। ২৫ বছরেই সংখ্যাটা দ্বিগুণ হতে পারে। প্রবীণদের মধ্যে আশি-ঊর্ধ্বদের সংখ্যাও বাড়ছে। জনসংখ্যা দেশের সম্পদ। কিন্তু আমরা কি এই সম্পদকে যথাযথ সংরক্ষণের চেষ্টা করি? বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্য পরিষেবা, অর্থনৈতিক সহায়তা, সামাজিক সম্মান দিতে পারি?

গবেষকরা বলছেন, দেশের বয়স্কদের প্রায় ৪০% দরিদ্রতম অংশের অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ১৯% নিজস্ব আয় ছাড়াই জীবন কাটাচ্ছেন। বয়স্কদের ৭১% গ্রামবাসী। ষাট ও আশির কোঠায় থিতু মহিলাদের ক্রমবর্ধমান দীর্ঘায়ুর কারণে, বয়স্ক জনসংখ্যা নারী-অধ্যুষিত। এই মহিলারা অধিকাংশই নিরক্ষর, বিধবা, ন্যূনতম সঞ্চয়হীন। ফলে নানা বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের শিকার।

শহুরে অভিজাত প্রবীণদের অবস্থাও ভাল নয়। উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগটুকু হয়তো পান। শহরতলি, গ্রামাঞ্চলের বয়স্করা অনেক সময়ই সে সুযোগে বঞ্চিত। আসলে, দেশের অধিকাংশ বয়স্ক যত্ন-আত্তি, সেবা-শুশ্রূষা সন্তান-সন্ততিদের থেকেই পেতেন। আজকাল উচ্চশিক্ষা, চাকরির প্রয়োজনে ছেলেমেয়েরা বাইরে যেতে বাধ্য। যৌথ পরিবার ভেঙেছিল আগেই। অণু পরিবারেরও নতুন ধরনের ভাঙন হচ্ছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিবারে এমন ‘পড়ে থাকা’ বয়স্কদের সংখ্যা বাড়ছে। সমীক্ষা বলছে, ষাট কিংবা ষাটোর্ধ্বের ৬% একাই থাকেন। ২০%-ই ছেলেমেয়ে ছাড়া দিন কাটান রান্নাবান্না, ঘরকন্নায়, গল্পগুজব করে। এটি মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। নিম্নবিত্তরা দিনযাপনের জন্য লড়াই করে যান। সেই পরিবারে বয়স্কদের খাদ্য, পথ্য, স্বাস্থ্য অবর্ণনীয় আর্থিক বোঝা। ফলে বয়স্কদের উপর শারীরিক, মানসিক নির্যাতন বাড়তে থাকে। ‘হেল্পএজ ইন্ডিয়া’ বলছে, দেশে ২৫% বয়স্কই পরিবারে নির্যাতিত।

নির্যাতন, লাঞ্ছনা ঘরেই আটকে নেই। বাইরেও বয়স্করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্মানের সঙ্গে নিজের মতো ঘোরাঘুরি করতে পারেন না। তির্যক মন্তব্য ধেয়ে আসে তাঁদের দিকে। তাঁদের ঘুরে বেড়ানোর মতো জায়গা, কিংবা পরিসর তৈরি করার ভাবনা এ দেশের সংস্কৃতিতে নেই।

পশ্চিমে গল্পটা অন্য। শিল্পবিপ্লবের যুগ থেকেই অবসরপ্রাপ্তরা অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে জমিজিরেত কিনে ফার্মিং করেন। অবসরের পরেও রুজি-রোজগারের পথ খোলা। ভারতে প্রবীণেরা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় গ্রাম, মফস্‌সল ছেড়ে শহরে আসার চেষ্টা করেন। নাগরিক টান এ দেশে অনেক বেশি। অথচ অসুখ-বিসুখে পড়লেই সঞ্চয় নিঃশেষ। আপদে-বিপদে হাত পাততে হয় ছেলেমেয়েদের কাছে। পশ্চিমে সত্তর বছরের মানুষেরা আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী। শরীরেও তুলনায় বেশি সক্ষম। গাড়ি, সাইকেল চালিয়ে তাঁরা নিজের মতো ঘোরেন। সপ্তাহান্তে আনন্দ করার ধরনটাও আলাদা। মোট কথা, তাঁরা অপরের বোঝা হতে নারাজ। এর খানিকটা আর্থিক স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাকিটা— মানসিকতার ফারাক।

এ দেশে অনেকের জন্যই বার্ধক্য মানেই ক্ষয়ক্ষতির ঝাপটা। কেউ হারিয়েছেন স্বামী বা স্ত্রী, কারও ক্ষতি সন্তানসন্ততির বিয়োগে। দীর্ঘমেয়াদি সঙ্গী হারানোর ক্ষতই বয়স্ক জীবনের অপরিবর্তনীয় চিহ্ন। স্পর্শের অনুভূতি থেকে তাঁরা বঞ্চিত, ফলে বেদনাদায়ক শূন্যতা ও একাকিত্ব ক্রমেই গভীরতর হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ছ’বছরের মধ্যে, বিশ্বের ছ’জনের মধ্যে এক জনের বয়স ৬০ বা বেশি হবে। একাকিত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় এঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হবে। ছ’জন বয়স্কের মধ্যে এক জন তত্ত্বাবধায়কদের দ্বারাই নির্যাতিত হতে পারেন। ৬০ বা তার বেশি বয়সিদের অন্তত ১৪% মানসিক ব্যাধি নিয়েই বেঁচে থাকবেন।

যাঁদের পরিবার আছে, যাঁরা এক কালে শ্রমে, মেধায় সংসার গড়ে তুলেছেন, অবসর নিলে কি একটু সেবা, সম্মান তাঁরা পাবেন না? আর যাঁরা পরিবারহীন, একা, কে নেবে তাঁদের ভার— সমাজ ও প্রশাসন ছাড়া? এঁদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দেখাশোনায় কবে থাকবে পেশাদার ডাক্তার, ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট, নার্সের বন্দোবস্ত? একটি সুস্থ সমাজ কেবল সবল নাগরিকের কথাই ভাবে না, তুলনায় অশক্ত, অ-সবলদের কী ভাবে ভাল রাখা যায়, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করে, পদক্ষেপ করে। সুস্থতার আর একটি উপাদান: সংবেদন।

আরও পড়ুন
Advertisement