পুস্তক পরিচয় ১

সমাজজীবনে রেল কতটা বদল এনেছে

পরিচিত ছকের বাইরে গিয়ে ভারতীয় রেলকে সামাজিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করে লেখক একটি সংবেদনশীল, মনোজ্ঞ ও তীক্ষ্ণ আলোচনা হাজির করেছেন।

Advertisement
মৃণালকুমার বসু
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০১
ট্র্যাকস অব চেঞ্জ/ রেলওয়েজ অ্যান্ড এভরিডে লাইফ ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া, ঋতিকা প্রসাদ। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৭৯৫.০০

ট্র্যাকস অব চেঞ্জ/ রেলওয়েজ অ্যান্ড এভরিডে লাইফ ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া, ঋতিকা প্রসাদ। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৭৯৫.০০

পরিচিত ছকের বাইরে গিয়ে ভারতীয় রেলকে সামাজিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করে লেখক একটি সংবেদনশীল, মনোজ্ঞ ও তীক্ষ্ণ আলোচনা হাজির করেছেন। ভারতচন্দ্র কল্পিত কাঞ্চীপুর থেকে বর্ধমান পর্যন্ত ছ’মাসের পথ ছ’দিনে অতিক্রম করার মতোই এখানে মন্থর সামাজিক জীবনে গতিময়তার ছন্দ বর্ণনা করেছেন। অথচ উনিশ শতকের গোড়ার মধ্যবিত্ত কী ভাবে রেলের সহায়তায় উপমহাদেশের নানা প্রান্তে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তার কথা স্থান পায়নি। তবু রেল সমাজজীবনে পরিবর্তনের কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

আলোচনার শুরুতেই আছে চমক। ‘জন্তুর প্রকৃতি’ অধ্যায়ে সবচেয়ে অবহেলিত তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের কথা স্থান পেয়েছে। চূড়ান্ত ভিড়ে ঠাসা এ সব কামরার যাত্রীরা অবশ্য আজও সবচেয়ে উজ্জ্বল ভাবে টিকে আছেন হুতোম প্যাঁচার নকশা-য়। সেখানে হিন্দুযাত্রীর পাশেই দাঁড়িয়ে আবক্ষ দাড়িযুক্ত সম্ভ্রান্ত মুসলমান আর পিছনে স্ত্রীলোক ও শিশু। সামাজিক জীবনে এদের মধ্যে যেখানে দূরত্ব বজায় থাকাই স্বাভাবিক সেখানে রেল সংস্পর্শই নিয়ম বলে মনে করে। অথচ এ নিয়ম শুধু তৃতীয় শ্রেণির কামরাতেই মান্য। উঁচু স্তরে অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় এমনকী ইন্টার ক্লাসে নিয়ম আলাদা। এই বৈপরীত্য লেখকের যথাযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষণ মেনে নেওয়া হয়েছে অথচ তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীরাই পরিবহণ থেকে আয়ের নব্বই শতাংশ দেয়। ফলে বাণিজ্যিক নিয়মে যে সুবিধে তাদের প্রাপ্য তা থেকে তারা বঞ্চিত হলেও তাদের মধ্যে জাতপাতের পার্থক্য ও সংস্পর্শজনিত চিন্তাকে অক্লেশে নিন্দা করা হয়েছে। বিশ শতকে সামান্য পরিবর্তন হলেও ব্যবস্থাটি যে আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে তা লেখক জানান না। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে নিন্দা করাই যথেষ্ট বলে মনে হয় না। অথচ আরও বেশি কষ্ট ছিল আসনবিহীন চতুর্থ শ্রেণি বা তীর্থযাত্রীদের যারা আবার বাড়তি মাশুল দিত। কৃতী তাত্ত্বিকরা এক কালে আশা করেছিলেন যে আধুনিক গতিশীল রেলপরিবহণ ঐতিহ্যাশ্রয়ী সামাজিক নিয়মকানুন বদল করে দেবে। অথচ বাস্তবে রেলপথ বিস্তারের ফলে তীর্থযাত্রী বহু গুণে বেড়ে গেল তবু মানসিকতায় তেমন পরিবর্তন কেন হল না তা বোঝা গেল না।

Advertisement

অন্য দিকে রেলপথ তৈরি হল সাবেক যাত্রী বা বাণিজ্যপথকে প্রায়শই দখল করে। ফলে বঙ্কিমচন্দ্রের বইয়ে ছাড়া ‘চটি’ মুছে গেল। কাটোয়ার পথে অবশ্য টিকে আছে। একই সঙ্গে উঁচু রেলপথ তৈরি হল পাশের জমি থেকে মাটি কেটে। ফলে থাকল নীচু জমি ও উঁচু কৃত্রিম রেলপথ যা স্বাভাবিক নিকাশিব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। নীচু জমি হল মশার আঁতুরঘর যা ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে দিয়ে জনস্বাস্থ্য ও কৃষিব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিল। অথচ খুব কম রেল তৈরি হওয়া পূর্ববঙ্গে ম্যালেরিয়া জাঁকিয়ে বসেনি। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের অসাধারণ গ্রন্থও উল্লিখিত নয় এখানে। তবে বিহারের বন্যা ও রেলের বন্যার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাহিনি নিপুণ ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

রেল বহু রকম ভূমিকাই পালন করে। এক দিকে ঘাটতি এলাকায় শস্য পরিবহণ করে। আবার বাড়তি ফসল অন্য প্রান্তে নিয়ে যায় যা আবার ক্ষোভের কারণ হয়। একই সঙ্গে রেল রোগ বা মহামারীও ছড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর সব দেশেই কলেরা অতি দ্রুত রেলের কৃপায় ছড়িয়ে যেত। তবে ম্যালেরিয়া ও কলেরার কারণ যে সব বিজ্ঞানী বার করেন তাঁদের মনোবেদনার কথাও বলা হয়নি।

রেলের জন্য খাদ্যগ্রহণের নানান সামাজিক বিধিনিষেধ বদলে যায়। বদল যে কত ব্যাপক তা কেলনার কোম্পানির সাফল্য থেকে জানা যায়। তেমনই লেখক জানান যে স্টেশনে সাহেবি খানাঘর ৩৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও দেশি লোকদের খাবার ঘর নিতে লাগত এর দশগুণ বেশি টাকা। বিধিনিষেধ বরবাদ করায় প্রয়োজন ও রেল দুইই দায়ী। পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মে হকাররাও জোর ব্যবসা চালায়।

গতিশীলতার কল্পনাকে নতুন রূপ দিতে রেলের ভূমিকা খুব বেশি হলেও অন্যান্য ভূমিকা কম ছিল না। রেল চত্বর সামাজিক মেলামেশার জায়গা হয়ে যায়। রেল নিজেই আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল। তবু রাজনৈতিক নেতারা বিশেষত গাঁধীজি তৃতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণ করে ও দর্শন দিয়ে রেলচত্বরকে রাজনীতির মঞ্চ করে দেন। সমস্যা হল এতে সত্যি যাত্রীদের পাশে টিকিটবিহীনরাও ছিল। পরিষেবার কাজ ব্যাহত হত শুধু নয় অন্য সমস্যাও দেখা দিল। দেশ ভাগের ফলে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় নিল পঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গের নানা রেল চত্বরে। রেল যাত্রীপরিবহণ থেকে আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়াল। এত চাপ রেলের মতো সর্বংসহ প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সহ্য করা শক্ত হল। একই সঙ্গে রেলে বিশেষত মোগলসরাই স্টেশনের অপরাধীর কথা হিন্দি সাহিত্য থেকে তুলে ধরেছেন। বাস্তবে এ সব অপরাধীদের জাল ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিল। নানা ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও এ সমস্যাকে সঠিক ভাবে মোকাবিলা করা যায়নি। এ বিষয়ে লেখক মনোযোগ দিলে পাঠক উপকৃত হতেন।

অন্য দিকে সরকার ছাড়া এই বিপুল প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বড় কর্মীবাহিনী পালন করত। এমনকী আজও রেলের শ্রমিক বিষয়ক নিয়মাবলি অন্য সকলের কাছেও উল্লেখযোগ্য মনে হয়। এমনকী এই কর্মীগোষ্ঠীর নানা ধরনের পোশাকও ছিল। একই সঙ্গে রেলে শুধু বাইরের নয় ভেতরেও নানা পরিবর্তন ঘটেছিল। তবু কয়লানির্ভর ব্যবস্থা থেকে তেল ও শেষে বিদ্যুৎচালিত বন্দোবস্তে রূপান্তরণের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার অভাব চোখে পড়ে। এমনকী বুলেট ট্রেনও অনুল্লিখিত। রেলের কৃতিত্ব বিষয়ে সবচেয়ে আকর্ষক অধ্যায় হল রেলওয়ের সময় বিষয়ক আলোচনা। দেশের নানা প্রান্তের নানা স্থানীয় সময়কে হঠিয়ে রেল নিজস্ব সময় প্রবর্তনের মাধ্যমে যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা আজ পাঠকের কাছে প্রায় অজানা। রেল ভারতীয় নাগরিক বন্দোবস্ত গড়ার কাজে খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। নানা শহর যেমন আসানসোল, জামালপুর, দানাপুর, ইত্যাদি রেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল তার কথা অবশ্য এখানে লেখা হয়নি। উপসংহার অধ্যায়ে দিল্লির মেট্রোরেলের কথা আলোচিত হয়েছে, এটিকে আলাদা অধ্যায় করা উচিত ছিল। আর এটিকে রেলের ভবিষ্যৎ হিসেবে বর্ণনা করা কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সামগ্রিক ভাবে রেল নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের প্রধান পরিবহণ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। তবে, ব্রিটিশ ভারতের রেল ব্যবস্থার বাইরের রেলের কথা থাকলে ভাল হত। এমনকী সারা পৃথিবীর কাছে সমাদৃত দার্জিলিং রেলপথ লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করল না কেন তা বোঝা গেল না। রেল এ দেশের সমাজজীবনে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত থাকায় সিনেমা ও সাহিত্যে তার প্রতিফলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কাম্য ছিল। এমনকী ‘ভবানী জংশন’-এর কথাও নেই। বাঙালি পাঠকের অক্ষয়কুমার দত্ত থেকে সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের দার্জিলিং যাত্রার কথা মনে পড়বে। তেমনই বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রেলরঙ্গ শীর্ষক বইতে রেলের সঙ্গে যুক্ত নানা স্তরের কর্মচারী থেকে বিনা টিকিটের ‘কৈকালার দাদা’র কথাও মনে পড়ে।

তবে অতিশয় স্বাদু নিপুণ বর্ণনায় সমৃদ্ধ সামাজিক জীবনের নানা পরিবর্তনের আলেখ্য হিসেবে গ্রন্থটি পাঠকের কাছে গৃহীত হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement