কুড়িটা ছবিতে কি চেনা যায়

আবাল্য খেলাধুলার সুবাদে নানা খেলার কোচ কিংবা ট্রেনার দেখে বড় হয়েছেন সৌমিত্র। তবু যখন ‘কোনি’তে ক্ষিদ্দার চরিত্রটি পেলেন, নিয়ম করে উত্তর আর মধ্য কলকাতার সাঁতারের ক্লাবে যেতেন।

Advertisement
শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০২
ক্ষিদ্দা। ‘কোনি’ চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুকুমার রায়

ক্ষিদ্দা। ‘কোনি’ চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুকুমার রায়

আবাল্য খেলাধুলার সুবাদে নানা খেলার কোচ কিংবা ট্রেনার দেখে বড় হয়েছেন সৌমিত্র। তবু যখন ‘কোনি’তে ক্ষিদ্দার চরিত্রটি পেলেন, নিয়ম করে উত্তর আর মধ্য কলকাতার সাঁতারের ক্লাবে যেতেন। দেখতেন সাঁতারুদের কী ভাবে শেখাচ্ছেন কোচরা, তাঁরা কী ভাবে হাঁটেন, কথা বলেন, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের বোঝাপড়ার ধরনটাই বা কী— সবই খুঁটিয়ে খেয়াল করতেন। কোনও নির্দিষ্ট ট্রেনার নন, বিভিন্ন জনকে পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়ে এক জন সর্বজনগ্রাহ্য কোচের চরিত্র তৈরি করেন। মেক-আপ তৈরি করেছিলেন নিজে নিজেই, মায় ঘষা কাচের হাই-পাওয়ার চশমা জোগাড় করা পর্যন্ত, অবশ্যই পরিচালক সরোজ দে-র সঙ্গে আলোচনা করে। এমন ভাবে ধুতি আর হাফ হাতা শার্ট পরে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন গোটা ছবিতে, দেখে তাঁকে উত্তর কলকাতার জল-ধুলো-মাটি ঘাঁটা সাঁতারের কোচ ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশই ছিল না। মনেই থাকত না, তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

তাঁর এই একের পর এক বিবিধ চরিত্র হয়ে ওঠার ইতিবৃত্তই অমিতাভ নাগের নতুন বইয়ে। সৌমিত্রের পছন্দের কুড়িটিতে যেমন ‘কোনি’র ক্ষিতীশ সিংহ, তেমনই ‘অশনি সংকেত’-এর গঙ্গাচরণ চক্রবর্তী। সত্তর দশকে কঠোর সমালোচনা করলেও ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকা সৌমিত্র-কৃত গঙ্গাচরণ সম্পর্কে লেখে: ‘দি আর্কিটাইপ অব দ্য কমন ম্যান, দ্য ফার্স্ট অ্যান্ড ইজিয়েস্ট ভিক্টিম অব অল সোশিয়ো-ইকনমিক ডিজাসটার্স।’

Advertisement

সে ছবিতেও তাঁর হোমওয়ার্কে কোনও খামতি ছিল না। বীরভূমের মন্বন্তরপীড়িত গ্রামে ব্রাহ্মণেরা কত রকম করে ধুতি পরেন, পৈতেটাকে কী ভাবে ভাঁজ করে কাঁধে রাখেন, গা-মুখ মুছতে গামছা কী ভাবে ব্যবহার করেন, বসা বা দাঁড়াবার ভঙ্গি, হাঁটার সময় পায়ের পাতা বাইরের দিকে মেলে রাখা, লেখাপড়া কতটুকু, পাঠশালায় পড়ানো, হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, সরলতার সঙ্গে একটু ধূর্তামি— এ ভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করতে-করতে যেন ক্ষোভই হয় সৌমিত্রের: এক জন সাহেবের থেকেও গাঁয়ের একজন চাষা আমাদের কাছে থেকে দূরে। তাকে, তার মনোজগৎটাকে বাস্তবিক চিনিই না।

সৌমিত্র অভিনীত এক-একটি চরিত্র ধরে কুড়িটি ছবিই আলোচনা করে গিয়েছেন অমিতাভ। তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্ত’-এর অঘোর, চোরের চরিত্র। সে চরিত্রে সৌমিত্রের অভিনয় সূত্রে একটি জরুরি কথা খেয়াল করিয়ে দেন তরুণবাবু: ‘হি ডাজন্‌ট ডিপেন্ড অন দ্য ডিরেক্টর টু টেল হিম মাচ, দিস এফোর্ট সিমস টু বি হিজ ডিউটি।’ তপন সিংহের ‘হুইল চেয়ার’-এ এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ডাক্তারের চরিত্র তুলতে কয়েক মাস ধরে হুইল চেয়ারে চলাফেরা রপ্ত করেন সৌমিত্র। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসালয়ে গিয়ে দিনের পর দিন লক্ষ করেছেন ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক, চিকিৎসকের মানসিক অবস্থার সূক্ষ্ম রকমফের। সেরা প্রাপ্তি মনে হয়েছিল তাঁর, যখন এক হুইল চেয়ারবন্দি মানুষ ছবিটি দেখার পর এসে বলেন, নিজেকেই যেন দেখতে পাচ্ছিলেন সৌমিত্রের মধ্যে। রাজা মিত্রের ‘একটি জীবন’-এ বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে তৈরি বুদ্ধদেব বসু রচিত গুরুদাস ভট্টাচার্যের চরিত্রে অভিনয়ের সময় সামান্য একটু পেশি সঞ্চালনে শোক প্রকাশ করেছিলেন, পুত্রের মৃত্যুসংবাদে। পরিচালকের মনে হয়েছিল ‘ইকনমি অব এক্সপ্রেশন ক্যান বি সাট্‌ল ইয়েট সো সেনসিটিভ।’ ‘আকাশ কুসুম’ প্রসঙ্গে মৃণাল সেন কিছুকাল আগেও ফের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন: ‘হি ওয়জ, অ্যান্ড স্টিল ইজ, আ ফ্যাসিনেটিং অ্যাক্টর।’

অবাঙালি পাঠকদের জন্য তাঁকে নিয়ে এই বইটিই প্রথম, শুরুতে সে কথা নিজেই জানিয়েছেন সৌমিত্র। তাঁর নিজের বই দ্য মাস্টার অ্যান্ড আই সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর শৈল্পিক বোঝাপড়ার বৃত্তান্ত। আর এটি সত্যজিৎ-সহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের ছবিতে তাঁর অভিনয় নিয়ে আলোচনা। বাংলায় অবশ্য তাঁকে নিয়ে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বা অনসূয়া রায়চৌধুরী। তবে সৌমিত্রের অভিনয় যেহেতু আজ আন্তর্জাতিক সিনেমার দর্শকের কাছে চর্চার বিষয়, এ বই বহু প্রতীক্ষিতই সে দিক থেকে। বইয়ে আছে সুকুমার রায় ও অন্যান্য সূত্র থেকে নেওয়া কিছু দুর্লভ ছবি।

ছবির কথা ছাড়াও লেখক একটি অধ্যায়ে বিশিষ্ট পরিচালক-অভিনেতা-সমালোচকদের (কেউ কেউ বিদেশেরও) সৌমিত্র সম্পর্কিত ধ্যানধারণা জড়ো করেছেন। তাতে যেমন আদুর গোপালকৃষ্ণন বা শ্যাম বেনেগাল আছেন, তেমনই আছেন ওম পুরী বা নাসিরুদ্দিন শাহ। নাসির উল্লেখ করেছিলেন সৌমিত্রের, ‘অ্যামেজিং এবিলিটি টু অ্যাডপ্ট টু ভেরিয়াস ক্যারেকটার্স অ্যান্ড ওয়ার্কিং স্টাইলস অব ডিরেক্টর্স। আর বেনেগালের প্রশ্ন: ‘ ইজ সত্যজিৎবাবুজ ম্যাগনিফায়েড আর্টিস্টিক ওয়ার্ল্ড ফুললি রেডিয়েন্ট উইদাউট সৌমিত্র?’

আসলে সত্যজিৎ থেকে শুরু করে যে কোনও সৃষ্টিশীল পরিচালকই যখনই কোনও কঠিন বহুমাত্রিক চরিত্রর কথা ভেবেছেন, খোঁজ পড়েছে সৌমিত্রের, যিনি সর্বাধিক অভিব্যক্তিতে রক্তমাংস এনে দিতে পারেন সে চরিত্রে। সেই সংবেদনশীল অভিনয়ের কোনও সহজ ব্যাকরণ নেই, সৌমিত্র নিজেই তৈরি করে নেন সেই সৃষ্টির পরিসর। সত্যজিতে দীক্ষিত সৌমিত্র এই যে সূক্ষ্ম পরিশীলিত অভিনয়ের ধারা আজও বহন করে চলেছেন, তাঁর কোনও পূর্বসূরি ছিলেন কি? লেখক-কৃত সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে উত্তরও দিয়েছেন সৌমিত্র: ‘বলরাজ (সাহানি) ইজ দ্য বেস্ট সিনেমা অ্যাক্টর দ্যাট ইন্ডিয়া হ্যাজ সিন।’

তবু, তিনশোর উপর ছবিতে অভিনয় করেছেন যিনি, তাঁকে কি কুড়িটা ছবিতে চেনানো যায়? তিনি নিজে বাছলেও। অমিতাভ তাঁর পছন্দের আরও ক’টি ছবির নাম বলেছেন, যেমন অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’ কি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’। কিন্তু সলিল দত্তের ‘অপরিচিত’ বা বিজয় বসুর ‘বাঘিনী’কে কি আজও ভোলা যায়? কিংবা গত দেড় দশকে রাজা সেনের ‘আত্মীয়স্বজন’, সুমন ঘোষের ‘দ্বন্দ্ব’, অতনু ঘোষের ‘রূপকথা নয়’?

বিয়ন্ড অপু/ টোয়েন্টি ফেভারিট ফিল্ম রোলস অব সৌমিত্র চ্যাটার্জি, অমিতাভ নাগ। হার্পার কলিন্স, ৩৫০.০০

আরও পড়ুন
Advertisement