Review

ইতিহাস-চলনের স্পষ্ট ছবি

গঙ্গার পূর্ব দিকে অবস্থিত মধ্যযুগীয় গৌড় শহর সমকালীন ভারতে প্রথম সারির বড় শহরের অন্যতম। প্রাক্‌-সুলতানি আমল থেকেই গৌড়ের রাজধানীর নগরী হিসাবে প্রাচীন পরম্পরা ছিল।

Advertisement
অসীমকুমার সরকার
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৭:২৪
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

আধুনিক ভারতে বড় শহরগুলির, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শহরগুলির নগরায়ণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা অনেকটাই হয়েছে। কিন্তু বাংলার ছোট ছোট শহরগুলির, প্রদেশের অর্থনৈতিক ও সামায়িক রূপান্তরে যাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল, তাদের নিয়ে গবেষণা খুব এগোয়নি। আলোচ্য বইটিতে লেখক বাংলার দু’টি শহর, পুরাতন মালদহ ও ইংরেজবাজারের নগরায়ণ প্রক্রিয়া নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশিত বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের চালচিত্রে প্রথমে মোগল প্রশাসনিক কাঠামো ও পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় বণিক কোম্পানি ও ব্রিটিশ প্রশাসনিক নীতির অভিঘাতে এই দুই শহরের রূপান্তর দেখিয়েছেন তিনি।

Advertisement

গঙ্গার পূর্ব দিকে অবস্থিত মধ্যযুগীয় গৌড় শহর সমকালীন ভারতে প্রথম সারির বড় শহরের অন্যতম। প্রাক্‌-সুলতানি আমল থেকেই গৌড়ের রাজধানীর নগরী হিসাবে প্রাচীন পরম্পরা ছিল। মামুদশাহি সুলতানদের আমলে গৌড় ছিল শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। ষোড়শ শতকের বিদেশি পর্যটকরা গৌড়ের জনাকীর্ণ প্রশস্ত রাস্তা, বড় দোকানপাট ও বিদেশি বণিকের উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস ও অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অনীশ দেখিয়েছেন, ষোড়শ শতকের শেষভাগ থেকে গৌড়ের অবক্ষয়ের পর কী ভাবে মালদহের গুরুত্ব বেড়ে চলছিল। এক দিকে গঙ্গা নদীর মাধ্যমে বিহার-উত্তর ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ, অন্য দিকে হুগলি ও বঙ্গোপাসাগরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে মালদহের গুরুত্বের মূল কারণ। তপন রায়চৌধুরী, ইরফান হাবিব প্রমুখের গবেষণায় মোগল আমলে রেশম ও সুতিবস্ত্র শিল্পকেন্দ্র হিসাবে মালদহের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত। লাভজনক বাণিজ্যের জন্য মালদহে আসতেন হিন্দুস্থানি ও মধ্য এশিয়ার বণিক, সঙ্গে পারস্যদেশীয়, আর্মেনীয় ও কিছু পর্তুগিজ় বণিক। পরবর্তী সময়ে ওলন্দাজ (১৬৭০) ও ইংরেজ বণিকদের কুঠি (১৬৮০) গড়ে ওঠে মালদহে।

উৎকৃষ্ট মানের সুতি ও রেশমবস্ত্র এবং সুতো ও রেশমের মিশেলে তৈরি এক বিশেষ ধরনের বস্ত্রের জন্য ইউরোপীয় বণিকদের নজরে এসেছিল মালদহ। অনীশ দেখিয়েছেন, কী ভাবে কুঠি স্থাপনের সময় থেকেই সুবাদার শায়েস্তা খানের রাজস্ব বিভাগীয় কর্মচারীদের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ শুরু হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ওলন্দাজ ও ফরাসি বণিকদের প্রতিযোগিতা। এ কারণে কোম্পানি তাদের বাণিজ্যকুঠি দুই মাইল দূরত্বে মহানন্দা নদীর অপর প্রান্তে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুবাদারি করের চাপে অতিষ্ঠ পুরাতন মালদহের অনেক তাঁতি ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত নতুন কুঠির পাশে এসে বসবাস শুরু করে। যারা নতুন ভাবে ইংরেজ কুঠির পাশে এসে বসবাস শুরু করল, তাদের মধ্যে একটি শ্রেণি ছিল কৃষক ও তাঁতি। আর ছিল দালাল, যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কোম্পানির জন্য কাঁচামাল ও রেশম খরিদ করত। কুঠির পাশেই বসল হাট। স্থানীয় মানুষেরা একে বলত ‘নয়া হাট’। এই হাটে দূরদূরান্তের তাঁতি ও চাষিরা তাদের কাঁচামাল ও রেশম বিক্রি করতে শুরু করল। এ ভাবে নতুন বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই এই কুঠিকে কেন্দ্র করে এক নতুন ধরনের জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তা এক ব্যবসায়িক ঔপনিবেশিক শহরের রূপ নিতে শুরু করে। ইংরেজ বাণিজ্য কুঠিকে কেন্দ্র করে এই জনবসতি গড়ে ওঠায় পরবর্তী সময়ে তা ইংরেজবাজার নামে পরিচিত হয়। পুরাতন মালদহের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং ইংরেজ দলিল-দস্তাবেজে মালদহ ও ইংরেজবাজার সমার্থক হয়ে ওঠে।

টুইন সিটিজ় অব মালদহ: প্রি-কলোনিয়াল অ্যান্ড কলোনিয়াল পার্সপেক্টিভস

অনীশ মুখোপাধ্যায়

৮৯৫.০০

কোডেক্স

অনীশ বলছেন, বয়নশিল্পকেন্দ্র ছিল ইংরেজবাজার সংলগ্ন গ্রামগুলো। আর শহরে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্যদ্রব্য মজুতকরণ, ব্যাঙ্কিং ও অন্য অর্থনৈতিক কাজকর্ম। বণিক, মহাজন, গোমস্তাদের নিয়ে গড়ে উঠল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আর ছিল কারিগর, নির্মাণশ্রমিক ও অদক্ষ শ্রমিকের দল।

রাজনৈতিক রূপান্তর ও পালাবদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইংরেজবাজারের নগরায়ণ দ্রুত এগিয়ে চলল। ১৭৭০ সালে গড়ে উঠল মালদহ রেসিডেন্সি। অনীশ বলছেন, আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকেই ইংরেজবাজার একটি উৎপাদনকেন্দ্রিক শহর হিসাবে গড়ে উঠতে থাকে। তিনটি রফতানিমুখী শিল্প ছিল রেশম ও সুতিবস্ত্র বয়ন, চিনি ও নীল। ১৮১০ নাগাদ বুকানন হ্যামিল্টন দেখছেন, রেশম ও সুতিবস্ত্র বয়ন ইউরোপীয় ও দেশীয় কেন্দ্রে সমান ভাবেই চলছে। পুরাতন মালদহ তখন পতনের পথে, আর ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে ইংরেজবাজারের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। শহর ও এর পশ্চাদ্‌ভূমির প্রধান পণ্য ছিল কাঁচা রেশম ও শিল্পজাত রেশম। কোম্পানির মালদহ থেকে রফতানিকৃত পণ্য তালিকায় প্রধান ছিল চিনিও। এ ছাড়াও ছিল নীল উৎপাদন কেন্দ্র। ১৮৫০-এর দশকে মালদহে প্রায় ২৯টি নীলকুঠি ছিল। অনীশের লেখায় মালদহের জমিদারি ব্যবস্থা নিয়েও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা রয়েছে। জমিদারি ব্যবস্থা ছিল কৃষি রাজস্ব আদায়ের ভিত্তি। শহুরে এলিট সম্প্রদায়ের কথা বলতে গিয়ে লেখক দেখিয়েছেন তা গঠিত ছিল বণিক-ব্যবসায়ী, ভূম্যধিকারী ও অন্যান্য অভিজাত শ্রেণি নিয়ে।

পৃথক জেলা হিসাবে মালদহের আত্মপ্রকাশ ১৮১৩-তে, যখন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পূর্ণিয়া, রাজশাহী ও দিনাজপুরের কিছু থানা ইংরেজবাজারের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টরের অধীনে আনা হয়। ১৮৩২-এ জেলায় স্বতন্ত্র ট্রেজারি স্থাপিত হয়, তখন থেকেই মালদহ জেলার স্বাধীন পথ চলার সূচনা। লেখকের আলোচনায় উঠে এসেছে মালদহ জেলার নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্র। পুরাতন মালদহ ও ইংরেজবাজার পুরসভা গঠিত হয় ১৮৬৯-এ। সদস্যরা ছিলেন মনোনীত ও কিছু নির্বাচিত। ক্রমে শিক্ষিত এলিট সম্প্রদায়কে স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ধ্রুপদী অর্থে নগরায়ণের উপর অনীশের গবেষণা নয়। লেখকের কৃতিত্ব এখানেই, প্রাক্‌-আধুনিক সময় থেকে ১৯১০ পর্যন্ত ব্রিটেন, ভারত ও মালদহের মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজের উপর নির্ভর করে মালদহের দু’টি শহরের আখ্যান তুলে ধরেছেন। মুদ্রণপ্রমাদ ও তথ্যের পুনরাবৃত্তি আছে, আশা করা যায় পরবর্তী সংস্করণ হবে নির্ভুল।

আরও পড়ুন
Advertisement