পুস্তক পরিচয় ১

ছবি তোলার আদি পর্ব: ফিরে দেখা

প্রথম বার রঘু রাই সাদাকালো ছবিতে বন্দি করেছিলেন চারশো বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক ঘুমন্ত নগরীকে। পরে ২০১১-য় আবার তিনি রঙিন ছবিতে ধরেন হাম্পির আজকের জীবনযাত্রা। এই দুই ছবির জগৎ মিলেমিশে এই বইয়ে জীবন্ত করে তুলেছে বিজয়নগরের ঐতিহ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
বিজয়নগর এম্পায়ার/ রুইনস টু রেজারেকশন, ছবি রঘু রাই, লেখা উষা রাই। নিয়োগী বুকস, ৩৫০০.০০

বিজয়নগর এম্পায়ার/ রুইনস টু রেজারেকশন, ছবি রঘু রাই, লেখা উষা রাই। নিয়োগী বুকস, ৩৫০০.০০

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আলোকচিত্রী রঘু রাই গিয়েছিলেন বিজয়নগর। উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের বিস্তারপর্বে দক্ষিণ ভারতে বিজয়নগর সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন হরিহর ও বুক্ক, ১৩৩৬-১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল সে কালের সব থেকে বড় সেই হিন্দু সাম্রাজ্য। রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের (১৫০৯-১৫২৯) রাজত্বকাল তার স্বর্ণযুগ। রাজধানী হাম্পি ছিল স্থাপত্য-ভাস্কর্যে নতুন শৈলীর পীঠস্থান। রঘু রাই যখন প্রথম দেখেন তখন সংরক্ষণের কাজ সবে শুরু হয়েছে, পরের দশকগুলিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও সংরক্ষণ অনেকটাই স্পষ্ট করে তোলে তার রূপ। প্রথম বার রঘু রাই সাদাকালো ছবিতে বন্দি করেছিলেন চারশো বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক ঘুমন্ত নগরীকে। পরে ২০১১-য় আবার তিনি রঙিন ছবিতে ধরেন হাম্পির আজকের জীবনযাত্রা। এই দুই ছবির জগৎ মিলেমিশে এই বইয়ে জীবন্ত করে তুলেছে বিজয়নগরের ঐতিহ্য।

Advertisement

ক্যাপ্টেন লিনিয়াস ট্রাইপ/ ফোটোগ্রাফার অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড বার্মা ১৮৫২-১৮৬০,
রজার টেলর ও ক্রিস্টিন ব্র্যানফুট। ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট, ওয়াশিংটন ও ডেলমনিকো বুকস (প্রেস্টেল)। মূল্য অনুল্লেখিত

গত দুই দশকে ভারতে ফোটোগ্রাফির আদিপর্ব নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। সব থেকে বড় কথা, প্রকাশিত বইগুলির সৌজন্যে বিপুল পরিমাণ দুর্লভ ছবি এখন ঘরে বসে দেখা সম্ভব। এত দিনে সেই পর্বের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ কম আলোচিত আলোকচিত্রী লিনিয়াস ট্রাইপ-এর (১৮২২-১৯০২) ছবিগুলিও প্রকাশ্যে এল। ১৮৫০-এর দশকে ক্যাপ্টেন ট্রাইপ ভারতের আরও অনেক ব্রিটিশ অফিসারের মতোই ফোটোগ্রাফি চর্চায় আকৃষ্ট হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফোটোগ্রাফার হিসাবে ১৮৫৫-য় মায়ানমার এবং ১৮৫৭-’৫৮-য় দক্ষিণ ভারতে তিনি যে সব ছবি তোলেন, গুণমানে তা অসামান্য। দুঃখের বিষয়, সিপাহি বিদ্রোহের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৮৬০-এ তাঁকে স্টুডিয়ো বন্ধ করে দিতে হয়, জীবনের বাকি ৪২ বছর তিনি আর ফোটোগ্রাফিতে ফেরেননি। বেলুড়, হালেবিদ, মাদুরা, তাঞ্জোরে তোলা ট্রাইপ-এর ছবির অনবদ্য এই সংকলনে তাঁর কাজের বিস্তারিত বিবরণ ও তথ্যপঞ্জি রয়েছে।

আর্লি বম্বে ফোটোগ্রাফি, সুসান হ্যাপগুড। মাপিন ও কনটেম্পোরারি আর্টস ট্রাস্ট, মুম্বই, ১৯৫০.০০

১৮৩৯-এ ইউরোপে উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে ফোটোগ্রাফির সূচনা হল। ১৮৫০-এর মাঝামাঝি চলে এল অ্যালবুমেন প্রিন্ট। মুম্বইয়ে ফোটোগ্রাফির সূচনাপর্বে ব্রিটিশ সামরিক ও অসামরিক অফিসাররাই ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়, পরে এলেন পেশাদাররাও। বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন টমাস বিগস, উইলিয়াম হেনরি পিগো, কলিন মারে, জন এডোয়ার্ড সাশে, স্যামুয়েল বোর্ন প্রমুখ। ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম দেখা যায় নারায়ণ দাজিকে। লন্ডনে ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি তৈরির পরের বছর, ১৮৫৪-য় তৈরি হল ‘দ্য ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বোম্বে’। সোসাইটির দ্বিতীয় বার্ষিক প্রদর্শনীতে নারায়ণ দাজিরই শ’দুই ছবি ছিল! তার পর হরিচাঁদ চিন্তামন, শিবশঙ্কর নারায়ণ ও শাপুর ভেদওয়ার—স্থানীয় আলোকচিত্রীদের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন লালা দীনদয়ালও। নানা সংগ্রহ থেকে এই পর্বের বহু দুর্লভ ছবির সঙ্গে তথ্য দিয়ে ভারতীয় ফোটোগ্রাফির আদি পর্বে চমৎকার আলোকপাত করলেন সুসান হ্যাপগুড।

সিটিজ, সিটাডেলস, অ্যান্ড সাইটস অব দ্য নিয়ার ইস্ট
ফ্রান্সিস বেডফোর্ড’স নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ফোটোগ্রাফস অব ইজিপ্ট,
দ্য লেভান্ত অ্যান্ড কনস্তান্তিনোপল
,
সোফি গর্ডন ও বদর আল হাজি। দি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ইন কায়রো প্রেস, মূল্য অনুল্লেখিত

ব্রিটিশ স্থপতি ও লিথোগ্রাফার ফ্রান্সিস বেডফোর্ড (১৮১৫-১৮৯৪) সূচনা পর্বেই আকৃষ্ট হন ফোটোগ্রাফিতে, এবং দ্রুত এতটাই সাফল্য অর্জন করেন যে রানি ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে ছবি তোলার বরাত পান। ১৮৬২ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের মধ্যপ্রাচ্য সফরে বেডফোর্ড সঙ্গী হন এবং রাজপরিবারের জন্য বহু ছবি তোলেন। কায়রো সহ মিশরের নানা প্রত্নস্থল, জেরুসালেম, লেবানন, দামাস্কাস, স্মিরনা, কনস্তান্তিনোপলের প্রথম দিকের আলোকচিত্রের অন্যতম সেরা সম্ভারটি গড়ে ওঠে এ ভাবেই। ফিরে আসার পর তাঁর ছবি লন্ডনে প্রদর্শিত হয় এবং বিপুল প্রশংসা পায়। বেডফোর্ড তিনটি পোর্টফোলিয়োতে ১৭২টি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর তোলা ১২০টি সেরা ছবি এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে। চমৎকার মুদ্রণে অতীত বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

লং এক্সপোজার/ দ্য ক্যামেরা অ্যাট উদয়পুর ১৮৫৭-১৯৫৭,
প্রমোদ কুমার কেজি ও মৃণালিনী বেঙ্কটেশ্বরণ। মহারানা অব মেওয়ার চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন, উদয়পুর, মূল্য অনুল্লেখিত

মেওয়ারের রাজপরিবারের সংগ্রহে সযত্নে রক্ষিত আলোকচিত্রের বিপুল সম্ভার সবে ২০০৯-এ তালিকাবদ্ধ করে প্রথম প্রদর্শিত হয়। এ বার তারই বিবরণ প্রকাশিত হল চমৎকার একটি বইয়ে। ভারতে ফোটোগ্রাফির সূচনা থেকে বিবর্তনের এত ভাল এবং বড় সংগ্রহ খুব কমই আছে। উদয়পুরের সিটি প্যালেস মিউজিয়মে সংরক্ষিত এবং প্রদর্শিত এই সংগ্রহ বর্তমান রূপ পেয়েছে শ্রীজি অরবিন্দ সিংহ মেওয়ারের উদ্যোগে। সমসাময়িক ইতিহাসের জীবন্ত দলিল এই সব আলোকচিত্রের সংগ্রহ, সংরক্ষণের বিষয়টিও এখানে আলোচিত, আছে অনেক দুর্লভ ছবি। প্রমোদ কুমার কেজি-র লেখায় এই সংগ্রহের সামগ্রিক ছবি ফুটে উঠেছে, এর নথিকরণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন মৃণালিনী বেঙ্কটেশ্বরণ, আর কারিগরি ব্যাখ্যা দিয়েছেন এস গিরিকুমার। শেষে লরেন পাওয়ার বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় ফোটোগ্রাফির জগৎ নিয়ে নতুন ভাবনার দিশা দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement