প্রতীকী চিত্র।
অতীত এক অদ্ভুত জায়গা। আমরা মাঝেমাঝেই টুক করে সেখানে চলে যাই, কিছু ক্ষণ কাটাই, ফিরে আসি। তাকে বলি নস্ট্যালজিয়া। কিংবা কক্ষনও যেতে চাই না, তখন তাকে বলি যক্ষপুরী, ট্রমা। এই সবই— আমরা যারা এখনও ‘ক্লিনিক্যালি’ সুস্থ, অতীত আর বর্তমানের ভেদরেখাটা যাদের কাছে স্পষ্ট, স্মৃতিশক্তি যাদের এখনও অটুট, তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই সীমারেখা যাঁদের ক্ষেত্রে আবছা হয়ে আসছে, যাঁরা বর্তমানে থেকেও ‘এখন’ আর ‘এখানে’-দের বুঝতে পারছেন না, তাঁরা কী করবেন? অ্যালঝাইমার’স বা ডিমেনশিয়া, কিংবা যে কোনও স্মৃতিভ্রংশে ভুগছেন যাঁরা, এই ক্রমশ-ধূসর, অসহ্য বর্তমান থেকে তাঁদের নিস্তারের উপায় কী?
সময়ের— অতীতের— কোনও গ্যাস মাস্ক বা বম্ব শেল্টার বানায়নি কেউ আজ পর্যন্ত। যাঁরা বর্তমান হারিয়ে কাছে-দূরের অতীতে বাঁচছেন, তাঁদের নেই কোনও আশ্রয়। এই মানুষগুলোর জন্যই গস্তিন, এই বই তথা উপন্যাসের নায়ক বানিয়েছে ‘টাইম শেল্টার’। চার তলা মস্ত বাড়ি, তার এক-একটা তলা এক-এক ধরনের, এক-একটা দশকের অতীত। একেবারে নীচতলাটা চল্লিশের দশকের, তার পর পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশক উপরের তিনটে তলায়। ছাদের ঘরে আশি আর নব্বইকে চেপেচুপে ঢোকানো আপাতত, অচিরেই তাদের জন্য আরও জায়গা লাগবে।
টাইম শেল্টার
গেয়র্গি গোসপোদিনভ,
অনুবাদ: অ্যাঞ্জেলা রোডেল
৬৯৯.০০
ওয়েডেনফেল্ড অ্যান্ড নিকলসন, হ্যাশেট
গেয়র্গি গোসপোদিনভের এই উপন্যাসের সূত্রে বহু দিন পর বুলগেরিয়া আবার সারা বিশ্বের চর্চায়, ইন্টারন্যাশনাল বুকার জিতে। স্তোইচকভের দেশকে কে-ই বা আর মনে রেখেছিল ইদানীং! ‘মনে রাখা’, স্মৃতি, অতীত-এর মতো বহুচর্চিত ‘ট্রোপ’কে নিয়ে লোফালুফি করেছেন গেয়র্গি। তার মূল চরিত্র গস্তিন সময়-অস্বীকার করা এক মানুষ, সে এই ১৯৩৯-এ আছে তো এই ১৯৮৬-তে, এক্ষুনি ২০২০-তে তো তক্ষুনি ১৯৬৮-তে। লেখক তথা ন্যারেটর যেন এক ‘ফ্ল্যানর’ (flaneur), সময়কে দেখে যান কেবল, এটাই তাঁর কাজ। দেখে যান, কী ভাবে গস্তিনের টাইম শেল্টার প্রথমে জ়ুরিখে, তার পর বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক ছাপিয়ে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে আস্তে আস্তে। স্মৃতি-হারানো, অতীতে বাঁচতে-চাওয়া মানুষে ভরে যায় বাড়িগুলো, এক-একটা দেশের সরকার যোগাযোগ করতে থাকে— তাদের মাটিতেও চাই ওই আশ্রয়। কেমন হয়, যদি বাড়ি ছাড়িয়ে পাড়া, পাড়া ছাপিয়ে শহর, এমনকি একটা গোটা দেশই যদি নিজেদের পছন্দের এক অতীতকে, একটা বিশেষ বছরেই অনন্তকাল থেকে যেতে চায়? কী হয়,যদি অগণিত ‘সুস্থ’ মানুষ বর্তমানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সজ্ঞানে অতীতে বাঁচতে চায়?
এই জায়গাতে এসে উপন্যাসটা একই সঙ্গে একটা মহাকাব্য আর দুঃস্বপ্ন, দুই-ই হয়ে যায়। অতীত যে শুধু পরম আশা নয়, চরম এক আশঙ্কাও, স্রেফ পুরনো ক্ষতের মলম নয়, নতুন আঘাতের অস্ত্রও— আমরা কি ভেবে দেখি তা? স্মৃতি নিয়ে মিলান কুন্দেরার যে বাণীপ্রতিম উদ্ধৃতি তাকে একাধারে গ্রহণ ও বর্জন করে এ বই,গার্সিয়া মার্কেসের সময় নিয়ে পিংপংকে বসিয়ে দেয় মানুষের যাপিত ইতিহাসের রাজনীতিতে, রুশদিরসূক্ষ্ম ফাজলামির প্রকরণ পেরিয়ে পৌঁছতে চায় হোসে সারামাগো-র কলমের ‘ভায়োলেন্স’-এ। হ্যাঁ, ভায়োলেন্স। উত্তমকুমার-স্নিগ্ধ ষাটের দশক বা মারাদোনাময় ছিয়াশিতে বাঁচতে চাওয়া খুব আনন্দের, কিন্তু তোমার দেশ যদি বেছে নেয় ১৯৭৫, ১৯৯২ বা ২০০২-এর ‘টাইম শেল্টার’— কী হবে তখন?
নজরে
গণতন্ত্র কখন সার্থক বলে মনে করা যায়? যখন দেশের দরিদ্র, অসাক্ষর, পশ্চাৎপদ মানুষও ভোট দিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন? না কি যখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের দায়দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারে? প্রথম অর্থে ভারতীয় গণতন্ত্রের সাফল্য চোখ-ধাঁধানো। দ্বিতীয় অর্থে ভারতের সঙ্কট জমাট অন্ধকারের মতো। আর তার সঙ্গে যদি যোগ হয় সমাজ ও রাজনীতির নৈতিক স্খলন, তবে তো কথাই নেই। এই বই নতুন করে ফিরে ভাবাবে। সম্পাদকের কাছে কৃতজ্ঞতা, একটি সঙ্কলনের মধ্যে এতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সমাবেশের জন্য। তাঁকে ধন্যবাদ, সুচিন্তিত সুলিখিত ভূমিকা-প্রবন্ধের জন্যও।
ক্রাইসিস অব লিবারাল ডেলিবারেশন: ফাসেটস অব ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাসিসম্পা: মানস রায়
১৯৯৫.০০
প্রাইমাস বুকস
বইয়ের পাঁচটি ভাগ, হিস্টরিক্যাল লেগ্যাসি, ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাসি: ডিস্টার্বিং ট্রেন্ডস, পলিটিক্যাল ইকনমি, পপুলেশন অ্যান্ড প্রসেস অব লিভিং, রিজিয়নাল কনটেস্টেশনস। প্রথম ভাগে গান্ধী নিয়ে ত্রিদীপ সুহ্রুদ, রবীন্দ্রনাথের উপর প্রদীপকুমার দত্ত, নেহরু বিষয়ে বেঞ্জামিন জ়াকারিয়া, পেরিয়ার নিয়ে ভেঙ্কটচলপটি, আম্বেডকর নিয়ে সৌম্যব্রত চক্রবর্তীর লেখা— উৎসাহী পাঠকের অবশ্যপাঠ্য। দ্বিতীয় ভাগে প্রদীপকুমার বসু, অনুপ ধর ও টি এন কৃষ্ণমূর্তির প্রবন্ধ, তৃতীয় ভাগে অরুণ কুমার, সঞ্জয় চক্রবর্তী, প্রিয়া সঙ্গমেশ্বরন, সেঁজুতি দাশগুপ্ত, চতুর্থে লীলা বিসারিয়া, রবিচন্দ্রন বাথরান, জঁ দ্রেজ়, এবং পঞ্চমে নবনীতা চাডা বেহরা, প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীরকুমার দাশ, অঞ্জন চক্রবর্তী, কুমার রাণার প্রবন্ধ। পশ্চিমবঙ্গের বাম ও তৃণমূল যুগে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণের কথা প্রদীপকুমার বসু, অঞ্জন চক্রবর্তী ও কুমার রাণার লেখায়।
তথ্যসমৃদ্ধ, তত্ত্বালোকিত লেখাগুলি বহু নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। তবু দু’টি খুঁতখুঁতানি। এক, ‘লিবারাল’ ঐতিহ্য বলতে ঠিক কোন মতাদর্শ ভারতে দেখা গেল, কী তার দুর্বলতা, সেটা জোর দিয়ে না বললে গণতন্ত্রের এই কাহিনি হয়তো অসম্পূর্ণ থাকে। দুই, একটি দোষে একাধিক লেখা দুষ্ট— যাকে বলা হয় ‘টেলিয়োলজি’ বা ‘পশ্চাৎদৃষ্টি’। কালকের ঘটনাও আজকে ইতিহাস, কিন্তু কালকের ঘটনা থেকে আজকের অনুধাবনকে সজোরে সরিয়ে দিলে তবেই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের তাৎপর্য স্পষ্টতর হয় না কি?