Book Review

সমসময়ের সঙ্গে যেন এক অবিচ্ছিন্ন সংলাপে রত এই শতবর্ষী কবি

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনার্থ পুস্তক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বইটি। লেখক, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমির এই ধরনের বইয়ে প্রথমাংশে থাকে জীবনী এবং কাব্যপরিচিতি।

Advertisement
অভীক মজুমদার
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৩৪
মগ্ন: লেখার টেবিলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

মগ্ন: লেখার টেবিলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।

সাহিত্য অকাদেমি দীর্ঘকাল যাবৎ ‘ভারতীয় সাহিত্যকার পুস্তকমালা’ সিরিজ়ে, ভারতীয় ভাষার অগ্রগণ্য লেখকদের জীবন ও কৃতিকে পাঠকের দরবারে উপস্থাপন করে চলেছে। এই ক্ষুদ্রায়তন পরিচিতিধর্মী পুস্তকমালার রচয়িতা সাধারণত হন পরবর্তী সাহিত্যবেত্তা বা সৃষ্টিশীল কোনও মান্য লেখক। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনার্থ পুস্তক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বইটি। লেখক, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমির এই ধরনের বইয়ে প্রথমাংশে থাকে জীবনী এবং কাব্যপরিচিতি। এ ছাড়া দ্বিতীয় ভাগে কিছু কবিতা বা কবিতার অনুবাদ।

Advertisement

আলাপন অবশ্য সে পথে এগোননি। জীবনতথ্য ও সাহিত্যকৃতি বিশ্লেষণের সমান্তরে ঘন বুনটে প্রাসঙ্গিক কবিতা বা কবিতার উদ্ধৃতি পাঠকের সামনে পেশ করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় সমস্যা ছিল, অনুমান করি, এ বইয়ের ইংরেজি ভাষা। নীরেন্দ্রনাথের কবিতার যোগ্য অনুবাদ সেখানে প্রায়শই ব্যবহার করতে হবে, পাশাপাশি ব্যবহার করতে হবে তাঁর সাক্ষাৎকার বা অন্যান্য রচনার তর্জমাও। ফলে, ইতিমধ্যে প্রকাশিত তর্জমার সমান্তরে তিনি নিজেও বেশ কিছু ভাষান্তর পরিবেশন করেছেন।

সর্বোপরি, লেখকের স্পষ্ট অবস্থানও এই গ্রন্থে বিধৃত। পোস্ট-কলোনিয়াল এবং নিয়োলিবারাল কালপর্বের নিরিখে তিনি বুঝতে চেয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সমগ্র সৃষ্টিসম্ভার এবং কর্মপরিধির খুঁটিনাটি। ভূমিকাংশের একদম শেষ বাক্যটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন, নীরেন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন পরাধীন দেশে আর আজ স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তি উদ্‌যাপনের মুহূর্তে বইটি প্রকাশ হচ্ছে। এ বইতে তিনি ভারতের আখ্যান আর নীরেন্দ্রনাথের কাহিনিকে ওতপ্রোত নকশায় বুনেছেন। ছিন্নমূল, পুব-বাংলা থেকে এ বাংলায় চলে আসা এই কবি সময়ের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন এক সংলাপে রত ছিলেন।

নীরেন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের নামকরণ থেকে ধার করে বলা চলে, এই বইয়ের নাম হতে পারত ‘কবির ঘরদুয়ার আর যাবতীয় ভালবাসাবাসি’। আলাপন সযত্নে এই কবির যাপন এবং রচনাগুলির আনাচকানাচ নবব্যাখ্যায় উন্মোচন করেছেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪-২০১৮) বিবিধ পর্যায়ে নানান সারস্বত ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আজীবন। চল্লিশ বছর তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন গ্রন্থকার। ফলে, নীরেন্দ্রনাথের পুরো সৃষ্টিভুবন পেশা ব্যক্তিচর্যা এবং দৃষ্টিকোণকে সামগ্রিকতায় মিলিয়ে সমান্তরে বুঝতে চেয়েছেন, এবং পাঠকের দরবারে পেশ করতে চেয়েছেন লেখক। সেই বিশ্লেষণ এবং বিবরণের বাঁকে বাঁকে চমকপ্রদ বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এই গ্রন্থের বড় প্রাপ্তি। এক দিকে নীরেন্দ্রনাথের বীক্ষণ এবং প্রয়োগ, অন্য দিকে ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতে কম্পমান দেশদুনিয়া— এই দুইয়ের সহযোগে ও দ্বন্দ্বে অবয়ব পাচ্ছে গদ্যপদ্যের প্রবাহ। আলাপন কালক্রমিক ঘটনাবলিকে সাজিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হওয়ার চেষ্টা করেননি, বরং অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল জটিল ঘাত-প্রতিঘাতের হিসাব কষার চেষ্টা করেছেন।

মেকারস অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়

১০০.০০

সাহিত্য অকাদেমি

তাঁর বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ চমকপ্রদ। সামাজিক আখ্যান নির্মাণের যে সাংবাদিক ঐতিহ্য বাংলায় বর্তমান ছিল মঙ্গলকাব্যে বা কাহিনিকাব্যে, তারই ভিন্নতর নন্দন বনিয়াদ হিসাবে কার্যকর ছিল নীরেন্দ্রনাথের কাব্য-উদ্ভাসে। ১৯৪৩ সাল থেকে নীরেন্দ্রনাথ বাংলা সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। শিশুপত্রিকা আনন্দমেলা সম্পাদনাও করেছেন। আলাপন এই সূত্রে মনে করিয়ে দিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথের ছদ্মনাম ছিল ‘কবিকঙ্কণ’। চণ্ডীমঙ্গলের সুবিদিত কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর উপাধি থেকে শব্দবন্ধটি গ্রহণ করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় রবিবারের স্তম্ভে ‘কবিতার ক্লাস’ লিখেছিলেন কবি। ছন্দের আলোচনা। এই ভাবে ‘পোস্ট-কলোনিয়াল গণতন্ত্র’ তার উদ্বেগ নিয়ে দেখা দিচ্ছিল তৎকালীন সমাজে— সেই সূত্রে বাংলা সাংবাদিকতায় এবং বাংলা কবিতায়। চকিতে মনে পড়ে ‘কলকাতার যীশু’ কিংবা ‘অমলকান্তি’ কিংবা পরবর্তী কালের ‘গুরু যা বলেন’ অথবা আরও বহু সমধর্মী কবিতার কথা। এই বাস্তবতার অসহনীয় চাপেই নীরেন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় সত্তরের রক্তক্ষয়ী কালবেলা স্পর্শ করতে অনুষঙ্গ খোঁজেন মহাভারতের মুষলপর্ব থেকে ম্যাকবেথ-এ।

কত বিচিত্র সারস্বতকর্মে ব্যাপৃত ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ, সেটি বোঝা যায় দীর্ঘ গ্রন্থপঞ্জির দিকে তাকালে। কাব্যগ্রন্থ বা কাব্যসংগ্রহ তো বটেই, কবিতা বিষয়ক আলোচনা, রিপোর্টাজ়, গোয়েন্দা কাহিনি, ছড়াকবিতা, শিশু উপন্যাস, অনুবাদ, আত্মজীবনী প্রভৃতি। বাংলা বানান সংস্কারেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বেশ কিছু সম্পাদিত গ্রন্থও তিনি প্রকাশ করেছেন। তার রচনাধারায় আবহ হিসাবে বহমান ছিল কালস্রোত। ইতিহাসের বিন্দু-প্রতিবিন্দু। কোনও শিবিরে যোগ না দিয়েও নীরেন্দ্রনাথ নানা ভাবে সেই কালচিহ্নিত স্ফুলিঙ্গগুলি রচনাপটে ধারণ করতে চেয়েছিলেন।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’ কবিতা প্রসঙ্গে (একই নামের কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত ১৯৮৯ সালে, কিন্তু গ্রন্থপঞ্জিতে অনুপস্থিত।) আলাপন মনে করিয়ে দেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক লিখিত উদ্‌যাপিত প্রবন্ধ ‘ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?’ প্রবন্ধে বর্ণিত আত্মহত্যাকারী মেয়েটির সূত্র। নিম্নবর্গ তথা নারী কণ্ঠস্বর এবং শ্রুতি-অশ্রুতির রাজনীতি। মধ্যবিত্ত পরিসরে কী ভাবে এক পাগলিনী উৎক্রম বা সাবভার্শনের প্রতীক হয়ে ওঠেন— নীরেন্দ্রনাথের কবিতার সমান্তরে সে দিকে আমাদের নজর টানেন গ্রন্থকার।

এক দিকে এই গ্রন্থনা, আর অন্য দিকে গবেষণার গভীর শ্রমচিহ্ন বইটিতে স্পষ্ট। শেষের টীকাভাষ্য থেকে জানতে পারি, কত ধরনের দলিল-দস্তাবেজ, পত্রিকা বা গ্রন্থের পৃষ্ঠা থেকে তথ্য এবং অবলোকন নিষ্কাশন করেছেন লেখক। তার সঙ্গে চমৎকার কিছু তর্জমাও পাঠকের প্রাপ্তি। আমার ব্যক্তিগত ভাবে খুবই পছন্দ হয়েছে ‘কবি’-র অনুবাদ।

কবি, লেখক ও ভাষাচিন্তক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শতবর্ষে এই গ্রন্থটির প্রকাশ তাঁর বহুমুখী কর্মময়তার প্রতি সাহিত্য অকাদেমির সশ্রদ্ধ বিনতি। সেই প্রণতিতে বাংলা কবিতার অসংখ্য সাধারণ পাঠকের উপস্থিতিও মিশে থাকুক।

আরও পড়ুন
Advertisement