জীবনানন্দ দাস।
ক্রিক রো দিয়ে ফেরার সময় এক ফৌজি অফিসার জীবনানন্দের বুকে বন্দুকের নল লাগিয়ে তাঁকে ট্রাকে তোলেন। বলেন, “আই থিঙ্ক ইউ আর দ্য রিংলিডার অব দিস এরিয়া। জাস্ট গেট অন।” ১৯৪৬-এর শেষ দিক। সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছিল প্রেক্ষাপট। থানায় বেঞ্চিতে অপেক্ষা করতে থাকেন নিশ্চুপ কবি। এক অল্পবয়সি মুসলমান পুলিশকর্তা এসে তাঁকে প্রণাম করেন। তিনিই ওসি। বি এম কলেজ, বরিশালে এই অফিসারই ছিলেন জীবনানন্দের ছাত্র! এই ব্যক্তিই সসম্মানে রাষ্ট্রের হাতে ধৃত এবং ‘ডিটেনড’ কবিকে ট্রামে তুলে বাড়ি পাঠান। ‘মানুষ জীবনানন্দ’ শীর্ষক রচনায় ১৩৭৮ সনে এ কথা জানিয়েছেন স্বয়ং লাবণ্য দাশ! মনে পড়ল, জীবনানন্দই একদা লিখেছিলেন, ক্ষমতা আর কবির সম্পর্ক বিষয়ে— ‘কোনো এক কবি বসে আছে’..., ‘কারাগারে ক্যাম্পে অন্ধকারে’। জীবনানন্দ প্রসঙ্গে এমন নানা কথা পড়ার সুযোগ হল।
জীবনানন্দ আর তাঁর সৃষ্টিজগৎ, তাঁর অন্তরঙ্গ মুখচ্ছবি, তাঁর চিঠিপত্র, তাঁর মুহূর্তকথা— এ সব কেন্দ্রে রেখে প্রকাশিত হয়েছে দু’খণ্ডে অনুষ্টুপের জীবনানন্দ। সম্পাদনা করেছেন দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিতা চক্রবর্তী এবং অনিল আচার্য। বৃহদাকার এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে সে-কাল থেকে এ-কালের বিভিন্ন মান্য সাহিত্যভাবুকের জীবনানন্দ-আস্বাদন। অনুমান করি, জীবনানন্দের ১২৫তম জন্মবর্ষের কথা মাথায় রেখেই এই সম্ভার। বনিয়াদ হিসাবে কাজ করেছে ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষের অনুষ্টুপ পত্রিকার দু’টি সংখ্যা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কিছু নতুন লেখা। মুদ্রিত হয়েছে জীবনানন্দের বেশ কিছু প্রবন্ধও। সযত্নে সঙ্কলিত খণ্ড দু’টি বিবিধ অন্তর্দৃষ্টিতে ভাস্বর। যে কবি ‘উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে’ দেখেছিলেন এক দিকে ‘নরকের আগুনের মতো অহরহ রক্তপাত’ আর ‘প্রভাতের গোধূলির রক্তছটা-রঞ্জিত ভাঁড়’, তিনি পুনর্নব। প্রতি মুহূর্তে তিনি সমকালীন, আজকেও। বিবিধ পরিমাপযন্ত্র, অবস্থান এবং দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে স্পর্শ করার অহরহ এই প্রয়াস যেমন জরুরি, তেমন মনে হয়, বিশ্লেষণী এমন রচনাপ্রবাহের ধারা বহমান থাকলেও তিনি ক্রমাগত নতুন নতুন আয়তন এবং অবয়বে প্রকট হয়ে চলবেন। শত মাত্রিকতা, রহস্য আর মহাপার্থিবতায় তাঁর চলমান অনুভূতিগুলি বজ্রবিদ্যুতে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।
অনুষ্টুপের জীবনানন্দ ১, ২
সম্পা: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিতা চক্রবর্তী, অনিল আচার্য
১১০০.০০ (দুই খণ্ড একত্রে)
অনুষ্টুপ
প্রবন্ধগুলি তো আছেই, শেষে জীবনানন্দের বিস্তারিত একটি জীবনপঞ্জি রচনা করেছেন প্রভাতকুমার দাস। সেখানেও আছে পাঠককে উস্কে দেওয়ার নানা উপাদান। রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ জানিয়েছিলেন, “...মানুষের মনে নানা সময় নানা রকম moods খেলা করে। ...Moods-এর প্রক্রিয়ায় নানার ভেতর এই যে সুরের আগুন জ্বলে ওঠে...। সকল বৈচিত্র্যের মতো সুরবৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভেতর।... বীঠোফেনের কোনো কোনো symphony বা sonata-র ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে,...।” এই বাক্যগুলি থেকে মুড আর সঙ্গীতের প্রসঙ্গ দু’টিকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চাইব। জীবনানন্দ সম্ভবত তাঁর সমস্ত সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় এই বিমূর্ত সঙ্গীত আর অনুভূতিময় মেজাজকেই ধরতে চেয়েছেন। এমনকি গদ্যরচনাগুলিতেও তিনি ঘটনা থেকে সরে আসতে চান সঙ্কেতে, কবিতার মতোই তাকে ঘটনাবিহীন ইশারায় পরিবেশন করতে চান। কবিতার নাম দেন তিনি ‘অবসরের গান’, ‘কোরাস’, ‘বিভিন্ন কোরাস’, ‘রাত্রির কোরাস’, ‘নব হরিতের গান’— পাশাপাশি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে ১৯৪৪ সালে একটি চিঠিতে জানান ‘আলোকস্তম্ভ’ কবিতার অনুবাদ তিনি নিজেই করেছেন, ‘Antiphony’। এই যে সঙ্গীতের বিমূর্ততা দিয়ে এক বিশেষ মুড এবং মনোকণিকাকে ছোঁয়ার চেষ্টা, এই তাঁর নির্জন স্বাক্ষর। এই সঙ্কলনের অনেক লেখাতেই সেই ইশারাকে নিয়ে বিমূর্ততাটুকু অনুভব করার আনন্দ আছে। কখনও কখনও মতাদর্শ আর নিরেট অর্থশৃঙ্খলে সাতপাকে বাঁধার প্রয়াসও তৈরি হয়েছে। বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য সঙ্গত ভাবেই বুঝিয়ে বলেন, “... তাঁর কাব্যবিচারের সমস্ত ছকবাঁধা পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে।... মহৎ কবি কখনোই সীমাবদ্ধ নন।” কিন্তু চমৎকার বিশ্লেষণ করতে করতে হঠাৎ শেষ পর্বে বলে বসেন, “‘বোধ’ বা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার লেখকের সমাজপরিবর্তনের এই দৃঢ় প্রত্যয়ের উৎসটি জীবনীকারদের আন্তরিক সন্ধানের বিষয়।” সেই এক যান্ত্রিকতা।
অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন সুর নির্মাণের কাঠামোটিকে— “ধ্বনির আবহ, বিশেষ করে ‘আ’ ও ‘এ’ ধ্বনির আবহসৃষ্টি জীবনানন্দের প্রিয়, তাঁর নিজস্ব ছন্দস্পন্দের বড়ো উপাদান।... এই পঙ্ক্তিগুলির যে সংগীত তা স্বরবিন্যাসের ওপর নির্ভরশীল, ‘আ’ ও ‘এ’ ধ্বনির প্রবাহে; আর সেই সঙ্গে ক্রিয়াপদের পৌনঃপুনিকতায়।... সংগীত সৃষ্টির এমন নিপুণ পরিচয়...।” শঙ্খ ঘোষ মনে করান ‘অন্তঃসার’ শব্দটিকে, উল্লেখ করেন, সূক্ষ্ম সাঙ্গীতিকতার গভীর তলদেশ। সেই বিমূর্ততাকে স্বীকৃতি দিয়ে তপোধীর ভট্টাচার্য স্পষ্টতই জানাচ্ছেন, “জীবনানন্দ জানতেন, চৈতন্য যখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত— নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করে যাওয়াই যুদ্ধের অভিজ্ঞান। প্রাতিষ্ঠানিকতায় ক্লিষ্ট জগতে বিভিন্ন প্রতিবেদন যখন আধিপত্যবাদের ধ্বজাদণ্ড বয়ে চলেছে, কবির বিনির্মাণ তাদের অচল অনড় শান্তিকে বিক্ষুব্ধ ও আলোড়িত করে...।” রঞ্জিত সিংহ, অশ্রুকুমার সিকদার, অরুণ ভট্টাচার্য, পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, পিনাকেশ সরকার থেকে সূচনাকথায় সুমিতা চক্রবর্তী জীবনানন্দের নানা পাঠ এবং সম্ভাবনার কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় খণ্ডে গুরুত্ব পেয়েছে জীবনানন্দের গল্প, উপন্যাস, অর্থাৎ আখ্যানসমূহ। তাদের আয়তনবান কৌণিকতাগুলিকে গভীর মনোযোগে ধরতে চেয়েছেন আলোচকবৃন্দ। মনে রাখা ভাল, সমগ্র কথাসাহিত্য অংশ জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কবিতাভূখণ্ডেরই দোসর— বিচ্ছিন্ন নয়। টেকনিকেও দেখি যেন ‘প্রতীক যানের’ নিরবচ্ছিন্ন চলাচল। সাম্প্রতিক এক হিসাব অনুযায়ী, মাত্র ১৬২টি গ্রন্থভুক্ত কবিতা থাকলেও তিনি লিখেছেন প্রায় তিন হাজার কবিতা, ১৯টি উপন্যাস আর ১২৭টি গল্প। আশ্চর্য কথা হল, এ সবই যেন অন্তর্লীন সম্পর্কযোগে দীপ্ত। এই পাল্টা নন্দন, বিকল্প সৃষ্টিতরঙ্গ, নিঃশব্দে তিলে তিলে গড়ে গেলেন অপমানিত, অবহেলিত কবি। তাঁরও আকাশ, আজ মনে হয়, ইস্পাতের মতো।
পূর্বসূরিহীন এই জীবনানন্দকেই শিরাধমনী দিয়ে ধরতে চেয়েছেন রবিশংকর বল, অতীন্দ্রিয় পাঠক, রবিন পাল, মণীন্দ্র গুপ্ত। একত্রিত অবলোকনগুলি মনের উপর ছাপ ফেলে যায়। নিসর্গ, মৃত্যুবোধ, শূন্যতা, একাকিত্ব আর বিপদের জীবনানন্দ বনাম সমাজ ইতিহাস মানবমুক্তি মহাপৃথিবী মহাজিজ্ঞাসার জীবনানন্দ, এমন খোপকাটা বনামবদ্ধতা ভেঙে আরও বহু জীবনানন্দ যেন সমন্বয়ে-পরিপূরণে আলোচনাগুলি থেকে আবির্ভূত হন। ২০২৩ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে নবকলেবরে, ফলে মনে হয়, ‘দিনলিপি’ নিয়ে একটি লেখা থাকতে পারত। থাকতে পারত একটি লেখা ‘খসড়া, পাঠান্তর’ নিয়েও। লক্ষ করেছি, সঙ্কলনে সমকালীন জীবনানন্দ-চর্চাকারীদের উপস্থিতি তুলনায় অল্প। এক দিকে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম মিত্র, আর অন্য দিকে, কবির চোখে জীবনানন্দ পাঠে জয় গোস্বামী এবং শৈলেশ্বর ঘোষকে আমার যোগ করতে ইচ্ছা হয়েছে পাঠক হিসাবে।
ভূমেন্দ্র গুহকে জীবনানন্দ বলেছিলেন, এই গ্রন্থেই জানা গেল, “আমি তো এককালে গানও লিখেছিলাম, জানো?” প্রায় চোদ্দোটি গানের সন্ধান সমগ্র কাব্যপ্রবাহে। তার একটি থেকে: “এই কি জীবন? জেগে থাকা?/ অমৃতেরই হাওয়া?/ জ্যোতিষ্কদের ঘুম ভাঙানো?/ নারীর দেখা পাওয়া?” নিশ্চয়তার বিলাস নয়, ক্ষতজর্জর প্রশ্নমালার জীবনানন্দ আমাদের সহচর, অগ্রপথিক।