আদিম রূপচেতনায় গড়ে ওঠে কল্পনগরী

সম্প্রতি গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত প্রবালচন্দ্র বড়াল-এর প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষসম্প্রতি গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত প্রবালচন্দ্র বড়াল-এর প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০২

শিল্পকলার ক্ষেত্রে ‘প্রিমিটিভ’ কথাটির নানা রকম দ্যোতনা আছে। বাংলায় ‘আদিমতা’ বললে কিছুটা আভাস হয়তো আসে। কিন্তু সবটা নয়। এর ভিতর রহস্যময়তা লুকিয়ে থাকে। থাকতে পারে ‘ফ্যান্টাসি’-র নানা অনুষঙ্গও। ‘গ্রটেক্স’ বা কিমাকার-এর আভাসও আসে কখনও কখনও। কেউ আবার ‘প্রিমিটিভ’-কে ‘নাইভ’-এর সঙ্গেও মেলাতে চান। রুসো আর পিকাসো যখন একই বন্ধনীভুক্ত হয়ে যান, তখন বোঝা যায় সংজ্ঞাকে বড় বেশি শিথিল করে নেওয়া হচ্ছে। আসলে ধ্রুপদী শিল্পের ভিতর যে অমর্ত্যের জন্য অভীপ্সা থাকে, তাকে অতিক্রম করে শিল্প যখন পার্থিবতায় নেমে আসতে চায়, বাস্তবের তথাকথিত অপরিশুদ্ধ পরিমণ্ডল থেকে যখন সত্যকে জাগিয়ে তুলতে চায়, তখনই অনেক সময় আদিমতার আশ্রয় নিতে হয় শিল্পীকে। আধুনিকতাবাদে এই প্রয়োজনটাই খুব গভীর ভাবে অনুভূত হয়েছিল, তখনই আবিষ্কৃত হয়েছিল আদিমতা অনিঃশেষ শক্তির উৎস। আফ্রিকা, মেক্সিকো বা ভারতের উপজাতীয় শিল্পের উৎসগুলি নিয়ে আধুনিকতা তখনই গবেষণা শুরু করেছিল। তার পর পৌঁছেছিল এক ‘আরশিনগরে’, যেখানে রূপ, অরূপ আর কল্পরূপ একাকার হয়ে থাকে সব সময়।

গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল প্রবালচন্দ্র বড়ালের একক প্রদর্শনী। এর শিরোনামও ‘আরশিনগর’। প্রবাল আদিমতার অসংস্কৃত রূপচেতনাকে দিয়েই গড়ে তুলেছেন তাঁর এই কল্পনগরী। ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর চিত্রচর্চা। ভিন্ন পেশায় ছিলেন, যার সঙ্গে শিল্পের কোনও যোগ ছিল না। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার সুযোগও হয়নি কখনও। কিন্তু অন্তরে ছিল সুন্দরের আকুতি। তা দিয়েই লড়াই করে গেছেন। বহু পথ পরিক্রমা করে অবশেষে পৌঁছেছেন আদিমতার নিরন্ত উৎসের কাছে। আদর্শ হিসেবে ঊর্ধ্বলোকে উজ্জ্বল হয়ে ছিল দুই মহান ব্যক্তিত্ব: রবীন্দ্রনাথ আর রামকিঙ্কর। আর ‘প্রিমিটিভ’-এর পথ ধরে তিনি হাঁটবেন, তিনি তো পিকাসোর চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে এসে পড়বেনই। তার পরই শুরু হয় আর এক লড়াই।

Advertisement

এই ধ্যানের আদর্শগুলো ছাড়িয়ে নিজের আদর্শ গড়ে তোলা। প্রবাল সেটা সফল ভাবেই করেছেন। তাঁর আছে অনুশীলনের প্রতি প্রবল টান। যা আত্মশক্তি গড়ে তোলার একমাত্র চাবিকাঠি। তবে প্রবাল যে ভাবে তাঁর জাগরণের প্রতিটি মুহূর্তকে শিল্পান্বিত করে তোলার চেষ্টা করেন, সে দৃষ্টান্ত বিরল। যা তাঁকে সাহায্য করেছে মগ্ন চেতনা থেকে রূপ তুলে আনতে। তিনি যখন আঁকেন মানুষের মুখ, তখন রেখার কৌণিকতায়, ছায়াতপের অভিব্যক্তিবাদী আলো-আঁধারী রহস্যময়তায়, সেই মুখে গভীরের এক বিস্ময়বিধৃত বিপন্নতা ঝংকৃত হতে থাকে। এই বিপন্নতাকেই তিনি অনেক সময় নিয়ে যান ‘ইরটিসিজম’ বা কামোদ্দীপনার দিকে, নর-নারীর আলিঙ্গনে অথবা অভিব্যক্তিতে। তখন বোঝা যায় ‘আরশিনগর’-এ পৌঁছতে গেলে বস্তুনিষ্ঠতার ভেলাটিকে পরিত্যাগ করে কেন মগ্নচেতনায় সম্পৃক্ত আদিমের রহস্যময়তার শরণাপন্ন হতে হয়। অভিব্যক্তির তীব্রতা দিয়ে তিনি মানুষের সত্তার গহন নিভৃতিটিকে তুলে আনতে চান, যেখানে মানুষ তার দুঃখ, যন্ত্রণাকে আত্মস্থ করেই আত্মদীপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

এ পথে চলতে চলতেই তিনি প্রকৃতির কাছে পৌঁছন। যেখানে গাছের ডালে একটি পাখি বসে আছে, নীচে জলের উপর পড়েছে তার ছায়া; দুটি কাক পাশাপাশি বসে বাক্যালাপ করছে; বিড়ালটি বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পার্শ্ববর্তী বৃক্ষের দিকে; অথবা দুটি সূর্যমুখী পরস্পরকে ভালবাসায় আলিঙ্গন করতে চাইছে। ‘গ্রটেক্স’ বা কিমাকারের ভিতর থেকে এই যে প্রকৃতির অনন্ত আনন্দধারাকে তুলে আনা, এটাই একজন শিল্পীর সার্থক সাধনা।

প্রবাল ভাস্কর্যে এসেছেন অল্প কয়েক বছর। দ্বিমাত্রার দীর্ঘ অভিযান তাঁকে অবধারিত ভাবে‌ই ত্রিমাত্রায় নিয়ে এল। তিনি মাটি দিয়েই গড়েন, তার পর সম্ভবত লুপ্ত-মোম পদ্ধতিতেই ব্রোঞ্জে ঢালাই করেন। টেরাকোটাতেও সমাপ্ত করেন কখনও। ত্রিমাত্রিকতায় তীক্ষ্ণতাগুলি আরও স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। ‘গ্রটেক্স’ আরও নিবিড় ভাবে অস্তিত্বের সংকটকে নিভৃত আনন্দে ব্যঞ্জিত করে। আরশিনগরে গহন পাতাল আকাশের দিকে হাত বাড়ায়।

আরও পড়ুন
Advertisement