Bhoot Chaturdashi

বাঙালির প্রিয় ভূতেরা কি ভূত চতুর্দশীতে এখনও জনপ্রিয়? নাকি তারা সব ঢাকা পড়ল হ্যালোউইনে

ভয় দেখানো হোক কি উপকার, পাশ্চাত্য ‘হরর’ পড়া থাক বা না-থাক, ভূত চতুর্দশীর থেকে ‘হ্যালোউইন’ নামটাই যেন বেশি পছন্দ এখনকার বাঙালির।

Advertisement
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২ ১০:৫৬
 ভূত চতুর্দশীর থেকেও বিদেশের হ্যালোউইন এখন বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ভূত চতুর্দশীর থেকেও বিদেশের হ্যালোউইন এখন বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হিমের রাত। একটু একটু কুয়াশা। রাতের দিকে শিরশিরানি। শীত শীত গন্ধ। এমনই একটা সময় ভূত চতুর্দশী আসে। আর পাশ্চাত্যে আসে হ্যালোউইন। সর্বজনস্বীকৃত ভূতেদের দিন।

‘ভূত’ শব্দটার মধ্যেই পরস্পরবিরোধী অর্থ রয়ে গিয়েছে। ভূত বিশেষণ অর্থে যা অতীত, অর্থাৎ ছিল। আবার ভূত মানে পঞ্চভূত, অর্থাৎ ততটাই বর্তমান। বিশেষ্য অর্থে ভূত আবার এক অবমানব অস্তিত্ব। যার একটা অতীত থাকলেও থাকতে পারে। দেশ, বিদেশ, সমাজ, সাহিত্য, চলচ্চিত্র— সব ক্ষেত্রেই আমরা ভূতের অনুষঙ্গ দেখতে পাই। যার সঙ্গে কোথাও প্রত্যক্ষ ভাবে কোথাও আবার রূপকার্থে যোগ থেকে যায় মৃত্যুর।

Advertisement

মৃত্যুর পর কী রয়েছে, তা জানার অদম্য কৌতূহল সারা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে। সময় এবং সমাজের তথা সভ্যতার উপাদানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু এবং মৃত্যু-পরবর্তী বোধেও এসেছে বদল। তাই ভূত আগে যেমন অন্ধকার রেলস্টেশনে, লোডশেডিংয়ের সময় আসত, এখন বহুতল ফ্ল্যাটে, ভিড় রাস্তায় গাড়ির লুকিং গ্লাসেও। আসলে প্রযুক্তির হাত ধরে ভূতেদের আসা-যাওয়া। ‘মৃতের আত্মা পরলোক থেকে আমাদের সাড়া পেয়ে ফিরে আসে’ কি না, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক থাকলেও ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর আমেরিকার রচেস্টার শহরে প্রেততত্ত্বের প্রথম মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আমেরিকায় একের পর এক ঘটে চলা ‘যুক্তি-বুদ্ধির বাইরের ঘটনা’।

এ দেশে আগে থেকেই পরলোকচর্চা হত। কিন্তু সেই চর্চায় আক্ষরিক বৈদেশিক সূত্রপাত ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮৫৩ সালে। যখন কর্নেল ওলকট আর মাদাম ব্লাভাটস্কি মুম্বই শহরে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ তৈরি করেন। পাশ্চাত্যের স্পিরিটিজমের চর্চার ধারার সঙ্গে পরলোকচর্চায় বিশ্বাসী অভিজাত ভারতবাসী পরিচিত হয়ে উঠল। তবে এই চর্চার সঙ্গে ভূত চতুর্দশী বা হ্যালোউইনের সরাসরি যোগ নেই। লোকবিশ্বাস মেনে সামাজিক পরিসরে এই প্রথা কিছুটা ধর্ম আর বাকিটা সংস্কার নিয়েই চলেছে বহু দিন ধরে।

দীপাবলির আগের রাতে কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ভূত চতুর্দশী পালিত হয়।

দীপাবলির আগের রাতে কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ভূত চতুর্দশী পালিত হয়। ফাইল চিত্র।

আমাদের এখানে দীপাবলির আগের রাতে কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ভূত চতুর্দশী পালিত হয়। গৃহস্থ বাড়িতে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়। চোদ্দশাক খাওয়ার রীতিও আছে। প্রথা অনুসারে বিশ্বাস, মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে প্রকৃতি থেকেই খুঁজে পাওয়া উপাদান দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। তবু ভূত চতুর্দশীর থেকেও বিদেশের হ্যালোউইন এখন বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হ্যালোউইনের দিন ভয় পাওয়ার বিশেষ সাজ, হ্যালোউইন পার্টি আর হ্যালোউইন সংক্রান্ত মেসেজে ইনবক্স ভরে যায়।

ভূত চতুর্দশী আর পাশ্চাত্যের হ্যালোউইন দিবস প্রায় কাছাকাছি সময়েই আসে। তবে বাঙালির একান্ত নিজস্ব ভূত চতুর্দশীতেও পাশ্চাত্যের হ্যালোউইনের ছায়া ক্রমে জাঁকিয়ে বসছে। ক্রিসমাসের কেক-কে বাঙালি যে ভাবে আপন করে নিয়েছে, ঠিক সে ভাবেই চেনা-জানা ভূতেদের থেকেও সাহেব ভূতেদের প্রতি তাদের আকর্ষণ অনেক বেশি। এমনিতেই বিদেশি ভূতেদের বাঙালিরা আপন করে নিয়েছে ঔপনিবেশিকতার সূত্র ধরেই। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্কল-স্কেলিটন, সত্যজিৎ রায়ের ব্রাউন সাহেব, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পাগলা সাহেব ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নীলকর সাহেব, ভাল ভূত-মন্দ ভূত নিয়ে সাহেব বাংলোর ভূতেরা সাহিত্য, সিনেমা, আলোচনায় ফিরে ফিরে এসেছে। কিন্তু তার মধ্যে একটা বাঙালিয়ানা ছিল। সাহেব বা মেম ভূতেরা এখানকার জল-হাওয়াতেই তাদের বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়েছেন।

আবার বাস্তবের কিছু অনুষঙ্গ যেমন, শিমলার বোরং টানেল যা ‘টানেল নম্বর ৩৩’ নামেও পরিচিত, তাকে ঘিরে ভৌতিক আবহ তৈরি হয়েছিল কর্নেল বোরংয়ের করুণ ইতিহাস নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গেও কালিম্পঙের মর্গ্যান সাহেবের বাংলো নিয়ে তৈরি গল্প, কলকাতার হেস্টিংস হাউস, ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে ঘিরে থাকা গল্পের পিছনেও থেকে গিয়েছে সাহেবদের ছায়া।

এ সবের বড় কারণ দীর্ঘ দিন ইংরেজশাসন। নিজস্ব ইতিহাস, ভূগোল ও সামাজিক, রাজনৈতিক প্রবাহ বিভিন্ন দেশে নানান আকার ও প্রকৃতির ভূত তৈরি করেছে। তাই নদীমাতৃক বাংলার মেছোভূতকে রাজস্থানে দেখতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ্বায়নের পর নিজেদের সীমানা ছেড়ে ভূতেরাও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে নানান দিকে। ব্রহ্মদৈত্য, শাঁকচুন্নি, একানড়ে, মেছোভূতদের পাশাপাশি ভ্যাম্পায়ার, ওয়ারউল্‌ফ, পলটারজাইস্ট, বনশি প্রভৃতিরাও এখন পরিচিত।

হ্যালোউইনের দিন ভয় পাওয়ার বিশেষ সাজ, হ্যালোউইন পার্টি আর হ্যালোউইন সংক্রান্ত মেসেজে ইনবক্স ভরে যায়।

হ্যালোউইনের দিন ভয় পাওয়ার বিশেষ সাজ, হ্যালোউইন পার্টি আর হ্যালোউইন সংক্রান্ত মেসেজে ইনবক্স ভরে যায়। ফাইল চিত্র।

এক এক দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো পৃথক ধারায় পরিচালিত হয়েছে। সামাজিক আন্দোলনের ধারাও ভিন্ন ভিন্ন। বিভিন্ন জায়গায় তাই মানবমনের ভয় গড়ে ওঠার বিন্যাসেও থেকে যায় বিস্তর ফারাক। কিন্তু ভূতেদের পরিচিত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও পশ্চিমী নগরসভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তাই আমরা নিজেদের জেলার কোনও গ্রামে কালবৈশাখীর দিন আসা বাড়ুলভূতের কথার থেকেও জম্বিদের কথা বেশি জানি। ওয়েব সিরিজের দৌলতে।

ভয় দেখানো হোক কি উপকার, পাশ্চাত্য ‘হরর’ পড়া থাক বা না-থাক, ভূত চতুর্দশীর থেকে ‘হ্যালোউইন’ নামটাই যেন বেশি পছন্দ এখনকার বাঙালির। ‘আহা ভূত, বাহা ভূত/ কি বা ভূত, কিম্ভূত’ নানা রকম ভূতেদের ভিড়ে ভূত চতুর্দশীতে ভূতেদের প্রকারভেদের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে, ভয়ের ধরনে যেমন বদল এসেছে, তেমনই ভূত দেখতে চাওয়ার ক্ষেত্রেও চাহিদা বদলে গিয়েছে।

খাবার, পোশাক থেকে চিকিৎসা— সর্বত্রই বিজ্ঞাপনের ভাষা প্রতি দিন বোঝায়, যা চাইছি তা ঠিক করে পাওয়া হচ্ছে না। সহজাত প্রবৃত্তিতে ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’-এর মতন অনেকেই বলেন, ‘‘আহা! ওখানে গেলে কিন্তু ওটা দেখলে না! তা হলে আর কী করলে?’’ কিছু মানুষের মনে ঢুকে যায় কাশ্মীর, লাদাখ ঘুরে এসেও এক বার সুইৎজারল্যান্ড না গেলে যেন জীবনে কিছুই হল না। ঠিক সে ভাবেই উপমহাদেশের কালো, মোটা, বিভিন্ন বিকৃত অঙ্গের ভূতের থেকেও পাশ্চাত্যের সাদা চামড়া, কুয়াশাঘেরা কবরখানা থেকে উঠে আসা সাহেব ভূত যেন ভৌতিকতায় উন্নত। বিদেশ ঘুরে আসা ছেলের থেকেও তার মা-বাবা যে ভাবে বেশি করে বলেন, ‘‘আসলে আমাদের এখানে এত পলিউশন তো! ওখানে তো শ্বাস নিলেই অক্সিজেন!’’ সে ভাবেই আমাদের এখানে সাহেব ভূতেরা এখন বেশি জনপ্রিয়।

তবু হিমেল সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া উপাচার আর বাংলা ক্যালেন্ডারে, পঞ্জিকায় ভূত চতুর্দশী আসে। চলে যাওয়া মানুষেরা সত্যিই আর ফিরে আসতে পারেন না। কিন্তু তাঁদের স্মরণ করার উদ্‌যাপনের মাধ্যমে আসলে তাঁদের শূন্যতার বিপ্রতীপে নিজেদের অস্তিত্বকে আর এক বার স্বীকৃতি দেওয়া থাকে। আকাশপ্রদীপ জ্বেলে, চোদ্দ প্রদীপের আলোয় অন্ধকারকে দূর করার জন্য আচমকাই কোনও ছায়া দেখে চমকে ওঠার মুহূর্তে আমাদের নিজেদের হঠাৎ করে মনে হতে পারে, ‘‘আছে আছে সব আছে, সব সত্যি।’’

এ আসলে অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। দেশের ভূত হোক আর হ্যালোউইনের ভূত। সাহেব হলেও আসলে তো ভূতই।

(লেখক গবেষক। মতামত নিজস্ব।)

আরও পড়ুন
Advertisement